রবীন্দ্রসংগীত গাইতে হলে গানে ‘ভাব’ আনতে হবে, এমন একটা ধারণা ছিল আমাদের। তাই গলা কাঁপিয়ে, ফিসফিসে উচ্চারণ করে সবাই চেষ্টা করত ভাব আনার। আমাদের শিক্ষক আশিস ভট্টাচার্য বলতেন, ‘ওরে, সুরের মধ্যেই ভাব আছে। গলায় সুরটা বসা, ভাব আপনি আসবে।’ ‘নিউটন’ ছবিটা দেখে সেই কথাটা মনে পড়ে যাচ্ছিল (ছবিতে একটি দৃশ্য)। ছবির নায়ক নিউটন সরকারি কেরানি। বেচারি রোগাসোগা, চোখ পিটপিট করা স্বভাব, সবার তামাশার পাত্র। কিন্তু গলায় সুর বসানোর মতো, জীবনে সে প্রতিষ্ঠা করেছে নিয়মকে। ব্যস, ঘরে-বাইরে ঝামেলা: ষোলো বছরের মেয়ে বিয়ে না-করার কী আছে? দণ্ডকারণ্যে ভোট করানোরই বা কী আছে?
ভোট বয়কটের ডাক দিয়েছে মাওবাদীরা। পোলিং এজেন্টও নেই। নিউটন তবু যাবেই। জঙ্গলের ভিতর আট কিলোমিটার হেঁটে, পোড়ো ইস্কুলবাড়ি ঝাঁট দিয়ে, টেবিলে সাদা চাদর বিছিয়ে, ভোটার তালিকা, পেন-পেন্সিল নিয়ে সে রেডি প্রিসাইডিং অফিসার নিউটন কুমার।
কাণ্ড দেখে হাসি পায়। কোনও প্রার্থীকেই যারা চেনে না, ইভিএম যন্ত্রটা চোখে দেখেনি, তারা ভোট দিলেই বা কী? ছিয়াত্তরটা ভোটের মূল্যই বা কত? সেনা অফিসার বোঝায়, বুথ করারই দরকার নেই। নিউটন চাইলে জওয়ানরাই না হয় বুথে বসবে। যদি জিরো পার্সেন্ট ভোটিং দেখাতে না চায়, সেনারাই গ্রামবাসীর হয়ে ভোট দেবে। ‘এটা তো পিকনিক।’
নিউটন একটুও না হেসে জবাব দেয়, ‘না, এটা ইলেকশন।’ পদে পদে সংঘাত বাধে সেনার সঙ্গে। শেষ অবধি সেনার বন্দুক কেড়ে নিয়ে সেনার দিকে তাক করে দাঁড়ায় সে। যতক্ষণ না তিনটে বাজে, ভোট শেষ হয়, বন্দুক নামায় না। জঙ্গল থমকে টেনশনে। গাছের গোড়ায় রাখা ইভিএম, তাতে ভোট দিচ্ছেন জনাচারেক গ্রামবাসী, আর নিউটনের বন্দুকের মুখে জওয়ানরা হাত উপরে তুলে দাঁতে দাঁত ঘষছে। কে বলে নিয়মরক্ষা এক নিষ্প্রাণ কাজ? গণতন্ত্রে প্রাণ হাতে নিয়ে নিয়মকে রক্ষা করতে হয়।
তা বলে নির্বাচনে কি প্রহসন নেই? আছে বইকি। ভোট ব্যাপারটা কী, তাই বোঝেন না আদিবাসীরা। নিউটন সবাইকে বোঝায় ভোট দিয়ে কী হয়। শুনে তারা এক বৃদ্ধকে দেখিয়ে বলে, ‘ও-ই আমাদের হয়ে দিল্লি যাক।’ শেষ অবধি যেমন ইচ্ছে বোতাম টেপে তারা। চোখমুখ কালো করে নিউটন বসে থাকে। অসামান্য অভিনেতা রাজকুমার রাও, তাঁর অভিব্যক্তি নিরুচ্চারে প্রশ্ন করে, এই কি গণতন্ত্র?
অথচ পোড়ো ইস্কুলে, জংলি গাছের তলায় ভোট যে শেষ অবধি নেওয়া হল, সে-ও কি গণতন্ত্র নয়? মাওবাদী, সেনা জওয়ান, কেউ তো হতদরিদ্র, ঘর-পোড়া আদিবাসীদের ভোট আটকাতে পারল না। এক বিদেশি সাংবাদিক যখন জোর করে জড়ো-করা আদিবাসীদের লাইনের সামনে দাঁড়িয়ে রিপোর্ট করেন, ‘ইন্ডিয়াজ ডেমোক্র্যাসি ইজ ডিপ’, তখন টের পাওয়া যায় যে সে কথাটার অসারত্ব অনেক, অথচ অসত্য নয়। আধখানা ভাঙা সুর, তবু পঞ্চমে স্বর বাজে। কেঁপে ওঠে দেশ।
সর্বত্রই তো গণতন্ত্র এমন ‘মন্দের ভাল’ হয়েই চলে। এ রাজ্যে অধিকাংশ পঞ্চায়েতে ডাকা হয় না গ্রামসভা, কর্তারা সবার হয়ে সই করে দেন। কিন্তু যখন বসে, কোনও কোনও সভা সত্যিই ‘সংসদ’ হয়ে ওঠে। গ্রামবাসী সওয়াল করেন, অতটুকু কাজের জন্য এত কেন খরচ হল? অমুক হিসেবটা সংসদ-ওয়াড়ি ভেঙে দেখান। ওই টাকাটা না হয় এ বছর অন্য ভাবে খরচ হোক। না হয় ওদেরটা আগে হোক, আমাদের পরে হবে। জবাবদিহি, দরদস্তুর, বিতর্ক, ঐকমত্য। মেঘের ফাঁকে তীব্র রশ্মির মতো হঠাৎ দেখা যায় গণতন্ত্রের ঐশ্বর্য।
মানুষের সম্মিলিত ইচ্ছার শক্তি সাধারণত প্রকাশ পায় নিয়ম ভাঙায়। অবরোধ, ধর্মঘট, আইন অমান্য। তা দেখে মনে হয়, নিয়মের অক্ষর বা ‘ওয়ার্ড’-এর চাইতে ‘স্পিরিট’-কে বেশি গুরুত্ব দেওয়া চাই। অথচ প্রতিটি মানুষের সমান মর্যাদা, অধিকার যদি হয় গণতন্ত্রের ‘স্পিরিট,’ তবে তা সংবিধানের নির্দেশে, নির্বাচন কমিশনের বিধিতে যত স্পষ্ট, শর্তহীন ভাবে রয়েছে, আর কোথাও তা নেই। মনের মধ্যেও নয়। সেখানে পরতে পরতে জমা হয় ‘আসল’ কথা, আসলে সবাই সমান নয়, সবার কথার দাম এক নয়। আসলে সব কিছু সকলের জন্য নয়। পলি জমে পাথর হয়, প্রেজুডিস জমে হয় কমন সেন্স। সেই কঠিন কাণ্ডজ্ঞানের সঙ্গে টক্কর লাগে গণতন্ত্রের অক্ষরের। অক্ষরের প্রতি তাচ্ছিল্যটা শেষ অবধি হয়ে দাঁড়ায় আদিবাসী, গরিব, স্বল্পশিক্ষিতের প্রতি তাচ্ছিল্য। তাকে চাপা দিতে নিজের ওজন দেখাতে হয়। সেনা অফিসার নিউটনের হাতে বন্দুক দিয়ে বলেন, ‘কত ভারী দেখছেন? এই হল দেশের দায়িত্বের ভার।’
পরিচালক অমিত মসুরকরের বয়স মাত্র ছত্রিশ। একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, সংবিধানের প্রস্তাবনা (প্রিঅ্যাম্বল) থেকে ছবির জন্ম। ‘প্রস্তাবনা পড়তে পড়তে গায়ে কাঁটা দেয়, মনে হয় কোন উচ্চতায় উঠে গিয়েছি। বাস্তবটা ভিন্ন।’ কিন্তু যদি কেউ অক্ষরে বিশ্বাস করত?
আলোচনা-উদ্দীপ্ত গ্রামসভায় দাঁড়িয়ে, আগ্নেয়াস্ত্র তুচ্ছ-করা নির্বাচনের সামনে দাঁড়িয়ে বোঝা যায়, কী হত তা হলে। আর বোঝা যায় কেন অমর্ত্য সেন বলেছেন, ‘কে গণতন্ত্রের যোগ্য,’ এই প্রশ্নটাই ভুল। গণতন্ত্রের মধ্যে দিয়েই মানুষ যোগ্য হয়ে ওঠে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy