Advertisement
E-Paper

ও ভাই কানাই

চেকে টাকা তুললেই তো হয়, তবু এটিএমে ভিড়। কেন? কারণ এটিএমে ছোট নোট। ব্যাঙ্কে মোদী নোট। লিখছেন সুপর্ণ পাঠক।লাইনটা বাড়ছে। টাকা এসেছে। মুঠিফোনে এক শুভানুধ্যায়ীর বার্তা পেয়েই দৌড়ে এসেছি। ফুটপাথের উপর দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে। লাইনের মুখের আন্দাজ পাচ্ছি কিন্তু বুঝতে পারছি না। কানে আসছে অযাচিত তথ্য, ‘টাকা ভরছে।’

শেষ আপডেট: ২২ নভেম্বর ২০১৬ ০০:৪৫

লাইনটা বাড়ছে। টাকা এসেছে। মুঠিফোনে এক শুভানুধ্যায়ীর বার্তা পেয়েই দৌড়ে এসেছি। ফুটপাথের উপর দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে। লাইনের মুখের আন্দাজ পাচ্ছি কিন্তু বুঝতে পারছি না। কানে আসছে অযাচিত তথ্য, ‘টাকা ভরছে।’

হঠাৎ ঘড়ঘড় করে গেট উঠল। তাল মিলিয়ে জুটল আরও কিছু নোটপ্রার্থী। লাইনের মুখ থেকে আওয়াজ, ‘কানাই, এ দিকে। এনেছিস?’ গজিয়ে ওঠা দলের কেউ বলল, ‘হ্যাঁ। ম্যাডামেরও আছে।’

লাইনে যেন প্রাণের সঞ্চার হল। কে যেন বলে উঠল, ‘বেন্দাবন থেকে সুপারফাস্টে এলে বাওয়া? রাধার কার্ড?’ পরে এসে আগে ঢোকা নিয়ে বাকিরা নির্বিকল্প। বাঙালির কি বিষদাঁতও গেছে?

লাইনটা বাড়ছে। সবাই আজকের অঙ্কে মধ্যবিত্ত। পে কমিশনের বদান্যতায় মল এখন আটপৌরে প্রয়োজনের বাজার। সবজির জন্য নেট-বাজারে ছিপ না ফেললেও, ফ্লিপকার্টের দাম মুখস্থ। কাজের লোকের মাইনে, ছেলের টিউশন ইত্যাকার খরচের টাকা মাস পয়লাই খামবন্দি। তাও সব পাঁচশোর নোটে। মাসকাবারি হয়ে গিয়েছে, মাইনেও চুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাজার আর ওষুধের খরচ পাঁচশোতেই থেকে গিয়েছে। বাড়িতে বাবার পেনশনের টাকা, সে-ও পাঁচশোতেই।

লাইনটা আবার জট পাকাচ্ছে। আওয়াজ এল, ‘কানাই, কটা করে ঘষছ বাবা? লাইন সোজা করুন।’ ধুতির কোঁচা ঝাড়ার মতই লাইনটা এক ঝাড়ে সোজা হয়ে গেল।

‘তো আজকে কি মাসিমা, মেসোমশাই, বউদি— সবাইকেই পকেটে নিয়ে এসেছেন?’

‘দাদা, গোটা জয়েন্ট ফ্যামিলি ভরে দিলে আমরা খাব কী?’

ব্যস, আর দেখে কে? ‘একটার বেশি দুটো ঘষবেন না। অ্যাই, গেটে দেখ, বলরাম কানাইয়ের দল গোটা বেন্দাবন নিয়ে ঢুকল কি না! একটা মেশিনে একশো জন পাবে। দুটো মেশিন। আমরা সবাই পাব। শালাদের ঠেকা। লাইনে ক’জন।’

মাথা গোনায় কেউ উৎসাহ দেখাল না। কে যেন আশ্বস্ত করল, এক বারই তোলা যাচ্ছে। লাইন শান্ত। ফিরল পুরনো আলোচনা। জয়েন্ট ফ্যামিলি দাদার যুক্তি সোজা। চেকে টাকা তুললে তো সবাই বেঁচে যায়, তবুও এটিএমে ভিড় কেন? কারণ একটাই। এটিএমে ছোট নোট। ব্যাঙ্কে মোদী নোট।

রাধা দাদা খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেঁসে ফেললেন। ‘দাদা, এটা নতুন ছাড়লেন। বাজারে মোদী নোট দিয়ে সবজি কিনলে প্যাঁদাবে।’

খুচরোর কথা উঠতেই কে যেন বলে উঠল, ‘দেখেছেন, ভিখিরি নেই রাস্তায়।’ বেশ চিন্তিত হয়ে উঠল সবাই। লাইনটা এগোচ্ছে। কিন্তু গতি কম। সত্যিই কি ভিখারি কমেছে?

ঢেউয়ের মতো মন্তব্য আছড়ে পড়ছে। কেউ লাফিয়ে নিচ্ছে, কেউ ডুব দিয়ে মাথার উপর দিয়ে গলিয়ে দিচ্ছে পরেরটা কেমন দেখার জন্য।

কিন্তু, কী আশ্চর্য, বাঙালি ভিড়, তাতে কোনও বিশেষজ্ঞ থাকবে না? সকালে খবরের কাগজটা আজ মন দিয়ে পড়েনি কেউ, না কি? চিন্তাটা মাথায় আসতে না আসতেই তথ্যদাদা বাজারে নামলেন। ‘আরে বাবা, বাজারে মোট নোটের ৮৬ শতাংশই তো পাঁচশো আর হাজারে। মেশিনে সেই তো ১৪ শতাংশ ১০০ই ঘুরছে। ৮৬-র কাজ ১৪ দিয়ে হবে?’

এরই মধ্যে কে বলল, ‘কিন্তু কাজটা মোদীজি বেশ ভালই করেছেন। এক গুঁতোয় কালোবাজার আর আতঙ্কবাদ শেষ। সার্জিকাল স্ট্রাইক বলে সার্জিকাল স্ট্রাইক!’ সঙ্গে সঙ্গে এক জন আকাশপানে তাকিয়ে বলে উঠল, ‘কোন নেতা আবার কবে নিজের ভুলে দেশের ভাল করল?’

ভালমানুষ দাদা মাথা দুলিয়ে বলতে শুরু করলেন, ‘আমাদের মতো সাধারণের কথা ভাবার কেউ নেই। কালো টাকা নিচ্ছিস? নে। সন্ত্রাস থামা। সবাই আমরা দু’হাত তুলে নাচব। কিন্তু আমাদের কার্ড দিয়ে রেশন লাইনে দাঁড় করিয়ে দিল?’

হঠাৎ লাইনের পাশ দিয়ে গার্ডকে দেখা গেল নির্বিকার মুখে মুড়ি খেতে খেতে এটিএমের দিকে যাচ্ছেন। বোঝা গেল লাইনের শ্লথগতির কারণ। গেটের মুখে আমি। রাধা দাদা মারমুখী, ‘গোটা বেন্দাবন টাকা পেয়ে গেল, আজও আমি আঙুল চুষব?’ লাইনটা আবার নিঃশব্দে ছাড়া ধুতির মতো নেতিয়ে গেল।

না, আমি টাকা পাইনি। ফিনিশিং লাইন আমার জন্য নয়।

Demonetization ATM
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy