শান্তিনিকেতনের রাস্তায় আলপনা দিচ্ছেন ছাত্রীরা। ফাইল চিত্র
আরও একটা আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হবে কাল, শুক্রবার। নারী দিবসে নতুন করে পথ দেখাতে পারে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নারীপ্রগতির ভাবনা আর উদ্যোগের আলোচনা। ১৮৭৮ সালে প্রথম বিদেশ যাত্রায় বিলিতি সমাজ ব্যবস্থায় স্ত্রী-স্বাধীনতা দেখে রবীন্দ্রনাথ মুগ্ধ হয়েছিলেন। সেই সময়কার চিঠিপত্রে এবং প্রবন্ধে তাঁর অভিজ্ঞতার বিভিন্ন দিক প্রকাশ পেয়েছিল। ১৮৮৯ সালে ভারতী পত্রিকায় নারীমুক্তি আন্দোলন বিষয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেন। পরবর্তীকালে ‘স্ত্রীর পত্র’, ‘বোষ্টমী’ কিংবা ‘হৈমন্তী’ গল্পগুলি তখনকার বাংলার গতানুগতিক সমাজচেতনার মূলে এক ধরনের কুঠারাঘাত ছিল। অন্য দিকে ‘চতুরঙ্গ’, ‘ঘরে-বাইরে’ উপন্যাসগুলির মধ্যে আমরা প্রচলিত সমাজজীবনের জীর্ণ পুরনো সংস্কারকে উপেক্ষা করার একটা পথনির্দেশ পাই।
১৯৩৬ সালে নিখিলবঙ্গ নারীকর্মী সম্মেলনের বক্তৃতায় কবি বলেন, নারীর স্বভাবের মধ্যে রয়েছে সংসারকে শান্তি ও আনন্দ দেবার এক সহজাত প্রবৃত্তি। তাঁদের স্বভাবের এই রূপটিকে শিক্ষার দ্বারা উদ্ভাসিত করা, সমাজের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত। প্রায় একশো বছর আগে তিনি চেয়েছিলেন, ‘... তাঁদের রক্ষণশীল মন যেন বহু যুগের অস্বাস্থ্যকর আবর্জনাকে একান্ত আসক্তির সঙ্গে বুকে চেপে না ধরে। তাঁরা যেন মুক্ত করেন হৃদয়কে, উজ্জ্বল করেন বুদ্ধিকে, নিষ্ঠা প্রয়োগ করেন জ্ঞানের তপস্যায়।’
শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মবিদ্যালয় পর্বে ১৯০৮ সালে ‘দেহলি’ গৃহে ৬ জন বালিকাকে নিয়ে নারীবিভাগের প্রথম সূত্রপাত। তখন এটি দেখাশোনা করতেন আশ্রমের অধ্যাপক অজিতকুমার চক্রবর্তীর মা সুশীলা দেবী। ১৯১০ সালের গ্রীষ্মাবকাশ পর্যন্ত এই বিভাগের দেখাশোনা করেন রবীন্দ্রনাথের বিদ্যালয় সহযোগী এক অকৃত্রিম বন্ধু অধ্যাপক মোহিতচন্দ্র সেনের বিধবা স্ত্রী সুশীলা সেন। এর পর আবার পুজোর ছুটি পর্যন্ত দায়িত্বে ছিলেন রবীন্দ্রজীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের স্ত্রী গিরিবালা দেবী। তখন থেকেই আশ্রমের মেয়েরা পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলো, মন্দির প্রভৃতিতে যোগ দিত। ধীরে ধীরে বিভাগটি একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। ১২ বছর পরে বিশ্বভারতীর সূচনাপর্বে ১৯২২ সালে সেটি নতুন করে জেগে ওঠে।
আন্তজার্তিক মহিলা দিবসে এই বিশেষ দিনগুলি সম্পর্কে জানেন?
১৯২২-এ শান্তিনিকেতনে নারী বিভাগের কাজকর্ম চলতে থাকে স্নেহলতা সেনের তত্ত্বাবধানে। মেয়েরা দ্বারিক, নেবুকুঞ্জ-এর বাড়িগুলিতে থাকতেন। স্নেহলতা খুবই উদ্যোগী মহিলা ছিলেন। মেয়েদেরকে সঙ্ঘবদ্ধভাবে সেবা ও অন্য নানা কাজে ব্রতী করেন। বিশ্বভারতীর প্রথম বার্ষিক রিপোর্টে দেখা যায়, কলাভবনের শিল্প বিভাগের পড়ুয়া সংখ্যা ৫০ জন। তাঁদের মধ্যে ১০ জন ছাত্রী। অন্য দিকে দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং ভীমরাও শাস্ত্রীর তত্ত্বাবধানে সঙ্গীত বিভাগের ৪০ জনের মধ্যে ২০ জনই ছাত্রী। সেই সময় ‘গার্ল-গাইড’ নামে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা ছিল। রবীন্দ্রনাথ উৎসাহী ছিলেন এই ভেবে যে, আশ্রমের মেয়েরা স্বাস্থ্যবতী হবে, সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে সমাজসেবার কাজ করবে। উৎসহা এতটাই ছিল যে, সেই সংস্থার স্থানীয় শাখার নতুন নামকরণ করে দিলেন ‘গৃহদীপ’। পরে আবার নাম বদলে করেন ‘সহায়িকা’। ১৯২৩ সালে তাঁদের জন্য একটি গান রচনা করলেন ‘অগ্নিশিখা এসো এসো’। ঘটনাচক্রে দেখা যায় সেই ‘সহায়িকা’র সঙ্গে ‘গার্ল-গাইডে’র সম্বন্ধ স্থাপন সম্ভব হয়নি। ‘ওথ্ টেকিং’ অর্থাৎ ‘শপথ নেওয়া’ ছিল এর মূল সমস্যা। এবং এখানে দীনবন্ধু অ্যান্ড্রুজের প্রতিবাদী ও বৌদ্ধিক ভূমিকায় সে যাত্রা বিশ্বভারতী ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল। এই বিষয়ে অমিয় চক্রবর্তীকে কবি জানিয়েছিলেন, ‘Oath নেওয়া সম্বন্ধে আমার সম্মতি ছিল এ কথা কেউ কল্পনাও করতে পারে তা আমি ভাবিনি। ... সত্যকে প্রতিজ্ঞার বাঁধনে বেঁধে তার গৌরব নষ্ট করে’ যারা কাজ উদ্ধার করতে চায় কোনো দিন আমি তাদের দলে নই। এই কথাটা মেয়েদের আমার হয়ে বুঝিয়ে বোলো।’
‘বিশ্বভারতী নারীবিভাগ’ এই শিরোনাম নিয়ে প্রবাসী অগ্রহায়ণ ১৩৩০ বঙ্গাব্দে রবীন্দ্রনাথের একটি চিঠি প্রকাশ করেছিল। যার ছত্রে ছত্রে নারীপ্রগতির এক অতুলনীয় ভাব ব্যক্ত হয়েছে। যা আজও একটি সাড়া জাগানো বিষয় : ‘শান্তিনিকেতন আশ্রমে বিশ্বভারতীর আন্তর্গত নারী বিভাগ হইতে স্ত্রীলোকদের শিক্ষার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করা হইয়াছে। আপাতত এখানে অন্যান্য শিক্ষণীয় বিষয়ের সঙ্গে সঙ্গে সঙ্গীত, চিত্রকলা, বস্ত্রবয়ন এবং বই বাঁধানো প্রভৃতি হাতের কাজ শিক্ষা দেওয়া চলিতেছে। সেইসঙ্গে স্বাস্থ্যতত্ত্ব, রোগী পরিচর্যা, শাকসব্জী, ফুলফলের বাগান তৈয়ারী, বিজ্ঞান বিহিত গৃহকর্ম-প্রণালী প্রভৃতির বিষয়ে ছাত্রীরা পারদর্শিতা লাভ করে, ইহা আমাদের ইচ্ছা। ... নারীশিক্ষায় আগ্রহবান ব্যক্তিদিগের নিকট হইতে যথোচিত আনুকূল্য পাইলে দেশবিদেশ হইতে উপযুক্তা শিক্ষয়িত্রী সংগ্রহ করিয়া এখানে উচ্চ আদর্শের নারী শিক্ষালয় গড়িয়া তুলিতে কৃতকার্য হইব।’
যে অর্থে আমরা নারীবাদ বা নারীমুক্তি শব্দগুলি প্রয়োগ করি— রবীন্দ্রনাথ সেই সূচনাপর্ব থেকে অনেক পরে। রামমোহন, বিদ্যাসাগর প্রমুখ ছিলেন সে পর্বের জনক। রবীন্দ্রনাথ যে সময় থেকে এই আন্দোলনের শরিক, তখনও মেয়েদের সচেতন হওয়ার সুযোগ সেভাবে ছিল না। কিছুটা হলেও ঠাকুরবাড়ির মহিলারা পুরনো সংস্কার থেকে একটু একটু করে বেরিয়ে আসছেন। বিশেষত সত্যেন্দ্র-পত্নী জ্ঞানদানন্দিনী দীর্ঘ বিদেশ-বাসের সুযোগ পেয়েছিলেন বলে তুলনায় তিনি অনেক বেশি আধুনিকা হয়ে উঠেছিলেন। কাজেই রবীন্দ্রনাথের সময়ে নারীমুক্তির পরিবর্তে নারীপ্রগতি শব্দটির প্রয়োগ হয়তো যথার্থ। তাঁর বিভিন্ন রচনার মধ্যে সেই প্রগতির কথাই ব্যক্ত হয়েছে। অন্য দিকে রবীন্দ্রনাথ এমন একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছিলেন, যেখানে তাঁর মনের কথাকে কাজে পরিণত করার অনেক সুযোগ তিনি নিজেই তৈরি করতে পেরেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথের তিরোধানের পূর্বে এই উদ্যোগ কতটা সার্থক হয়েছিল তার একটি সংক্ষিপ্ত পরিসংখ্যান তুলে ধরা যায়। ১৯৪০ সালে শান্তিনিকেতনে মূলত চারটি বিভাগ। কলাভবনে মোট ৭৫ জন ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে ৩৩ জন ছাত্রী অর্থাৎ ৪৪ শতাংশ। সঙ্গীতভবনে মোট ৪৪ জনের মধ্যে ২৮ জনই ছাত্রী, প্রায় ৬৪ শতাংশ। শিক্ষাভবনে ১২৬ জনের মধ্যে ৩৬ জন ছাত্রী এবং পাঠভবনে ১৭৮ জনের মধ্যে ৬১ জন ছাত্রী, যা গড় শতাংশের বিচারে প্রায় ৩১। কিন্তু সামগ্রিক বিচারে বিশ্বভারতীতে পড়াশোনা করা মেয়েদের শতকরা গড় প্রায় ৪২। এখন রবীন্দ্র-প্রয়াণের পর প্রায় ৮০ বছর অতিক্রান্ত হতে চলেছে। বিশ্বভারতী কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে প্রায় ৭০ বছর। ততদিন সারা পৃথিবী জুড়ে নারী আন্দোলনের কত আধুনিক ধারা প্রবাহিত হয়েছে। দেশের বহু বিশ্ববিদ্যালয়-সহ বিশ্বভারতীতেও শুরু হয়েছে ‘উইমেন স্টাডিজ়’ নামে একটি বিষয়। ২০১৪ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত পরিসংখ্যানে মোট পড়ুয়ার মধ্যে ছাত্রী সংখ্যার শতকরা গড় ৪৩ থেকে ৪৫। সুতরাং পরিসংখ্যান বিচারে নানা সুবিধা-অসুবিধার কথা মাথায় রেখে, সমসাময়িক পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করে, ভালই বোঝা যায় যে নারীপ্রগতির বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ কতটা আন্তরিক ও আধুনিকমনস্ক ছিলেন।
বৈশাখ ১৩৩২ সংখ্যায় প্রবাসীতে নারীশিক্ষা বিষয়ক বিভিন্ন খবরাখবর বিস্তৃত আকারে, তথ্যভিত্তিক বিবরণ দিয়ে প্রকাশিত হয়েছিল। সেখানে বলা হয়েছে, বিশ্বভারতীর মতো সর্বাঙ্গীণ শিক্ষার ব্যবস্থা বাংলায় আর কোথাও নেই। পাঁচ জন ছাত্রীকে বিনা বেতনে আহার-খরচ বাদে যাবতীয় সাহায্য করা হবে। ১৩৩৯ আষাঢ় সংখ্যা ‘বিশ্বভারতী’ শিরোনামে অনেক তথ্য পরিবেশন করেছে। বিশ্বভারতীর প্রতিষ্ঠাতা আচার্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নারীশিক্ষার ব্যাপারে প্রভূত আগ্রহ তৈরি হয়েছে। বিভিন্ন দিক থেকে তিনি সময়োপযোগী নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন। বর্ণপরিচয় থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত একই জায়গায় একই প্রতিষ্ঠানে পাওয়ার বন্দোবস্ত একমাত্র এখানেই আছে। সেসময় শ্রীমতী আশা অধিকারী বারাণসী বিদ্যালয়ের মহিলা কলেজের প্রিন্সিপাল, এক বছরের জন্য ছুটি নিয়ে শান্তিনিকেতনে বিনা বেতনে এই কাজে যুক্ত ছিলেন। ১৯২৯ সালে মার্চ মাসে হংকং-এর সিন্ধুদেশীয় ‘হিন্দু বণিক সমিতি’ বিশ্বভারতীর উন্নতিসাধনে প্রচুর আর্থিক সাহায্য করেছিল। শর্ত না হলেও তাঁদের মনের কথা কবিকে জানিয়েছিলেন যে, ওই অর্থ যেন শান্তিনিকেতনের নারী বিভাগের জন্য ব্যয় হয়। সে বছর শ্রীভবনের কাজ শেষ হলে তাতে ৮০ জন বালিকা ছিল— যাদের মধ্যে ৭ জন অবাঙালি।
অমিয় চক্রবর্তীকে লেখা কবির একটি চিঠি থেকে দেখা যায় রবীন্দ্রনাথ নারীপ্রগতিতে কতটা গভীরভাবে আশাবাদী ছিলেন। ‘... যেদিন থেকে আশ্রমে আমি মেয়েদের স্থান দিয়েছি সেইদিন থেকেই আমার মনে এই কল্পনা ছিল যে আশ্রম রচনায় মেয়েদের ত্যাগ এবং সেবা সুন্দর এবং প্রাণবান হয়ে উঠবে। ... হয়তো এর কর্ম্মপ্রণালীর মধ্যে মেয়েদের শক্তিকে ঠিকভাবে আবাহন করতে পারিনি। ... মেয়েদের মধ্যে যে স্বাভাবিক শক্তি আছে সে যেন আপনার স্থান আপনিই জয় করে নেয়। ... মনে আশা করে আছি একদা ওখানে নারী বিভাগটি বৃহৎ ও বিচিত্র হয়ে উঠবে এবং তার থেকে আপনিই নারী বিশ্ববিদ্যালয় উদ্ভাবিত হবে।’
লেখক গবেষক এবং রবীন্দ্রভবন গ্রন্থাগারের অস্থায়ী দায়িত্বে (বন্ধনীতে উদ্ধৃতি ও তার বানান অপরিবর্তিত, মতামত নিজস্ব)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy