Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
Editorial News

এ ভাবে রাষ্ট্রহিত হয় না, মোদী তা নিশ্চয়ই জানেন

তথাকথিত বিপন্নতা থেকে হিন্দুত্বকে রক্ষা করা আসল লক্ষ্য এই স্বঘোষিত হিন্দু-রক্ষা বাহিনীর, না কি লক্ষ্যটা আদ্যন্ত রাজনৈতিক, সে নিয়ে তর্ক প্রলম্বিত করা অবান্তর। কী ঘটছে, কেন ঘটছে, সে আমরা সকলেই অল্প-বিস্তর জানি।

অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৫ ডিসেম্বর ২০১৭ ০০:২৯
Share: Save:

এত দিন গো-রক্ষা বাহিনীর তাণ্ডবে সন্ত্রস্ত ছিল গোটা দেশ। এ বার আসরে এল হিন্দু-রক্ষা বাহিনী। তাণ্ডবের নতুন অছিলা খুঁজে নিয়ে মাঠে নামল তারা। যে ‘বিপদ’ থেকে হিন্দু সমাজকে রক্ষা করতে চায় এই বাহিনী, তথাকথিত সেই বিপদের বেশ জাঁদরেল একটা নামও দেওয়া হল— লাভ জিহাদ।

জাতীয় রাজধানীর উপকণ্ঠেই ভয়ঙ্কর ঘটনাটা ঘটিয়েছেন হিন্দুত্বের স্বঘোষিত রক্ষকরা। মুসলিম যুবক মনসুর হারাত খানের সঙ্গে হিন্দু নুপূর সিঙ্ঘলের বিয়েতে পাত্র-পাত্রী কোনও পক্ষেরই আপত্তি ছিল না। দুই পরিবারের উপস্থিতিতে বিশেষ বিবাহ আইনে বিয়ের নিবন্ধীকরণও সারা। কিন্তু যে দশ ‘লাভ জিহাদ’ নামক ‘সাংঘাতিক বিপদ’-এর সম্মুখীন, সে দেশে শুধু পাত্র আর পাত্রীর পরিবারের মতের ভিত্তিতে মুসলিম ছেলের সঙ্গে হিন্দু মেয়ের বিয়ে হয় নাকি! সঙ্ঘ পরিবারের মতটাই তো সবচেয়ে জরুরি! মনসুর আর নুপূরের পরিবার সম্ভবত ভুলে গিয়েছিল সে কথা। তাই বিবাহ বাসর তো বটেই, গাজিয়াবাদ শহরও তাণ্ডবের সাক্ষী হল।

তথাকথিত বিপন্নতা থেকে হিন্দুত্বকে রক্ষা করা আসল লক্ষ্য এই স্বঘোষিত হিন্দু-রক্ষা বাহিনীর, না কি লক্ষ্যটা আদ্যন্ত রাজনৈতিক, সে নিয়ে তর্ক প্রলম্বিত করা অবান্তর। কী ঘটছে, কেন ঘটছে, সে আমরা সকলেই অল্প-বিস্তর জানি। কেউ প্রতিবাদ করি, কেউ নিরপেক্ষতার ভঙ্গি দেখাই, কেউ সব জেনে-বুঝেও উল্টো সুরে গাইতে থাকি। এতে ‘লাভ জিহাদ’-এর কোনও ক্ষতি হওয়া সম্ভব কি না, বলা কঠিন। কিন্তু আমাদের দেশে যে অভ্যন্তরীণ সুষম সামাজিক কাঠামো রয়েছে, সেই কাঠামোটার যে খুব বড় ক্ষতি হয়ে যাবে, তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই।

সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন

এ হেন অনাকাঙ্খিত উপদ্রব কিন্তু খুব অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। একদল দুষ্কৃতী গোলমাল করবে, মসৃণ জীবনকে অমসৃণ করে তোলার চেষ্টা করবে, সামাজিক পরিসরে আবর্জনা ছড়ানোর চেষ্টা করবে— এতো যুগে যুগেই হয়ে আসছে। যুগে যুগে এদের প্রতিহতও করা হচ্ছে। এই সব অসামাজিক তত্ত্বের হাত থেকে দেশকে মুক্ত রাখা তো সফল প্রশাসকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য। কিন্তু আজকের ভারতে সেই কর্তব্যটা পালিত হচ্ছে কোথায়? সরকার বা প্রশাসন এই তাণ্ডবের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করছে কোথায়?

অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রধানমন্ত্রী মৌন অবলম্বন করছেন। সমালোচনা ঝড়ের রূপ নিতে শুরু করলে তিনি আলগোছে কিছু ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ কথাবার্তা বলছেন। কিন্তু ওইটুকুতেই শেষ। কঠোর বা দৃষ্টান্তমূলক কোনও পদক্ষেপ থেকে প্রশাসন আবশ্যিক ভাবে বিরত থাকছে। যাবতীয় অসামাজিক বা সাম্প্রদায়িক প্রবণতা বহাল থাকছে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িকতায় বা হিংসায় অভিযুক্তরা পুরস্কৃত হচ্ছেন, সরকারি চাকরি পর্যন্ত জুটে যাচ্ছে, এমন নিদর্শনও তৈরি হয়েছে।

আরও পড়ুন: আল্লা দয়াময়! কারও শাদি যেন এমন ভয়ঙ্কর না হয়

ভিন্‌ ধর্মে বিয়ে, হামলা চালাল বিজেপি কর্মী-সমর্থকরা!

ইতিহাসবিদ তনিকা সরকার ও সুমিত সরকার মোক্ষম কথাটি বলেছেন। ভারতের প্রশাসন আসলে ক্ষমাপ্রদানের ঢঙে এক নীতিভ্রষ্ট ঔদার্য দেখাচ্ছে বলে তাঁদের মত। গো-রক্ষা অভিযান হোক বা হিন্দু-রক্ষা, আসলে এ সবই সুপরিকল্পিত, অসহিষ্ণু এবং নিপীড়নসর্বস্ব অভিযান, মনে করছেন তাঁরা।

অভ্রান্ত বলেছেন তনিকা-সুমিত। প্রশাসন যে নীতিভ্রষ্ট ওদার্য দেখাচ্ছে এবং এই নীতিভ্রষ্টতা যে পুরোপুরি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, তা না বুঝলে বড় ভুল হয়ে যাবে।

বিজেপি-কে আরও একবার রাজধর্মের কথা মনে করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন পড়েছে। ২০০২ সালে যে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক হিংসা দেখেছিল গুজরাত, তার প্রেক্ষিতে দেশের তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী নিজের দলকে তথা গুজরাতের তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে রাজধর্মের কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন। আজ সেই নরেন্দ্র মোদী যখন সে দিনের বাজপেয়ীর আসনে অধিষ্ঠিত, তখন বিজেপি-কে তথা প্রশাসনকে রাজধর্মের প্রতি অবিচল থাকার কথা বলার জন্য অন্য কারও প্রয়োজন পড়বে না, এমনটা আশা করাই যেতে পারে।

হিন্দু গৌরবের যে সূত্রটি প্রয়োগ করে এগোতে চাইছে বিজেপি, সে সূত্র সর্বভারতীয় বিস্তারের জন্য বেশ কার্যকর। কিন্তু রাজনৈতিক বিস্তার আর দেশ চালানো আলাদা বিষয়। নির্বাচনে জিতে যখন ক্ষমতাসীন হয় কোনও দল, তখন তার দায়বদ্ধতা বর্তায় প্রত্যেক নাগরিকের প্রতি। তাই বিজেপির দায়বদ্ধতাও এখন আপামর ভারতবাসীর প্রতি, এ কথা ভুললে রাজধর্ম থেকে চ্যুত হওয়া হয়। আর রাজধর্মচ্যুত হয়ে রাষ্ট্রহিত সম্ভব নয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE