রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ফাইল ছবি
বর্ধমানের অখ্যাত বুড়ার গ্রাম থেকে এক ‘মহিলা’ কবির একটি বই প্রকাশিত হয়েছে। নাম ‘ভুবনমোহিনী প্রতিভা’। কবির নাম ভুবনমোহিনী দেবী। সময়টা ১৮৭৫-৭৬।
সে বই প্রকাশেই সাড়া ফেলে দিল। পরাধীন ভারতবর্ষ নিয়ে কবিতা। ছত্রে ছত্রে দেশপ্রেমের আবেগ। সিপাহী বিদ্রোহের পরবর্তী সেই সময়ে দেশপ্রেম তখন কবিতার অন্যতম বিষয়। আর সেই জ্বালাময়ী কবিতা লিখছেন এক নারী। বিষয়টা তখন বেশ চমকপ্রদ! কিন্তু বাংলা কবিতার পাঠকেরা আজ সে কবি আর কবিতার কথা ভুলেই গিয়েছেন। ভুলে যাওয়ারই কথা। কারণ, সাহিত্যের ইতিহাসের গলিঘুঁজি নিয়ে যাঁদের কারবার, তাঁদের সে কবিতায় দরকার থাকলেও, ফিরে ফিরে পড়বার মতো সেখানে কিছু ছিল না। কিন্তু সেই ভুবনমোহিনী টিকে গিয়েছেন একটি রহস্য হয়ে। রবীন্দ্রনাথের প্রথম প্রকাশিত প্রবন্ধ আরও দু’টি বইয়ের সঙ্গে এই ‘ভুবনমোহিনী প্রতিভা’-র সমালোচনা।
রহস্যটা কী? ভুবনমোহিনী কি সত্যিই মহিলা কবি? ১৮৭৫-৭৬ সালে তা নিয়ে রীতিমতো আলোড়ন পড়ে গিয়েছিল। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে রবীন্দ্রনাথ তখন কিশোর, আঠারো পেরোননি। তখনই ভুবনমোহিনী পড়ার অভিজ্ঞতা মাঝবয়সে লেখা জীবনস্মৃতি-তে রীতিমতো স্মরণীয় হয়ে আছে, ‘তখন ভুবনমোহিনী প্রতিভা নামে একটি কবিতার বই বাহির হইয়াছিল। বইখানি ভুবনমোহিনী নামধারিণী কোনও মহিলার লেখা বলিয়া সাধারণের ধারণা জন্মিয়া গিয়াছিল। সাধারণী কাগজে অক্ষয় সরকার মহাশয় এবং এডুকেশন গেজেটে ভূদেববাবু এই কবির অভ্যুদয়কে প্রবল জয়বাদ্যের সহিত ঘোষণা করিতেছিলেন।’
আর সে কালের রবীন্দ্রনাথের এক বন্ধু তাঁকে মাঝে মাঝে ‘ভুবনমোহিনী’ সই করা চিঠি এনে দেখাতেন। আর এই ‘মহিলা’ কবির কবিতায় সেই বন্ধু এমনই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে তিনি কবিকে রীতিমতো কাপড়, বই ইত্যাদি উপহার পাঠাতেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সেই বন্ধুর মতে মিলত না। কবিতাগুলি যে আদৌ কোনও মহিলার লেখা সে কথাটা বিশ্বাস করতে মোটেই ভাল লাগত না রবীন্দ্রনাথের। কেন? জীবনস্মৃতিতেই রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘এই কবিতাগুলির স্থানে স্থানে ভাবে ও ভাষায় এমন অসংযম ছিল যে, এগুলিকে স্ত্রীলোকের লেখা বলিয়া মনে করিতে আমার ভাল লাগিত না। চিঠিগুলি দেখিয়াও পত্রলেখককে স্ত্রীজাতীয় মনে করা অসম্ভব হইল। কিন্তু আমার সংশয়ে বন্ধুর নিষ্ঠা টলিল না, তাঁহার প্রতিমাপূজা চলিতে লাগিল। আমি তখন ভুবনমোহিনী প্রতিভা, দুঃখসঙ্গিনী ও অবসরসরোজিনী বই তিনখানি অবলম্বন করিয়া জ্ঞানাঙ্কুরে এক সমালোচনা লিখিলাম।’
ঠিকই ধরেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ভুবনমোহিনী আসলে পুরুষ, নবীনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। কিন্তু কেন এই মহিলা নামধারণ? কারণ, স্বনামে এর আগে পত্রিকায় যে দু’টি কবিতা পাঠিয়েছিলেন নবীনচন্দ্র সে দু’টি ছাপা তো হয়ইনি, উল্টে সে দু’টি যে একেবারেই কবিতা হয়নি, এমন লিখে পাঠিয়েছিলেন পত্রিকার সম্পাদক। তখন ওই কৌশল। আর, কী আশ্চর্য, ‘ভুবনমোহিনী’র কবিতা পেয়ে সম্পাদক একেবারে আহ্লাদে আটখানা। নবীনচন্দ্র তাঁর জীবনকালে অপ্রকাশিত আত্মচরিতে লিখেছেন, ‘তৎপরে আর একটী কবিতা ভুবনমোহিনী দেবী স্বাক্ষর করিয়া পাঠানতে সম্পাদক মহাশয় আহ্লাদে অধীর হইয়া ভূয়সী প্রশংসাবাদ সহকারে মুর্শিদাবাদ পত্রিকায় প্রকাশ করিলেন।’
বিচিত্র মানুষ ছিলেন নবীনচন্দ্র৷ সংসারের অভাব দূর করতে পাশের গ্রাম কুড়মুনের মুন্সী মহম্মদ তকীর কাছে শিখেছিলেন চিকিৎসাবিদ্যা। তার পরে, বীরভূমের কীর্নাহারে ম্যালেরিয়ার চিকিৎসা করে বিখ্যাত হয়েছিলেন। আত্মচরিতে লিখছেন, ‘দেশের লোক অধিকাংশই গরীব, ডাক্তার বাটীতে লইয়া গিয়া চিকিৎসা করাইতে অপারগ— সুতরাং আমি এমত একটি ঔষধ তৈয়ার করিলাম যাহাতে জ্বর ত্যাগ ও বন্ধ হয় এবং জ্বরঘটিত তাবতীয় পীড়ার শান্তি হয়। ২/৪ মাস ঐরূপ করিতে করিতে ঔষধটী সর্বাংশে ফলপ্রদরূপে সুসম্পূর্ণ হইয়া উঠিল। তখন উহা ‘নবীন বাবুর লৌহসার’ নামকরণ করিয়া ব্যবস্থাপত্র ও বিজ্ঞাপন মুদ্রিত করিলাম। এইরূপে লৌহসার আবিষ্কৃত ও প্রচারিত হইল। এইরূপে এই মহৌষধ বীরভূম, মুর্শিদাবাদ, বর্দ্ধমান, দিনাজপুর, রংপুর, পূর্ণিয়া, মালদহ প্রভৃতি বঙ্গের সর্ব্বত্র প্রচারিত ও সমাদৃত হইয়া আমার আর্থিক অভাবের সম্যক্ নিরাকরণ করিয়াছে।’
কেবল নবীনচন্দ্র ওরফে ভুবনমোহিনী নন, রবীন্দ্রনাথের ওই প্রথম গদ্য রচনার বিষয় হয়ে আছেন বর্ধমানের আর এক কবি ও নাট্যকার, রাজকৃষ্ণ রায়। ১৮৭৬ সালে ‘জ্ঞানাঙ্কুর ও প্রতিবিম্ব’ পত্রিকায় ওই যে রবীন্দ্রনাথের প্রথম প্রবন্ধ প্রকাশিত হল তার নাম ‘ভুবন মোহিনী প্রতিভা, অবসর সরোজিনী ও দুঃখ সঙ্গিনী’। তার মধ্যে ‘ভুবনমোহিনী প্রতিভা’ নবীনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের লেখা, ‘অবসর সরোজিনী’ রাজকৃষ্ণ রায়ের, ‘দুঃখসঙ্গিনী’র লেখক হরিশচন্দ্র নিয়োগী। নবীনচন্দ্র বর্ধমানেই থাকতেন আর রাজকৃষ্ণ বর্ধমানের রামচন্দ্রপুর থেকে কলকাতায় এসে একই সঙ্গে প্রেসের কাজ আর লেখাপড়া করেছেন। কলকাতার ঠনঠনিয়ায় বীণা থিয়েটার তাঁরই প্রতিষ্ঠিত, পরে যা সিনেমাহল হয়ে এখন উঠে গিয়েছে।
কবি হিসেবে নবীনচন্দ্র বা রাজকৃষ্ণ এখন কেবল ইতিহাস৷ তাঁদের কবিতাও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে গিয়েছে। নবীনচন্দ্রের ভুনমোহিনী প্রতিভা প্রকাশের আরও প্রায় বছর কুড়ি পরে রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে বাংলা কবিতায় পালাবদল ঘটবে। ভুবনমোহিনী-র তীব্র সমালোচনা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, ওই প্রবন্ধে। সেই আঠারো-না-ছোঁয়া বয়সেও সাহিত্যে দেশপ্রেমের উগ্রতা সম্পর্কে তাঁর আপত্তি আমরা পড়তে পারি ওই প্রবন্ধে, ‘কোথাও বা দেশের নির্জ্জীব রোদন, কোথাও বা উৎসাহের জ্বলন্ত অনল! ‘‘মিলে সবে ভারত সন্তানের’’ কবি যে ভারতের জয় গান করিতে অনুমতি দিয়াছেন, আজ কালি বালক পর্য্যন্ত, স্ত্রীলোক পর্য্যন্ত সেই জয় গান করিতেছে, বরং এখন এমন অতিরিক্ত হইয়া উঠিয়াছে যে তাহা সমূহ হাস্যজনক! সকল বিষয়েরই অতিরিক্ত হাস্যজনক, এবং এই অতিরিক্ততাই প্রহসনের মূল ভিত্তি৷ ভারত মাতা, যবন, উঠ, জাগ, ভীষ্ম, দ্রোণ, প্রভৃতি শুনিয়া শুনিয়া আমাদের হৃদয় এত অসাড় হইয়া পড়িয়াছে যে ও সকল কথা আর আমাদের হৃদয় স্পর্শ করে না৷’ কবিতার বিষয়ে তিনি এই তীব্র সমালোচনা করলেও ভুবনমোহিনী-প্রকাশের বছর আষ্টেক পরে রবীন্দ্রনাথের ‘প্রভাতসংগীত’ কাব্যগ্রন্থের ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ কবিতার লেখার ধরনে নবীনচন্দ্রের ভুবনমোহিনীর ‘পিঞ্জরের বিহঙ্গিনী’ কবিতার প্রভাব আছে, এমনও ইঙ্গিত দিয়েছেন ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। তা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে, কিন্তু বর্ধমানের নবীনচন্দ্র আর রাজকৃষ্ণ উজ্জ্বল হয়ে আছেন বিশ্বকবির প্রথম প্রবন্ধে, আজও।
উপপরিচালক, বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy