E-Paper

কাকে বলে দুর্ঘটনা

রেল কর্তৃপক্ষ আপাতত ‘তদন্ত চলছে’ এই বক্তব্যের পিছনে মুখ লুকিয়েছেন। তদন্তের রিপোর্ট প্রকাশ হবে, কিন্তু ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নেওয়া হবে কি?

শেষ আপডেট: ১৮ ডিসেম্বর ২০২৩ ০৭:৪৬
Bardhaman Water Tank Collapsed

বর্ধমান স্টেশনে জলের ট্যাঙ্ক ভেঙে পড়ার পরের মুহূর্তের ছবি। —ফাইল চিত্র।

বর্ধমান স্টেশনে জলের ট্যাঙ্ক ভেঙে পড়ে তিন জনের প্রাণহানি এবং চৌত্রিশ জনের গুরুতর আঘাতের ঘটনাটিকে ‘দুর্ঘটনা’ বলা চলে কি না, তা নিয়ে সংশয় থেকে যায়। যে কোনও পুরনো নির্মাণের যথাযথ সংরক্ষণ না হলে তা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে, বিপর্যয় ঘটা প্রায় নিশ্চিত। নির্মাণটি হয়তো অকস্মাৎ ভেঙে পড়ে, কিন্তু তার পিছনের কারণগুলি বহু দিনের— কর্তাব্যক্তিদের দায়িত্বে অবহেলা, নিরাপত্তার পরীক্ষা নিয়মিত না করা, কিংবা কেবলই নিয়মরক্ষার জন্য পরিদর্শনের খাতায় দাগ দেওয়ার পালা চলতে থাকে। বর্ধমানের ঘটনার পরে প্রকাশ পাচ্ছে, দেড়শো বছরেরও বেশি প্রাচীন ওই ধাতব জলাধারের কার্যক্ষমতার মেয়াদ বহু আগেই ফুরিয়েছে। ভাঙা অংশগুলি সাক্ষ্য দিচ্ছে, ট্যাঙ্কের দেওয়ালগুলিতে মরচে ধরেছিল, লোহার চাদরের ঘনত্ব কমে এসেছিল। রেলের তরফে নিয়মিত পর্যবেক্ষণের নিয়ম পালনের দাবি করা হয়েছে বটে, কিন্তু কোন প্রক্রিয়ায় কী কী পরীক্ষা করা হয়েছে, কী প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়েছে, জানা নেই। সেই প্রক্রিয়া ও প্রযুক্তিতে জলাধারের বিপদসীমা পার হয়ে আসার লক্ষণ মেলেনি, না কি ইঙ্গিত মিললেও তা উপেক্ষিত হয়েছে, তা-ও অজানা। পাশাপাশি, স্টেশনে কর্তব্যরত রেল কর্মীদের তৎপরতা ও দায়বদ্ধতা নিয়েও প্রশ্ন জাগে। বুধবার কেন ধারণক্ষমতার বেশি জল ভরা হয়েছিল? ট্যাঙ্ক থেকে জল পড়ছে, যাত্রীরা তা দেখলেও কর্মীরা দেখেননি কেন? দুর্ঘটনা আসন্ন, নজর করে যদি অকুস্থল থেকে যাত্রীদের সরে যাওয়ার নির্দেশ দিতেন রেল কর্মীরা, তা হলেও ক্ষতি কিছুটা এড়ানো হয়তো সম্ভব হত। আগাম সতর্কতার কোনও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।

রেল কর্তৃপক্ষ আপাতত ‘তদন্ত চলছে’ এই বক্তব্যের পিছনে মুখ লুকিয়েছেন। তদন্তের রিপোর্ট প্রকাশ হবে, কিন্তু ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নেওয়া হবে কি? হাওড়া স্টেশনের মতোই প্রাচীন, ঐতিহ্যবাহী বর্ধমান স্টেশনটিও। তার ভবনের বারান্দা ভেঙে পড়ে এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছিল তিন বছর আগে। ‘হেরিটেজ’ ভবন ধ্বংসের ক্ষতি কেবল টাকা দিয়ে মাপা যায় না। তবু দেশের অমূল্য সম্পদ সংরক্ষণের প্রতি প্রশাসনের আগ্রহ দেখা যায় না। কারণটি অনুমান করা কঠিন নয়— প্রশাসনিক কাজের অধিকাংশই হল নীরব নিয়মানুবর্তিতার কাজ। হিমবাহের অতি সামান্য অংশই যেমন জলের উপরে দৃশ্যমান থাকে, তেমনই জনসমক্ষে প্রচারিত প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডের পিছনে থাকে রক্ষণাবেক্ষণ, পরীক্ষা, নিয়মিত সমীক্ষা, এবং সে সবের ফল বিশ্লেষণ করে সংশোধনের উদ্যোগ। পরিষেবায় বিরতি না থাকা, জনবহুল স্থানে দুর্ঘটনা না ঘটা, এগুলিই ইঙ্গিত করে যে জনচক্ষুর আড়ালে সুষ্ঠু ভাবে কাজ করে চলেছে প্রশাসন।

আক্ষেপ, দলীয় রাজনীতি যত বেশি প্রচারমুখী হয়েছে, তত প্রশাসনকেও ব্যস্ত করেছে চমকপ্রদ নানা নতুন প্রকল্পের প্রস্তুতিতে, গুরুত্ব কমেছে ধারাবাহিক বিধিপালনের। পাশাপাশি, কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের প্রায় সব বিভাগে স্থায়ী কর্মীদের সংখ্যা কমেছে, বেড়েছে শূন্য পদ, ঠিকাকর্মী। যে কর্মীরা আছেন, দৈনন্দিন সঙ্কট মোকাবিলার ব্যস্ততায় তাঁরা উপেক্ষা করছেন নিরাপত্তামূলক কাজগুলি। বড় দুর্ঘটনার পর প্রায়ই তদন্তে দেখা গিয়েছে যে, ছোট ছোট সমস্যার মাধ্যমে ত্রুটির ইঙ্গিত আগেই মিলেছিল। যেমন, জুন মাসে ওড়িশার বাহানাগায় ভয়ানক ট্রেন-দুর্ঘটনার তদন্ত করে রেল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিলেন যে, সিগন্যাল ও কেব‌্‌ল-এর সমস্যার ত্রুটিতে আগেও ট্রেন বেলাইনে চলে গিয়েছিল, স্টেশন মাস্টার তা জানাননি। এ ভাবেই বড় বড় দুর্ঘটনার পরে শোরগোল ওঠে, তখন সামনে আসে বিপন্নতার ছবি— সেতুর ভগ্নস্বাস্থ্য, বহুতল বা বাজারের অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থার অভাব, রাজপথের অবৈধ দখল, প্রভৃতি। কিছু দিন পরে আবার নতুন শঙ্কা দেখা দেয়, পুরনো শঙ্কা সরে যায় আড়ালে— যত দিন না দুর্ঘটনা, জীবননাশ, শোক-আতঙ্কের বয়ান ফের ধ্বনিত হয়।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Indian Railways Bardhaman

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy