Advertisement
১১ মে ২০২৪
ভোট মানে এখন ‘কৌশল’

মানুষের নেতা-চয়নের সীমিত অধিকারও কেড়ে নিচ্ছে রাজনীতি

“সকাল সকাল ভোট দিন, নিজের ভোট নিজে দিন”-এর মতো সহজ কাজকেও স্লোগান বানিয়ে রাজনৈতিক দলগুলিকে আমাদের কান অবধি পৌঁছে দিতে হচ্ছে, এ শোক আমাদের সবার।

উর্বা চৌধুরী
শেষ আপডেট: ১৬ জুলাই ২০১৯ ০০:৫৪
Share: Save:

রাজনৈতিক দলের সংখ্যাবহুল আবহে আমাদের জন্ম ও বেড়ে ওঠা। দলগুলো যেমনই হোক, এদের বাদ দিয়েও ভারতীয় গণতন্ত্র হয় না। আমাদের দেশের মতো বিশাল দেশে গণতন্ত্র বহাল রাখতে যে বন্দোবস্ত পঞ্চাশের দশকের গোড়া থেকে চলে আসছে, তার নাম নির্বাচন। একে ‘গণতন্ত্রের উৎসব’ নামে আমরা ডেকেছি। নির্বাচনকে শিরোধার্য করে আমরা ভেবেছি, মতদানের মতো উজ্জ্বল গণতান্ত্রিক অধিকার চর্চা করা হল। কিন্তু হল কি? আমরা কি পারলাম আমাদের উচিত-অনুচিত অনুভূতিকে, ভাল-মন্দ বোধকে, এবং নীতি-দুর্নীতির মূল্যায়নকে আমাদেরই দেওয়া ভোটের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ করতে?

“সকাল সকাল ভোট দিন, নিজের ভোট নিজে দিন”-এর মতো সহজ কাজকেও স্লোগান বানিয়ে রাজনৈতিক দলগুলিকে আমাদের কান অবধি পৌঁছে দিতে হচ্ছে, এ শোক আমাদের সবার। কিন্তু তা বাদেও যে আর একটি বিচিত্র ঘটনা ঘটছে আমাদের সঙ্গে, সে খেয়াল আমরা কখনও কখনও বোধ হয় রাখছি না! আমরা টেরই পাচ্ছি না, যে রাজনৈতিক দলগুলিকে আমরা নির্বাচনে অংশ নিতে দেখছি, তার মধ্যে অনেক ক’টিই ক্রমশ আমাদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলার রীতি ত্যাগ করে চলেছে, স্বাভাবিক কথা-র জায়গা নিচ্ছে কৃত্রিম আড়ম্বর। নীতির জায়গা নিচ্ছে কৌশল। আর রাজনীতি ক্ষেত্রে দ্রুত উঠে এসেছে এক নতুন পেশা, যার নাম ইলেকশন স্ট্র্যাটেজিস্ট, নির্বাচন-কৌশলী, ভোট-কারিগর।

ছোটবেলা থেকেই শুনে এসেছি, রাজনৈতিক দল তৈরি হয় এমন কিছু এককাট্টা হওয়া মানুষকে নিয়ে, যাঁরা সব মানুষের কথা বলে উঠতে পারেন। এই রাজনৈতিক দলগুলি যখন নির্বাচনে অংশ নেয় তখন ধরে নেওয়া যেতে পারে, সব মানুষের বারো মাসের পাওয়া-না পাওয়া, অভাব-অভিযোগ, দাবি-দরকারের কথা শুনে তা এমন কিছু উপায় করবে যাতে মানুষের দুর্দশা ঘোচে। দুর্দশা ঘোচানোর প্রক্রিয়াতেই তৈরি হয় বাম-দক্ষিণ, নানা পন্থা, নানা দল, তাদের ইস্তাহার। অথচ, গত বেশ কিছু বছর ধরে নজরে আসছে, ভারতের বহু নামজাদা রাজনৈতিক দল নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে গিয়ে বুদ্ধিবৈকল্যের শিকার। বুদ্ধির চাহিদার জোগান দিতে, বোধ হয়, ‘ভোট-কৌশলী’র আগমন।

কী কাজ এই কৌশলীর? নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দলগুলির ভাবমূর্তিকে তিনি এমন করে গড়বেন, যাতে তা ভোটারের মনোগ্রাহী হয়। রাজনৈতিক নেতাদের চলনবলনের নিয়মে এমন করে বাঁধবেন, যাতে তাঁরা ভোটারের মস্তিষ্কে নিজেদের গেঁথে দিতে পারেন। ভারতের মতো হাজার বঞ্চনার দেশে, বিকট ধনী উদ্যোগপতি নাগরিকটির একটি ভোট আর ক্ষুধার্ত নাগরিকটিরও একটি ভোট-এর দেশে, অপুষ্টিতে কঁকিয়ে ওঠা নাগরিকের দেশে, অক্ষরজ্ঞানহীনতায় বিপর্যস্ত নাগরিকের দেশে, নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দল আর জনসাধারণ, বা জনপ্রতিনিধি আর জনগণের মধ্যে সেতু বাঁধবেন এই ‘কৌশলী’। তার মানে কি এই নয় যে, রাজনৈতিক দলগুলি মানুষের সামনে দাঁড়ানোর সাহস হারিয়ে ফেলেছে? অবাক কথা নয়, সাহস না হওয়ার মতো ঘটনাই তো ঘটে চলেছে অবিরাম। মানুষের অধিকার লঙ্ঘন আর দৃষ্টান্তে সীমাবদ্ধ নেই— সেটাই এখন সমগ্র। বৈষম্য আর বিভেদের রাজনীতির প্রচারক রাজনৈতিক দলগুলির সত্যিই তো ‘মেক-আপ’ ছাড়া মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে দু’কথা বলার সাহস হওয়ার কথা নয়। সম্ভবত সে জন্যই জনসংযোগের এমন ‘তরিকা’, রাজনীতির মূল উদ্দেশ্যের বিপরীতে যার অবস্থান।

সংযোগসাধক এজেন্সির এমন বিপজ্জনক নমুনা আমরা দেখছি বেশ কিছু বছর ধরেই। হালে বিষয়টি যেন আরও প্রকট হয়ে উঠল। ভারতের ভিন্ন ভিন্ন প্রদেশের ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক দল ভোটে জিতবার জন্য নিয়োগ করছে ভোট-কারিগর। এ বিষয়ে বিজেপি অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তারা গড়ে তুলেছে ‘ইন-হাউস’ ব্যবস্থা, আবার ভাড়ার ব্যবস্থায়ও অন্য দলগুলোর পক্ষে বিজেপিকে ছোঁয়া অসম্ভব। দেশের নানা জায়গায় তুলনায় ছোট দলগুলি ভাড়া নিয়ে কাজ চালাচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে রীতি-রেওয়াজ চিরকালই আলাদা। কিন্তু, সাম্প্রতিক গতি-প্রকৃতি ভিন্নতর, এ-রাজ্য ক্রমশ সর্বভারতে বিলীন হওয়ার নেশায় ধাবমান। অতএব, এখানেও চাই ভোট-কারিগর। তৃণমূল দলও সদ্য এক কৌশলী সংস্থার সঙ্গে নিজেকে চুক্তিতে বাঁধল। রাজনৈতিক মতামত গড়ে তোলার এমন নীতি-বর্জিত কৌশলী পদ্ধতি মানুষের স্বাধিকারের পক্ষে অসম্মানের। কৌশলে মানুষের মতামতগুলোকে গড়েপিটে নেওয়া হবে, জনতাকে নাদান প্রমাণিত করে।

সমস্যার মূল ক্রমশ গভীরে যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, আলাদা আলাদা দলের ‘ভোটকৌশলী’ লোকটি অভিন্ন। এক জন ব্যক্তিই একাধিক, এমনকি প্রতিদ্বন্দ্বী, রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী কৌশল ছকে দিচ্ছেন। যেমন, প্রশান্ত কিশোর। কংগ্রেস, বিজেপি, ওয়াইএসআর কংগ্রেস, জনতা (ইউনাইটেড) দলগুলি পরস্পরের ঘোর প্রতিদ্বন্দ্বী, অথচ তাদের ছক কষে দিচ্ছেন একই লোক। এই আশ্চর্য বাস্তবতার ভুঁই ফুঁড়ে কোন সত্য বার হয়? তার মানে কি এই নানা রঙের রাজনৈতিক দলগুলির মতাদর্শের কোনও বিশেষত্ব নেই, তেমন কোনও পার্থক্যই নেই যা কিনা একটির থেকে অপরটিকে পৃথক করতে সাহায্য করে? না কি এদের কোনও মতাদর্শই নেই?

বিস্ময় হয়, সম্পূর্ণ মতাদর্শশূন্য এমন প্রচারের খপ্পরে পড়ে আমরাও মনে করছি না তো যে, রাজনীতির সঙ্গে নীতিনিষ্ঠার কণামাত্র যোগ রাখারও প্রয়োজন নেই? রাজনীতি থেকে নৈতিকতাকে, নীতিনিষ্ঠাকে ছিন্ন করার প্রবণতা বহু দিন ধরেই চলছে, যেন রাজনীতি এমন একটি ক্ষেত্র যেখানে নীতি বা দুর্নীতির প্রশ্নে সব রকমের জোড়াতালি দেওয়া সম্ভব। রাজনীতিতে সব চলে— এমনটা ভাবিয়ে তুলতে তুলতে আমরাও কি শেষে এটাই মেনে নিলাম? নব্বইয়ের দশকে ঢুকে পড়া নানা ব্র্যান্ডের জাঙ্ক ফুডের মধ্যে আলু চিপস-ও একটি। প্যাকেটে বাড়তি হাওয়া ভরে টাঙানো থাকে দেশময়। ভিন্ন ভিন্ন ব্র্যান্ডের আলাদা আলাদা স্বাদ, তবু সবেতেই হাওয়া ভরা। এমন হাওয়া যার সঙ্গে পুষ্টি বা স্বাদের কোনও সম্পর্ক নেই, সম্পর্ক রয়েছে কেবল উপস্থাপনার। সম্পর্ক রয়েছে, হাওয়া ভরে প্যাকেটের ভিতরের উপজীব্যটিকে ‘যা সত্য নয়, তাও সত্য’ হিসাবে উপস্থাপন করার। নির্বাচনী কৌশল বলে যেটাকে চালানো হচ্ছে সেটাও কি হাওয়া ছাড়া অন্য কিছু? ‘যা সত্য নয়, তাও সত্য’ হিসাবে প্রমাণ করা ছাড়া তার আর কাজ কী?

‘সমাজ’ বলতেই আমাদের চোখের সামনে কিছু দৃশ্য ভেসে ওঠে। অনেকগুলি মানুষ এক জায়গায় বাসা বেঁধে আছেন। অবসরে তাঁরা রাস্তার মোড়ে, চা দোকানে, বটের ছায়ায়, মাঠের ধারে, ক্লাবঘরে, লাল সিমেন্টের রোয়াকে, মাঠের আলে, বা পুকুরঘাটে জড়ো হচ্ছেন, কথা বলছেন, হাসি ঠাট্টায় জড়াচ্ছেন, ভেঙে পড়া কাউকে মনোবল জোগাচ্ছেন, তর্কে ফুটে উঠছেন, আরও কত কী! এই সব কিছুর মধ্যে দিয়ে মানুষের চোখে পড়ার মতো যে বৈশিষ্ট্যটি বার বার স্পষ্ট হয়ে ওঠে, তা হল, মানুষ যেন তেন প্রকারে নিজের কথা বলতে চান, অপরকে সে কথা সরাসরি শোনাতে চান, আবার অপরের কথা সরাসরি শুনতেও চান। এ ধর্ম যেন তাঁর অবিচ্ছেদ্য ধর্ম।

মানুষে মানুষে যোগাযোগের এই মৃত্যু-অনিচ্ছুক ইচ্ছাই তো আসলে টিকিয়ে রেখেছে গোটা সমাজটাকে। চমৎকার ভাবে এক মানুষ আর এক মানুষকে নিত্যদিন বাঁধছেন। তাঁদের পরস্পরের কথা শোনা বা বোঝার জন্য শব্দগুলিকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তোলার মতো কোনও যন্ত্র নেই। নীতি-জীবন্ত মানুষ ছাড়া এমন কোনও মাধ্যমই নেই, যা মানুষের সঙ্গে মানুষের কথার দেওয়া-নেওয়া করতে পারে। বানপ্রস্থে যাওয়ার প্রাক্কালে রাজা ধৃতরাষ্ট্র প্রজাদের বলছেন, যুধিষ্ঠিরকে তোমাদের কাছে রেখে গেলাম। তোমরা যদি তাকে পথ দেখাও, তা হলে সে নিশ্চয়ই ভাল ভাবে রাজ্য পরিচালনা করতে পারবে। বক্তব্য পরিষ্কার, রাজার সঙ্গে প্রজার সম্পর্ক হবে স্ব-বুদ্ধি আধারিত বাক্যালাপের।

অসহায় লাগে। রাজাকে পথ দেখানোর যে সীমিত পরিসরটুকু আধুনিক ভারতের প্রজাকুলের ছিল, সেটাকে গ্রাস করছে কৃত্রিমতা। জনসাধারণের প্রতি রাজনৈতিক দলের এমন যত্নহীনতা, ধূর্ত নজর শেষ পর্যন্ত দেশকে কোথায় নিয়ে যাবে? দেশ মানে তো ভূগোল নয়, দেশ মানে মানুষ। ‘কৌশল’-এর নাম করে তার দেশনেতা চয়নের সীমিত অধিকারটাকেও কেড়ে নেওয়া হবে?

প্রতীচী ইনস্টিটিউটে কর্মরত, মতামত ব্যক্তিগত

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Politics Election
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE