Advertisement
০৪ মে ২০২৪
প্রবন্ধ

‘তখনই ঠিক করে ফেলি, স্কুলের ঘেরাটোপে আর থাকব না’

কলকাতা ও তার মা টেরিজা। মাদারের প্রয়াণের পরে তাঁর জীবন নিয়ে লিখেছিলেন হীরক বন্দ্যোপাধ্যায় ও নির্মাল্য মুখোপাধ্যায়। সে রিপোর্টের নির্বাচিত কিছু অংশ। দুপুর আন্দাজ ১২টা। একটা টানা-রিকশা এসে দাঁড়াল ১৪ নম্বর ক্রিক লেনের তিনতলা বাড়িটার লোহার গেটের সামনে। তারিখটা ঠিক মনে নেই গৃহকর্ত্রী অ্যাগনেস গোমসের। মাসও নয়। তবে ১৯৪৮-এর মাঝামাঝি কোনও একটা দিনের সেই দুপুরের কথা ছবির মতো মনে আছে তাঁর।

অভয়। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরে কলকাতার পথে মাদার টেরিজা। ১০ ডিসেম্বর, ১৯৯২

অভয়। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরে কলকাতার পথে মাদার টেরিজা। ১০ ডিসেম্বর, ১৯৯২

শেষ আপডেট: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০০:১৫
Share: Save:

• দুপুর আন্দাজ ১২টা। একটা টানা-রিকশা এসে দাঁড়াল ১৪ নম্বর ক্রিক লেনের তিনতলা বাড়িটার লোহার গেটের সামনে। তারিখটা ঠিক মনে নেই গৃহকর্ত্রী অ্যাগনেস গোমসের। মাসও নয়। তবে ১৯৪৮-এর মাঝামাঝি কোনও একটা দিনের সেই দুপুরের কথা ছবির মতো মনে আছে তাঁর।

রিকশায় বসে নীল পাড় সাদা শাড়ি পরা মধ্য তিরিশের এক মহিলা। মাথায় আঁটোসাঁটো ঘোমটা। উচ্চতা আন্দাজ ৫ ফুট। দোহারা গড়ন। হাতে একটা টিনের বাক্স, কাঠের হাতলওয়ালা কালো কাপড়ের ব্যাগ। পায়ের কাছে রাখা চিনেমাটির হলদেটে বয়াম। অ্যাগনেস গোমস পরে জেনেছিলেন, তাতে নুন থাকে।...

লোরেটো স্কুলের নিশ্চিন্ত বাসস্থান ছেড়ে হন্যে হয়ে তখন কলকাতা শহরের কোথাও একটা আশ্রয় খুঁজছিলেন মাদার টেরিজা। কিন্তু ঠাঁই হয়নি কোথাও। তাই বাধ্য হয়ে মাথা গুঁজেছিলেন ২ নম্বর লোয়ার সার্কুলার রোডে, সেন্ট জোসেফ স্কুলের সিঁড়ির তলায়। সেই অন্ধকার কুঠুরি থেকে মুক্তি পেয়ে মাদার ক্রিক লেনের বাড়ির তিনতলার প্রশস্ত ঘরে আসতে পেরেছিলেন যাঁর জন্য, তাঁর নাম ফাদার ভান এক্সহেম— মাদারের ‘ধর্মগুরু’।...

• যাত্রা কিন্তু শুরু হয়েছিল আরও কুড়ি বছর আগে। আয়ারল্যান্ডের ডাবলিন বন্দর থেকে। সাত-সাতটা সপ্তাহ জাহাজে কাটিয়ে ১৮ বছরের তরুণী অ্যাগনেস (গোনশা বোজাশিউ) ১৯২৮-এর শেষে এক শীতের দুপুরে নামলেন খিদিরপুর ডকে। পরনে শাড়ির বদলে কালো গাউন, গলায় ক্রস, মাথায় বাঁধা কালো রুমাল, হাতে কিন্তু সেই কালো কাপড়ের ব্যাগ আর টিনের বাক্স। ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে সোজা চলে গেলেন মিডলটন রো-র লোরেটো সিস্টারদের ‘নানারি’তে সন্ন্যাসিনী হওয়ার বাসনায় হাজির হলেন নতুন এক ‘ক্যান্ডিডেট’। কলকাতার সেই ‘নানারি’ তখন নিয়ন্ত্রিত হত আয়ারল্যান্ডের লোরেটো স্কুল থেকে।...

• ১৯২৮-এর ডিসেম্বরে কলকাতায় পৌঁছে অ্যাগনেস (গোনশা বোজাশিউ) দার্জিলিঙে পাড়ি দিয়েছিলেন। ১৯৩১-এ কলকাতায় ফিরে এলেন। তত দিনে শিখে নিয়েছেন কাজ চালানোর মতো বাংলা। পড়াতে শুরু করলেন সেন্ট মেরিজ লোরেটো কনভেন্টের বাংলা বিভাগে। ১৯৩৭-এ স্কুলের প্রিন্সিপালও হলেন। তবু মন বসছিল না।

তত দিনে শুরু হয়ে গিয়েছে মন্বন্তর। এন্টালি কনভেন্টের দোতলার ঘরের জানলা দিয়ে পাশেই মতিঝিল বস্তির অভুক্ত, শীর্ণকায় মানুষদের গোঙানির আওয়াজ আরও অস্থির, আরও উদ্বেল করে তুলছিল মাদারকে। সেন্ট লরেন্স স্কুলের ফাদার বুশেকে অনেক দিন পরে মাদার বলেছিলেন, ‘‘তখনই ঠিক করে ফেলি, স্কুলের ঘেরাটোপে আর থাকব না।’’...

• (১৯৪৮ সালে) রান্নার লোক ‘চারুর মা’কে সঙ্গে নিয়ে সিস্টার টেরিজা এসে উঠলেন ১৪ নম্বর ক্রিক লেনের বাড়ির তিন তলার বড় ঘরটায়। মাটিতে শোয়া পছন্দ করতেন না, তাই ঘণ্টা কয়েকের মধ্যেই আনা হল লোহার খাট। সঙ্গে যৎসামান্য বিছানা। কাঠের চেয়ার-টেবিল দিল গোমস পরিবার।

ঘরটা বেশ প্রশস্ত। তাই কড়ি-বরগা থেকে মাদুর ঝুলিয়ে ‘পার্টিশান’ করে নিলেন মাদার। এক দিকে প্রার্থনা, অন্য দিকে থাকা-খাওয়া। কিছু দিনের মধ্যেই সঙ্গিনী জুটল সাত-আট জন। লাগোয়া সব ঘর। বলতে গেলে পুরো তিন তলাটাই হয়ে উঠল মাদারের সংসার।... একটা সময় ছিল, যখন প্রতিদিন রাত্রে মাদার এক তলা থেকে তিন তলার ছাদ পর্যন্ত গোটা কাঠের সিঁড়িটি নিজের হাতে মুছতেন। কাপড় কাচতেন নিজের হাতে। অ্যাগনেস গোমস জানালেন, ‘‘এক বার আমাদের বাড়িতে জলের খুব সমস্যা হয়েছিল। মাদার বালতিতে জল তুলেছিলেন নিজের হাতে।’’...

• ১৯৪৮-এর ২০ ডিসেম্বরের এক দুপুরে। ট্যাংরার মতিঝিল বস্তিতে... মাদার এসে প্রথমেই বললেন, ‘‘আমার সঙ্গে তুমি কাজ করবে? গরিব-দুঃখীদের সেবা করার কাজ।’’ কাঁধে কালো কাপড়ের ঝোলা ব্যাগ। পায়ে সস্তা হাওয়াই চটি। পরনে সেই পরিচিত নীল পাড়ের সাদা শাড়ি। এক মুহূর্তও না ভেবে ঘাড় নেড়েছিলেন ফিলোমিনা। মতিঝিল বস্তিতে সেই কাজ শুরু হল মাদারের।...

মতিঝিল ও পাশের কামারডাঙা বস্তির শিশুদের জন্য গড়া হল দু-দুটো স্কুল। হলে হবে কী? কেউই আসতে চায় না। মাদারেরও জেদ শিক্ষার আলো এদের মধ্যে তিনি পৌঁছে দেবেনই। সকাল থেকে বাড়ি বাড়ি হানা দিতেন বাচ্চাদের স্কুলে ধরে আনার জন্য। সঙ্গে থাকতেন সিস্টার হিল্ডা ও সিস্টার ট্রিনিটা।...

• জন, বনমালীদের জন্য জমি চাইতে গিয়ে টিটাগড়ে অপমানিত হলেন ‘মাদার মা’। ঘর থেকে বার করে দেওয়া হয়েছিল তাঁকে। অনেক লড়াই করে জমি অবশ্য পেয়েছিলেন তিনি— মাত্র পাঁচ টাকায় তিন কাঠা। রেললাইনের ধারে। জন, বনমালীরা সকলেই কুষ্ঠরোগী। সমাজে পতিত, অচ্ছুত। তাই এত বাধা, এত অপমান। পথে নেমে মানুষের সেবা করতে গিয়ে যে মানুষেরই বাধা পেতে হয়, তা প্রথম বুঝলেন মাদার।

টিটাগড় পুরসভার চেয়ারম্যানের ঘর থেকে আহত মুখে মাদারের বেরিয়ে যাওয়ার দৃশ্যটা এখনও চোখের সামনে ভাসে প্রাক্তন চেয়ারম্যান গঙ্গাপ্রসাদ শাহের। তাঁর কথায়, ‘‘মাদারকে জমি দেওয়া নিয়ে টিটাগড় তখন টালমাটাল। আমরা বোর্ডে সংখ্যালঘু। তবু আশ্বস্ত করেছিলাম তাঁকে। কথা রাখতে পেরেছি।’’ সময়টা ১৯৬১-র জানুয়ারি।

আনন্দবাজার পত্রিকা, ৯ থেকে ১২ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৭

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

mother teresa
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE