ওড়িশা এবং সীমানাবর্তী বাংলার এক বিস্তৃত অঞ্চলের লোকক্রীড়ার নাম হল পৈড়ান। এই এলাকাটি একসময়ে ‘বঙ্গোৎকল’ নামে পরিচিত ছিল। ঝাড়গ্রাম জেলার গোপীবল্লভপুর ১ ও ২, সাঁকরাইল, নয়াগ্রাম ব্লক ও নিম্নদাঁতন ওড়িশার ময়ূরভঞ্জ জেলা, ঝাড়খণ্ডের কিছুটা অংশ ‘বঙ্গোৎকল’এর মধ্যে পড়ত। পৈড়ান শুধু ক্রীড়া নয়, এই খেলায় আছে পরম্পরা, বংশরক্ষা, পূর্বপুরুষদের প্রতি শ্রদ্ধা, সংস্কার-বিশ্বাস, পুত্রসন্তান ও শস্য কামনার আকুতি।
পড়িয়া থেকে পৈড়ান শব্দটি এসেছে বলে অনেকের মত। সুবর্ণরৈখিক ভাষায় পড়িয়া মানে পতিত জমি। সেই জমিতে লোকক্রীড়ার সামগ্রী পোঁতা হয় বলে এমন নাম। আর মাটিতে গেড়ে দেওয়া বা পোঁতা হয় বলে একে পৈড়ানগাড়া বা পৈড়ানপোঁতাও বলা হয়। খেলার সময়ে হরিধ্বনির মধ্য দিয়ে হক ধরেন। হক মানে অধিকার বা পাওনা। এই অঞ্চলে তা মানত করা বোঝায়। যাঁরা হক ধরেন তাঁরা বংশানুক্রমিক ভাবেই সে কাজ করেন। গ্রামের নির্দিষ্ট কয়েকজন হক ধরা তথা মানতকারী বা যথার্থকারী থাকেন। পিতার পরে পুত্র হক ধরে থাকেন। যেমন বেলিয়াবাড়া এলাকার কালিঞ্জা গ্রামের ঝন্টু দণ্ডপাট। তিনি বললেন, ‘‘আগে আমার বাবা হক ধরতেন। এখন আমি ধরি।’’ কালিশঙ্কর দণ্ডপাটেরও একই কথা।’’ পাশাপাশি পৈড়ানকে কেন্দ্র করে পুরুষদের মধ্যে বাগড়িখেলা, মল্লযুদ্ধ ও লাঠিখেলার আয়োজন করা হয়। সেসব বড় নৈপুণ্যের খেলা। একই সঙ্গে সেসব ক্রীড়াচর্চা এবং ঐতিহ্য পালন।
কী ভাবে পৈড়ান তৈরি হয়? বেলিয়াবাড়ার কালিঞ্জা গ্রামের গৌর পাত্র জানালেন, শক্ত কাঙ্গুরা (পাটের মতো এক ধরনের গাছ) পাকিয়ে পাকিয়ে মোটা মোড়া বা ব্যাঠনা বা দড়ি তৈরি করা হয়। তার পর তা রাস্তার মাঝে একবেঁয়ু (দু’হাত বা ৬ ফুট বোঝায়)। সুবর্ণরৈখিক ভাষায় ডাঁয়া বা বেঁয়ুর অর্থ হাত। সোজা ও আড়াআড়ি একবেঁয়ু গর্ত করে লোহার শাবল দিয়ে কাঙ্গুরার মোড়াটি ঘরাগিঁট দিয়ে শক্ত করে বেঁধে দেওয়া হয়। যাতে খুলে না যায় বা ছিঁড়ে না যায়। ঘরাগিঁট একধরনের বাঁধার পদ্ধতি। অনেকে এর সঙ্গে সাতচাড়া বা সাত পিট্টুখেলার মিল খুজে পান। আবার পৈড়ান খোঁড়ার পদ্ধতির সঙ্গে নিজের জমির সীমা সম্পর্কিত সচেতনতা খুঁজে পাওয়া যায়। পৈড়ান খোঁড়ার পর ভাল করে খোঁড়া মাটিগুলো বিছিয়ে দেওয়া হয়। তার পর জায়গাটি গোবরজল দিয়ে নিকানো হয়। এর পর আতপচাল বাটা, মেথি ও হলুদ দিয়ে গঁধুলা তৈরি করে মাটির উপরে দিয়ে শুদ্ধ করে নেওয়া হয়। এর পর আতপচাল, হরিতকি, দূর্বাঘাস, সিঁদুর, ফুল দিয়ে পুজো করা হয়। প্রসাদ দেওয়া হয় চিড়ে ও গুড়। পয়াপিণ্ড বা গুড়পিঠে বা আসকা পিঠেও খাওয়ানো হয়। কার্তিক মাসের ভূত অমাবস্যার দিনে কাকভোরে পৈড়ান গাড়তে হয়। যাতে কেউ দেখতে না পান।