পিরিয়ড একটা ট্যাবু। যদিও এর হঠাৎ আবির্ভাব আমাদের হাতে থাকে না। তবু প্রকাশ্য প্রদর্শনে ফিসফাস, বাঁকা চোখ, ট্যারা মন্তব্যেই আমাদের সমাজ অভ্যস্ত। এও এক ধরনের যৌন নিগ্রহ। এই মনোভাবের বিরুদ্ধে জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে #প্যাডঅ্যাগেনস্টসেক্সিজম প্রচারে পড়ুয়ারা সরব হয়। এবং গত দু’এক বছরে অন্তত সোশ্যাল মিডিয়ায় (যদি নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এই মাধ্যমকে একটা মান্য সমান্তরাল সামাজিক আদান-প্রদানের ক্ষেত্র বলে ধরে নিই) এ নিয়ে লেখা, মন্তব্য দৃশ্যতই বেড়েছে। ঋতু রক্তমাখা কাপড় পরে তোলা রুপি কৌরের ইনস্টাগ্রাম ছবি দীর্ঘ দিন বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে। কেরলের কারখানায় স্ট্রিপ সার্চের প্রতিবাদে মহিলা কর্মীরা স্যানিটারি ন্যাপকিনে প্রতিবাদ লিখে জানান।
পিরিয়ড একটা ট্যাবু। সে কারণে কেরলের শবরীমালা মন্দির বোর্ডের সম্পাদক গত বছরও বলেছেন, যত দিন না এমন কোনও যন্ত্র আবিষ্কার হচ্ছে, যা প্রমাণ করতে পারবে মেয়েরা ঋতুমতী কি না, তত দিন মন্দিরে মেয়েদের প্রবেশাধিকার বন্ধ রাখা উচিত। প্রতিবাদে #হ্যাপিটুব্লিড প্রচারে আবারও সরব হয়েছিল সোশ্যাল মিডিয়া।
পিরিয়ড একটা ট্যাবু। না হলে একটা স্বাভাবিক জৈবিক প্রক্রিয়ার জন্য প্রয়োজনীয় স্যানিটেশন এখনও এ দেশে সরকারি ভাবে বিনামূল্যে দেওয়া হয় না? বরং তার ওপর অতিরিক্ত জিএসটি চাপে। এমনকী এই নিয়ে সচেতনতার প্রচারও তেমন চোখে পড়ে না। তামিলনাডুর অরুণাচলম মুরুগানাথমদের মতো বিপ্লব ঘটানো একক উদ্যোগীদের কল্যাণে বেশ কিছু রাজ্যের মেয়েরা তাও কাপড়ের টুকরো ছেড়ে সস্তায় স্বাস্থ্য রক্ষা করতে পারছেন। কিন্তু প্রেসিডেন্সির মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে পর্যাপ্ত এবং ভাল মানের স্যানিটারি ন্যাপকিন ভেন্ডিং মেশিনের দাবিতে আজও ছাত্রীদের ঋতুচলাকালীন ন্যাপকিন ব্যবহার না করে প্রতিবাদ গড়ে তুলতে হয়।
পিরিয়ড একটা ট্যাবু। তাই প্রবল যন্ত্রণায় কাতরেও মাসের ওই দু’একটা দিন আমরা ম্যানেজ করে নিই। এত দিন পর মুম্বইয়ের দুটি সংস্থা মহিলা কর্মীদের জন্য পিরিয়ডের প্রথম দিনটিতে সবেতন ছুটি ঘোষণা করেছে। কিন্তু বাকিরা? তারা তো ওই দিনগুলোতেই মুখ বুজে ঘরকন্না থেকে ট্রামে বাসে মাঠে ঘাটে অফিসে দোকানে পুরুষদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে যায়। আর জায়গা ছাড়ার তো প্রশ্নই উঠছে না। কারণ এত বছর ধরে এই সমানাধিকারের লড়াইই তো করে এসেছি আমরা। সেরেনা উইলিয়ামস গর্ভবতী অবস্থায় খেলে গ্র্যান্ডস্ল্যাম জিতেছেন, তাই সামান্য পিরিয়ডের ব্যথার জন্য আমাদের ছুটির প্রয়োজন পড়ে না।
মাসিক নিয়ে আমাদের দেশে, এমনকী গোটা বিশ্বে ওঠা তর্কগুলো আসলে এ রকমই বহুমুখী। মাঝে এই এতগুলো বা এর চেয়েও বেশি প্রশ্ন লুকিয়ে আছে। এই প্রত্যেকটা প্রশ্নকে আলাদা আলাদা ভাবে বিচার করতে হবে। একটার সঙ্গে আর একটা সমস্যাকে গুলিয়ে ফেললে চলবে না। উনিশ শতকে স্ত্রী লিঙ্গের মানুষের শারীরিক-মানসিক-বৌদ্ধিক বৈচিত্রকে অক্ষমতা হিসেবে দাগিয়ে দিয়ে চিকিৎসা বিজ্ঞান ‘প্রমাণ’ করেছিল মেয়েরা ঘরের বাইরে পুরুষদের মতো একই কাজ করার অংশীদার হতে পারে না। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা বিজ্ঞানের অধ্যাপক এডওয়ার্ড ক্লার্ক বলেছিলেন ‘মাসিক অসুস্থতা’র জন্য মেয়েরা জনপরিসরে কাজের উপযোগী নয়। মেয়েদের জন্য তৈরি হওয়া নতুন পাঠ্যক্রমেও এই বিভেদনীতি বজায় ছিল। এই অবস্থা থেকে পুরুষদের সঙ্গে সমান কাজে যোগ দিতে পারার লড়াইয়ের ইতিহাসটা প্রাচীন এবং দীর্ঘ। তাই আজকে হঠাৎ ‘মেয়েলি’ জৈবিক ক্রিয়ার কারণে সবেতন ছুটি চাওয়ার ক্ষেত্রে ‘নারীবাদী’ লেখক, সাহিত্যিকদের একাংশের কাছ থেকেই যে প্রথম বিরোধিতা আসবে, সেটাই স্বাভাবিক। মাসিকের প্রথম দিনে এই বিশেষ ছুটির বিল পাশ করতে গিয়ে রাশিয়াকেও নারীবাদীদেরই বিরোধিতার মুখোমুখি হতে হয়। এবং বিলটি স্থগিত থাকে।
পুরুষদের সমান হতে গিয়ে আমরা আজও এটা ভুলে যাচ্ছি যে, শুধুমাত্র পুরুষ কর্মীদের কথা ভেবে সাজানো কর্মক্ষেত্রে মহিলা কর্মীরা পরে এসে যোগ দেন। সেখানকার পরিকাঠামো, কথাবার্তা, চলাফেরা, সুযোগসুবিধা সমস্তটাই মূলত পুরুষ কর্মীদের শর্তে নির্ধারিত। হ্যাঁ, ঠিকই, যে কোনও প্রাণীকেই বিশেষ অবস্থায় গোড়া থেকে রাখলে, সেই অবস্থাটাই তার অভ্যেসে দাঁড়িয়ে যায়। সেই অবস্থাটা যদি বিশেষ করে তার কথা মাথায় না রেখেও তৈরি হয়, তা হলেও ওই প্রতিকূলতাতে বাঁচাই তার কাছে স্বাভাবিক মনে হয়। এতটাই স্বাভাবিক, যে তা নিয়ে প্রশ্ন করতেও সে ভুলে যায়। যেমনটা হয় খাঁচায় পোষা পাখি বা ঘরে পোষা কুকুর-বেড়ালদের ক্ষেত্রে। সে কারণেই পশ্চিমবঙ্গের পরিবহণ দফতরে আজও মেয়েদের যোগদান প্রায় চোখেই পড়ে না। যে ক’জন মহিলা বাস কন্ডাকটর আছেন, সামান্য শৌচাগারের সুবিধাটা থেকেও অনেক সময়ে তাঁরা বঞ্চিত। পুরুষপ্রধান কর্মক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত টিকে থাকতে গেলে তাঁদেরও আসলে পুরুষদের ‘মতো’ই হয়ে উঠতে হয়। তামিলনাড়ু, কর্ণাটকের একটি নারীবাদী সংস্থার রিপোর্ট জানাচ্ছে, কাপড় কারখানার মেয়ে শ্রমিকদের পুরুষ ম্যানেজাররা সমানে নজরবন্দি রাখেন, যাতে তাঁরা অন্যদের সঙ্গে না বেশি কথা বলেন, বাথরুমে যাতে অযথা সময় ব্যয় না করেন। কলকাতার ক’টি কর্পোরেট সংস্থায় মহিলা কর্মীদের জন্য প্রয়োজনীয় স্যানিটারি ন্যাপকিন মজুত থাকে, বা পুরুষ সহকর্মীর কাছে অবলীলায় সেই প্রয়োজন জানাতে পারার মতো পরিবেশ রয়েছে, সেটাও বড় প্রশ্ন। ঠিক সেই কারণেই চরম প্রতিকূল পরিকাঠামোর এই দেশ থেকে মেয়েরা যখন ক্রিকেট ফাইনালে রানার্স আপ হয়ে ফিরে আসে, তখন তাদের ‘ছেলেদের দলের মতো’ই ট্রিট না করে এই লড়াইকে বিশেষ উৎসাহ দেওয়ার আজও দরকার আছে। (চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy