Advertisement
১০ মে ২০২৪

দোলে গন্তব্য জঙ্গলমহল

কোথাও দোল রাধাকৃষ্ণের লীলাখেলা, কোথাও শুভ শক্তির হাতে অশুভ শক্তির দমন। দোল বা হোলির উদ্ভব নিয়ে যতই মতপার্থক্য থাকুক না কেন, এর বর্ণময় ছটা আট থেকে আশি সকলকেই পুলকিত করে। তবে বর্তমানে বসন্তোৎসব নিয়ে বীরভূমের বোলপুরের একচেটিয়া প্রভুত্বকে খর্ব করেছে পুরুলিয়ার গড়পঞ্চকোট, অযোধ্যা পাহাড়। লিখছেন প্রণব হাজরা কোথাও দোল রাধাকৃষ্ণের লীলাখেলা, কোথাও শুভ শক্তির হাতে অশুভ শক্তির দমন। দোল বা হোলির উদ্ভব নিয়ে যতই মতপার্থক্য থাকুক না কেন, এর বর্ণময় ছটা আট থেকে আশি সকলকেই পুলকিত করে। তবে বর্তমানে বসন্তোৎসব নিয়ে বীরভূমের বোলপুরের একচেটিয়া প্রভুত্বকে খর্ব করেছে পুরুলিয়ার গড়পঞ্চকোট, অযোধ্যা পাহাড়।

পুরুলিয়ায় দোলে এক বিদেশিনি। ফাইল চিত্র

পুরুলিয়ায় দোলে এক বিদেশিনি। ফাইল চিত্র

শেষ আপডেট: ১৮ মার্চ ২০১৯ ০৬:২৮
Share: Save:

বসন্তের নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ায় মানুষের মন যখন রোমান্টিক, তখনই মনকে রঙিন করে তোলা বসন্তোৎসবে মাতোয়ারা হন আপামর মানুষ। পলাশ আর কৃষ্ণচূড়ার রঙে প্রকৃতিও রঙিন হয়ে ওঠে এই সময়।

কিন্তু কেন এই দোল? হোলি হিসেবেও এই উৎসব পালিত হয়। কী সেই হোলি?

সাধারণ মানুষের বিশ্বাস, ফাল্গুনী পূর্ণিমার দিন বৃন্দাবনে কৃষ্ণ এবং রাধিকার আবির ও রঙ খেলার স্মরণেই দোল খেলার প্রচলন। এই দোল উৎসব বা রঙ খেলা শুরুর আগে তাই অনেক জায়গাতেই রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহ নিয়ে শোভাযাত্রা বার করা হয়। তার পরে বিগ্রহ দু’টিকে আবির ও রঙ মাখিয়ে নিজেদের মধ্যে রঙ খেলা শুরু হয়। এই ফাল্গুনী পূর্ণিমাই দোল পূর্ণিমা নামে পরিচিত। আবার ওই পূর্ণিমা তিথিতেই চৈতন্য মহাপ্রভুর জন্মদিন বলে এই পূর্ণিমাকে গৌর পূর্ণিমাও বলা হয়ে থাকে।

দোল ও হোলি পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। আমরা দোলের তাৎপর্য জেনেছি। কিন্তু হোলি, যা মূলত উত্তর, মধ্য ও পশ্চিম ভারতেই বেশি করে আদৃত এবং পালিত, তার অন্তর্নিহিত অর্থ কী? তা বুঝতে হলে আমাদের একটি পৌরাণিক লোককথার কাছে ফিরে যেতে হবে।

স্কন্দপুরাণ গ্রন্থের ফাল্গুন মাহাত্ম্য পরিচ্ছদে বর্ণিত রয়েছে এই লোককথা। যার মূল চরিত্র দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপু, তার বোন হোলিকা এবং দৈত্যরাজের পুত্র প্রহ্লাদ। হিরণ্যকশিপু নিজেকে দেব ও মানব বিজয়ী ভাবতে থাকে। সে চায় দেবতাদের নয়, মানবকূল তারই পুজো করবে। কিন্তু সেই দৈত্য কূলেই বেড়ে উঠছিল দেবভক্ত বিষ্ণুর পূজারী হিরণ্যপুত্র প্রহ্লাদ। এই সংবাদ ক্ষিপ্ত করে তোলে দৈত্যরাজ এবং তার বোন হোলিকাকে। নরমেগরমে প্রহ্লাদকে বুঝিয়েও যখন কোনও কাজ হল না, তখন দৈত্য ভাইবোন প্রহ্লাদকে হত্যা করার পরিকল্পনা করে।

প্রহ্লাদকে ভুল বুঝিয়ে হোলিকা তাকে কোলে নিয়ে চিতায় বসে। হোলিকা নিজে বরপ্রাপ্ত অগ্নিনিরোধক চাদর গায়ে জড়িয়ে নিয়ে বসেছিল। তার ধারণা ছিল, এতে আগুন তার ক্ষতি করতে পারবে না। কিন্তু দৈত্য এক ভাবে, ঈশ্বর অন্য। বিষ্ণুর অদৃশ্য প্রভাবে হোলিকার গায়ের অগ্নিনিরোধক চাদর উড়ে গিয়ে প্রহ্লাদকে আচ্ছাদিত করে। পুড়ে নিঃশেষ হয়ে যায় হোলিকা। তার পরেই আবির্ভাব হয় বিষ্ণুর। তাঁর হাতে নিহত হয় হিরণ্যকশিপু। দৈত্যরাজ ও হোলিকার এই পরিণতিকে অশুভের বিরুদ্ধে শুভর জয় বলেই মনে করা হয়। আর এই জয়ের আনন্দই হোলি উৎসব।

আরও একটি লোককথায় হোলি বা দোল উৎসবের বর্ণনা রয়েছে। কথিত আছে, কৃষ্ণ হোলির আগে কেশি নামক এক অসুরকে বধ করেন। অন্য মতে, এই সময় অরিষ্টাসুর নামে আরও এক অসুরকে বধ করেছিলেন কৃষ্ণ। অসুর অশুভ শক্তির প্রতীক। সে কারণে অসুর নিধনকেই অশুভ শক্তির পরাজয় ও শুভ শক্তির জয় বলে ধরা হয়। এই জয়ের আনন্দে পালিত হয় হোলি বা দোল। আর দোলের আগের দিন যে আগুনের উৎসব, তা-ই হোলিকাদহন বা নেড়াপোড়া।

হিন্দু পৌরাণিক উপাখ্যান থেকেই দোল বা হোলির উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ হলেও, এই দুই উৎসবই কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষ ভাবমূর্তিতে নিজেদের সর্বজনীন করে তুলেছে। অন্য সম্প্রদায়ের মানুষজনও এই উৎসবকে উপভোগ করেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যখন দোল উৎসব পালিত হয়, সেখানে সব ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মানুষই থাকেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রবর্তিত শান্তিনিকেতনের দোল উৎসব, যা ‘বসন্তোৎসব’ নামে পরিচিত, তা আজ আন্তর্জাতিক পরিচিতি লাভ করেছে।

যিশু খ্রিস্টের জন্মের ৩০০ বছর আগে থেকেই দোল উৎসব পালিত হয়ে আসছে। মন্দির গাত্রে, নানান ভাস্কর্যে, বেদ ও পুরাণে, ৭০০ শতকে রাজা হর্ষবর্ধনের আমলে প্রেমের নাটকেও এই উৎসবের বর্ণনা রয়েছে। কেউ কেউ আবার পূর্ব ভারতের প্রাচীন আর্য জাতির কাছ থেকে এই উৎসব এসেছে বলে থাকেন। সপ্তম শতকে শ্রীকৃষ্ণের ‘রত্নাবলী’ বা অষ্টম শতকের ‘মালতি মাধব’ কিংবা ষোড়শ শতকের ‘রঘুনন্দন’ অথবা জীমূতবাহনের ‘কালবিবেক’ গ্রন্থে দোল বা হোলির উল্লেখ আছে। অনেকে আবার গ্রিকদের উৎসব ‘ব্যাকানালিয়ার’ সঙ্গে তুলনা করে থাকেন দোল উৎসবের।

দোল বা হোলির উদ্ভব নিয়ে যতই মতপার্থক্য থাকুক না কেন, এর বর্ণময় ছটা আট থেকে আশি সকলকেই পুলকিত করে। বাঁকুড়ার কবি চণ্ডীচরণ দাস লেখেন, ‘বসন্ত মানে দোল যাত্রা আর বসন্ত উৎসব।/ গভীর গোপন প্রাণের ভিতরে শিহরণ কলরব।/ অকারণে মনে উদার আকাশে বইবে বাতাস হু হু।/ গাছের শাখায় যখন তখন ডাকবে কোকিল কুহু কুহু।/... ’।

বসন্তোৎসব নিয়ে বীরভূমের বোলপুর, ভুবনডাঙার একচেটিয়া প্রভুত্বকে খর্ব করেছে পুরুলিয়ার গড়পঞ্চকোট, বড়ন্তি থেকে অযোধ্যা পাহাড়। বরং বলা ভাল লাল-হলুদ পলাশের আগুনে রাঙা হয়ে যাওয়া বাঁকুড়া-পুরুলিয়ার জঙ্গলমহলই এখন বসন্তে অনেকের গন্তব্যস্থল।

লেখক সিধো কানহো বীরসা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থগারিক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Holi Purulia Shantiniketan
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE