শবরীমালা মন্দিরে দশ থেকে পঞ্চাশ বছর বয়সি মহিলাদের প্রবেশ নিষেধ ছিল। মন্দিরের পরম্পরা। একে নারীবিরোধী মনে করে সুপ্রিম কোর্ট রায় দিল—মন্দিরে সব বয়সের মহিলাই ঢুকতে পারবেন। এর প্রতিবাদে কেউ না কেউ রাস্তায় নামবে, প্রত্যাশিতই ছিল। কিন্তু কারা? প্রতিবাদ মিছিলের মুখ দেখে তো তাজ্জব দুনিয়া। প্রতিবাদীরা সবাই যে মহিলা। নেতৃত্বে বিজেপির মহিলা মোর্চা। তাঁদের দাবি কী? তাঁরা কি তবে নারী হিসেবে দাবি করছেন, ১) আমি অপবিত্র, ২) আমাকে মন্দিরে ঢুকতে দেওয়া চলবে না, ৩) আমি দেবতার পক্ষে ক্ষতিকর। তাঁরা সক্রোধ হুমকি দিচ্ছেন, আমাকে মন্দিরে ঢোকার সমানাধিকার দিলে আমি কিন্তু ছেড়ে কথা বলব না। তাঁদের হাতে ঢাউস ব্যানার— ‘সেভ শবরীমালা’। শবরীমালাকে বাঁচাও। বাঁচাও কাদের হাত থেকে? যাঁরা ব্যানারটি বইছেন তাঁদেরই হাত থেকে!
পরম্পরামতে, শবরীমালার দেবতা ব্রহ্মচর্যের শপথ নিয়েছেন। তাই ঋতুমতী যৌনকর্মে সক্ষম মহিলার সান্নিধ্যে তাঁর ব্রত ভঙ্গ হতে পারে। এই পরম্পরার কড়াকড়ি কি বরাবর ছিল? না। ১৯৪০ সালে, এখন যে রাজপরিবার প্রতিবাদে সরব, তাঁদেরই রাজকন্যা মন্দিরে প্রবেশ করেছিলেন। কড়াকড়ির শুরু ১৯৯১ সালে, কেরল হাইকোর্টের রায়ে। সুপ্রিম কোর্টে সেই রায়ই খারিজ হল।
তরুণী যুবতীরা দেবতার কাছাকাছি গেলে তাঁর ব্রত যদি ভঙ্গ হয়, হোক না। দেবতা জাগ্রত হবেন অন্তত। আমরা তো জাগ্রত দেবতাই চাই। ভাবনা হয়, দেবতার অবস্থাই যদি এই হয়, সাধারণ মানুষের, মানে সাধারণ পুরুষমানুষের কী হবে! সেই দেশে সেলেব্রিটি মহিলারাও তো নিরাপদ থাকবেন না! এক দিন তাঁদেরও ‘মি-টু মি-টু’ করে প্রতিবাদ আন্দোলনে নামতে হবে।
কোথাও পড়েছিলাম, ব্রহ্মচর্যের আসল পরীক্ষা বেশ্যালয়েই। একাকী অরণ্যের তপোবনে তো ব্রহ্মচারী না হয়ে উপায় নেই। দেবতা কি এইটুকু সংযমও রাখতে পারবেন না যে কাছাকাছি মেয়ে দেখলেই…। প্রশ্ন এমনও উঠছে, দেবতা যে সমকামী নন, তার নিশ্চয়তা কী। তবে তো পুরুষরাও সমান বিপজ্জনক। উত্তরে ব্রহ্মচর্যের রক্ষীরা বলছেন, তেমন তো কোথাও বলা নেই, কোনও গ্রন্থেই।
সমস্যাটা আসলে দেবতার নয়। তিনি আর সব দেবতার মতোই নির্বিকার। সমস্যা তাঁর অনুগামীদের। যাঁরা পুরুষ হয়ে জন্মে জগতের মাথা কিনে নিয়েছেন, তাঁদের। যাঁরা শুধু দেবতাকেই নির্মাণ করেননি, নির্মাণ করেছেন দেবতার মহিলা অনুগামীদেরও। না হলে এক জন মুক্তমনা নারী কি ওই মিছিলে শামিল হতে পারেন? পারেন, একমাত্র যদি সেই নারীর অন্তর্জগতের দখল নিয়ে থাকে বিকৃত পুরুষকার! যে নারী নিজেই মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন, শৈশবে পিতা, যৌবনে স্বামী আর বার্ধক্যে তিনি পুত্রের আশ্রিতা। কারণ তিনি জন্ম-অনিকেত।
আদর্শ ভারতীয় নারীর এটাই উৎকৃষ্ট নমুনা কি না জানি না। কিন্তু এমনটা হয়ে যদি কেউ গর্বিত হন, আন্দোলনে পথে নামেন, সে বড় দুর্দিনের সূচক বলে মনে হয়। সমগ্র মানবসভ্যতার পক্ষেই তা অশুভ।
এ এক ধরনের আত্মিক দার্শনিক শোষণ। এক ধরনের যৌন হেনস্থা যা ভুক্তভোগী বুঝতেই পারেন না। দেশের ঘরে ঘরে এমন শোষণের উপযোগী নারী তৈরি হন যাঁরা শোষিত হওয়ার তাড়নায় ব্যাকুল হতে হতেই বড় হন। বুড়ো হন। মরে যান। মরার আগে আরও অনেককে এমন হওয়ার প্রেরণা জুগিয়ে যান। শবরীমালা আর শুধু একটা মন্দির নয়— ভারতীয় নারীর কাছে তা একটা মধ্যবিন্দু। যার দু’দিকেই রাস্তা খোলা। কোন রাস্তা নেওয়া হবে সেটা তাকেই ঠিক করতে হবে।
সমস্যা হল, বিষয়টা আরও জটিল আকার নিচ্ছে, কারণ তার ভোটাঙ্ক চড়চড়িয়ে বাড়ছে। বেড়েই চলেছে। এক দিনেই ছয় রাজ্যে দু’শো বত্রিশটা প্রতিবাদ সভা হয়েছে বলে খবর। অংশ নিয়েছেন সাড়ে পাঁচ কোটি ভোটার। এমতাবস্থায় ভোট-পার্টিদের যা করার কথা তাই করছে। বিজেপি ও কংগ্রেস উভয়েই সুপ্রিম কোর্টের রায়কে প্রথমে স্বাগত সমর্থন জানিয়ে এখন অবস্থান পাল্টাচ্ছে। প্রতিবাদ মিছিলে ভিড়ের সমাগম দেখে তাদের খোলাখুলি সমর্থন জানাচ্ছে। বিজেপির মহিলা মোর্চা তো নেতৃত্বভারই নিয়ে নিয়েছে আন্দোলনের। এমনকি কেরলের বাম সরকার প্রথমে রায়ের পক্ষে থাকলেও পরে আলোচনার জন্য মন্দিরের তন্ত্রী পুরোহিত ও পান্ডলম রাজপরিবারকে ডেকেছে। যদিও সে ডাক তাঁরা প্রত্যাখ্যান করেছেন।
সব মিলিয়ে এক বিভ্রান্তিকর ডামাডোলের কলহট্টে নারীর কণ্ঠ আজ আর আলাদা করে চেনা যাচ্ছে না। সবাইকেই মনে হচ্ছে, তারা সব পুরুষ অথবা পুরুষকণ্ঠী। ভীষণ রকম আত্মঘাতী পুরুষকণ্ঠী। জগতের সব চেয়ে অসংগঠিত শোষিত শ্রেণি বোধ হয় নারী। শোষণের দর্শন এমন গভীরে প্রোথিত যে, শোষণকে আর শোষণ মনে হয় না। মনে হয় জীবনধারণের একটা ধরন। আবহমানতার গর্বময় ঐতিহ্য। সনাতন এক পরম্পরা।
নারী কি তবে সরু শেকলে বাঁধা মহাবলী সেই হাতির মতো? যে চাইলেই শেকল ছিন্ন করতে পারে, কিন্তু তা করার কথা কখনও ভাবে না? কারণ তাকে ‘শিক্ষিত’ করা হয়েছে তেমন করেই, তার নারীত্বকে প্রতিস্থাপিত করা হয়েছে বিকৃত বিকট পুরুষকার দিয়ে, তার অজান্তেই! আমার মা নেই। থাকলে জিজ্ঞেস করতাম: মা গো, কবে জানবে সে কথা?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy