পায়ের তলার মাটি সরে যাচ্ছে? কলকাতাতেও কি কাঠমান্ডুর জ্বর আসছে? কাঁপতে কাঁপতে এ শহর কি ভেঙে পড়বে তাসের ঘরের মতো? লম্বা সাপের মতো উড়ালপুলগুলো নুনে কাটা জোঁকের টুকরোসম গুটিয়ে যাবে? শহরের রাস্তাগুলোর সঙ্গে শহিদ মিনারও কি পাতালপ্রবেশের প্রস্তুতি নিচ্ছে? হুগলির জলোচ্ছ্বাসের ধাক্কায় বেসামাল হতে চলেছে রাইটার্স থেকে নবান্ন, ভিক্টোরিয়া থেকে জাদুঘর? এমন দুঃস্বপ্নে ঘেমে-নেয়ে উঠেছে শহরের মানুষ।
১৯৮০ থেকে ২০১০, এই তিন দশকে দুনিয়া জুড়ে উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে ভূমিকম্পের সংখ্যা ও ভূমিকম্পপীড়িত মানুষের সংখ্যা। এই সময়ে পৃথিবীতে ৭৩৮টি ভূমিকম্পের প্রায় ৪০ শতাংশ ঘটেছে গত শতকের শেষ দশকে। আর প্রতিটি ভূমিকম্পে গড়ে ২ লক্ষ মানুষ পীড়িত, ৫০ হাজার মানুষ গৃহচ্যুত, ৬০০-এরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। নগরায়ণের প্রসারে জনঘনত্ব বৃদ্ধির কারণে ভূমিকম্পপীড়িত মানুষের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই কলকাতা সম্পর্কে এখন থেকেই বিশেষ সতর্কতা ও পরিকল্পনা গ্রহণ জরুরি। মনে রাখতে হবে, ভূকম্পের প্রেক্ষিতে কলকাতার ঝুঁকি মাঝারি থেকে চড়া।
কলকাতা শহরে গত তিন দশকে সবুজ নষ্ট হয়েছে ২৫ শতাংশ আর সেই জায়গায় তৈরি হয়েছে কংক্রিটের জঙ্গল। পুরনো শহর হওয়ার কারণে এখানে রাস্তার পরিমাণ মোট এলাকার মাত্র ৬.৫ শতাংশ। তাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে হাজার হাজার অপরিকল্পিত বাড়ি, ভূমিকম্পে যেগুলি মাথাব্যথার সবচেয়ে বড় কারণ হতে পারে। সম্প্রতি প্রকাশিত এক বিশ্বব্যাংক সমীক্ষার রিপোর্ট অনুযায়ী ভূমিকম্পে মৃত্যুর ভয়াবহতার নিরিখে উপরের দিকে থাকা ৭০ শতাংশ দেশই নিম্ন ও নিম্ন-মধ্য আয়ের। আর ঠিক সেই কারণেই ভূমিকম্পে পীড়িত সর্বাধিক মানুষের বাস আমাদের মতো দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিতে। নিম্ন আয়ের দেশগুলির মানুষের জীবনযাত্রার মান উচ্চ আয়ের তুলনায় অনেকটাই খাটো। সেখানে বাড়ির গঠন-বৈশিষ্ট্য, নির্মাণ সামগ্রী ও নির্মাণ, সবই তুলনায় শস্তা ও ঝুঁকিবহুল। ফলে বাড়ি ভেঙে পড়া ও তজ্জনিত মৃত্যুর মাত্রা স্বাভাবিক ভাবেই বেশি।
এই পরিপ্রেক্ষিতে কলকাতার ওয়ার্ড-ভিত্তিক বাড়ির সংখ্যা, বাড়ির ঘনত্ব, বাড়ির বয়স, দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-উচ্চতার পরিসংখ্যানের পাশাপাশি বাড়িগুলির নির্মাণ-বৈশিষ্ট্য ও নির্মাণ সামগ্রীর তথ্যভাণ্ডার তৈরি করা জরুরি। এই তথ্যের ভিত্তিতে ভূমিকম্পের ঝুঁকিপ্রবণতা অনুযায়ী তৈরি মানচিত্র বিচার করেই নতুন বাড়ির অনুমতি দেওয়া বা পুরনো বাড়ির পুনরুজ্জীবনের প্রযুক্তিনির্ভর পথ প্রদর্শন পুরসভার জরুরি দায়িত্ব। পাশাপাশি, সরকারেরও জরুরি দায়িত্ব, বাড়িওয়ালা-ভাড়াটের বিবাদ মেটানোর নামে শহরের ঘিঞ্জি এলাকায় বাড়তি ফ্লোর-এরিয়া রেশিয়ো (এফএআর) মঞ্জুর করে সরু লম্বা বাড়ি স্বল্প পরিসরে তৈরি করার যে নীতি বলবৎ হয়েছে, তার পুনর্বিবেচনা। না হলে, সাময়িক লাভের ঝুঁকিতে পোঁতা বিষবৃক্ষের বীজ শহরের বুকে ডেকে আনবে ভবিষ্যৎ বিপর্যয়। ভূমিকম্পের নিরিখে শহরের বাড়ির পাশাপাশি পরিকাঠামোর স্থায়িত্ব নিয়েও আগাম পরিকল্পনা জরুরি।
জরুরি ভূমিকম্পের বিপদকে মাথায় রেখে বিপর্যয় মোকাবিলার প্রস্তুতিও খুব জরুরি। এই প্রস্তুতির অনেকগুলো সুস্পষ্ট নিয়ম আছে। সেগুলো অনুশীলন করা দরকার। তার চর্চা স্কুল স্তর থেকে শুরু হলে সমাজে সার্বিক সচেতনতা গড়ে তোলাটা খানিকটা সহজ হয়।
শেষে বলি, ভূমিকম্পের পর সেই অঞ্চলের চিকিৎসক ও চিকিৎসা কেন্দ্রের সংখ্যার ওপরও অনেকটা নির্ভর করে মানুষের মৃত্যুর হারের ওঠা-নামা। এ রাজ্যে সেই সংখ্যাটা খুব কম। এ শহরও তার ব্যতিক্রম নয়। ভূমিকম্প সামলাতে রাজ্যের মানুষ শাঁখ বাজাবেন, এতে আর বিস্ময় কী?
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy