Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

সিরাজের পুরস্কার পেয়েছিলেন রাজনগরের আলিনকি

পর্যটক, গবেষক, ভ্রমণপিপাসুরা বীরভূমের দর্শনীয় স্থানগুলি বেড়াতে এলে আজও অনেকে রাজনগর আসেন। লিখছেন মহম্মদ সফিউল আলম।ইতিহাস গবেষকেরা জানান, রাজনগরের রাজাদের বংশতালিকায় আলিনকি খানের নাম পাওয়া যায়।

রাজনগরে ইমামবাড়ার সামনে মহরম উপলক্ষে মেলা। ছবি: দয়াল সেনগুপ্ত

রাজনগরে ইমামবাড়ার সামনে মহরম উপলক্ষে মেলা। ছবি: দয়াল সেনগুপ্ত

শেষ আপডেট: ৩১ মার্চ ২০১৯ ০১:২৯
Share: Save:

রাজনগর রাজবাটীতে রক্ষিত কয়েকশো বছরের পুরনো দেওয়ান সাহেবের ব্যবহার করা আসল কাঁথা ও চাদর ছাতার তলায় অনাড়ম্বর ভাবে নিয়ে যাওয়া হয় মাঘের পরিত্র উরসে। সাবেকি প্রথা মেনে সর্বপ্রথম ওই চাদর চাপানো হয় রাজনগর রাজপরিবারের পক্ষ থেকে। পরে ভক্তেরা দিনভর পর্যায়ক্রমে চাদর চড়ান। উপস্থিত থাকেন স্থানীয় রাজপরিবারের বর্ষীয়ান প্রতিনিধি তথা দেওয়ান সাহেবের উত্তরসূরি রাজাসাহেব নামে পরিচিত মহম্মদ রফিকুল আলম খান সহ অন্যান্য সদস্য ও শুভানুধ্যায়ীরা। এলাকায় আরও একটি প্রাচীন মাজার রয়েছে। তা মীরসাহেবের মাজার নামে পরিচিত। তাঁর আসল নাম মীর নুরুদ্দিন হুসেইনী। ইতিহাস বলে, তিনি সুদূর আরব থেকে এসেছিলেন। এখানে ২৩ ফাল্গুন ঊরস মোবারক পালিত হয়। প্রতি বছর ১ অগ্রহায়ণ মীরসাহেবের মাজারে নবান্ন উৎসব পালন করা হয়। মাজারের সামনের মাঠে মেলা বসে। উৎসবে ভিড় জমান সব ধর্মের মানুষ। তাঁর আমলের খোদাই করা একটি প্রাচীন পাথর রাজনগর শাহী মসজিদে সংরক্ষিত রয়েছে। তাঁর ব্যবহৃত নৌকার কাঠ মাজার চত্বরে আজও বিদ্যমান৷ সেগুলি দেখচে অনেকে আগ্রহ প্রকাশ করেন৷ এলাকাটি সুফিসাধকদের সাধনস্থল বলা-ই যায়। অন্য দিকে রাজনগর রাজবাড়ি ও ইমামবাড়া প্রাঙ্গণে প্রতি বছর মহরম মেলায় জেলা, রাজ্য এমনকী ভিন রাজ্যের মানুষও হাজির হন। বিভিন্ন গ্রাম থেকে তাজিয়া ও নিশান শোভাযাত্রা আসে মহরম মেলায়। লাঠি ও অন্যান্য খেলা প্রদর্শিত হয়৷ একে অনেকে ‘সম্প্রীতির মিলনমেলা’ও বলে থাকেন। মহরমের ১০ তারিখ মঞ্জিলের দিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত মেলা হয়। সে দিন বিকেলে নাকাশ ও মোলবুনি গ্রামের কাছে বাবুরবাগানেও একটি ছোট গ্রামীণ মেলা বসে। সেই মেলাগুলি রাজাদের আমল থেকে চলে আসছে বলে জানান এলাকার প্রবীণ বাসিন্দারা।

ইতিহাস গবেষকেরা জানান, রাজনগরের রাজাদের বংশতালিকায় আলিনকি খানের নাম পাওয়া যায়। তাঁর নামানুসারে কলকাতার আলিপুরের নামকরণ অতীতে করা হয়েছিল বলে জানা যায়। ইতিহাস থেকে আরও যে তথ্য পাওয়া যায় তা থেকে স্পষ্ট, কলকাতা জয় করার ক্ষেত্রে নবাব সিরাজদ্দৌলার প্রধান সেনাপতি হিসেবে প্রতিনিধিত্ব করেন আলিনকি। এক জন সাহসী যোদ্ধা হিসেবে সেই সময় আলিনকির ভূয়সী প্রশংসা করেন নবাব। পুরস্কার হিসেবে কলকাতার ওই স্থানের নামকরণ তাঁর নামে করেন সিরাজ।

রাজনগরের টেরাকোটার মতিচুড় মসজিদ অতীতে রাজা আসাদুল্লা নির্মাণ করান। এটি ছয় গম্বুজবিশিষ্ট ছিল। তা পুরাতত্ব বিভাগ কর্তৃক রক্ষিত। সরকারি সাইনবোর্ড দেওয়া আছে তার সামনে। কয়েক বছর আগে সেটিও সংস্কার করা হয়। তবে যথাযথ সংস্কার বলতে যা বোঝায় এবং সেটিকে যে ভাবে গুরুত্ব দেওয়া উচিত ছিল তা হয়নি বলে ক্ষোভপ্রকাশ করেছেন ইতিহাসপ্রেমী ও পর্যটকদের একাংশ।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

অতীতে রাজনগর তথা বীরভূমের সীমানা অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। রাজনগর রাজপরিবারের দেওয়া তথ্য ও ঐতিহাসিকদের বিবরণ থেকে জানা যায়— পূর্বে ভাগীরথী, পশ্চিমে পঞ্চকোট, উত্তরে ভাগলপুর ও দক্ষিণে অজয় নদ পর্যন্ত ছিল তার সীমানা। বর্ধমান, সাঁওতাল পরগনা ও পূর্বতন বিহারের কিছুটা রাজনগরের অধীন ছিল। রাজনগরের পাঠান রাজাদের বিষয়ে লেখক, ঐতিহাসিক ও গবেষকরা একটি দিক গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরেছেন। সেটি হল, সুদূর অতীতে ইংরেজ আমলে এই রাজারা ইংরেজদের কোনও রকম সাহায্য সহযোগিতা করেননি। স্বীকার করেননি তাঁদের বশ্যতা। ফলস্বরূপ ইংরাজেরা ওই রাজাদের নানা ভাবে চাপে রেখেছিলেন। বিভিন্ন দিক থেকে অসুবিধার সৃষ্টি করেছিলেন। তবুও তাঁরা ইংরাজদের বিরোধিতা করে গিয়েছেন মনেপ্রাণে ও অনেকটা নির্ভীক ভাবেই। যা ভেবে সেই রাজাদের বর্তমান বংশধরেরা গর্ব অনুভব করেন আজও। সাঁওতাল বিদ্রোহে তাঁরা সহযোগিতা করেন ও স্বাধীনতা সংগ্রামে এখানকার রাজাদের বেশ কিছুটা অবদান ছিল বলে মনে করেন অনেকে৷

পর্যটক, গবেষক, ভ্রমণপিপাসু ও ইতিহাস অনুরাগীরা বীরভূমের দর্শনীয় স্থানগুলি বেড়াতে এলে আজও অনেকে রাজনগর আসেন। দেখা করেন রাজাদের বর্তমান বংশধরদের সঙ্গে৷ সংগ্রহ করেন প্রয়োজনীয় তথ্য। কেউ কেউ দেখা করেন ও কথা বলেন ৮৬ বছরের প্রবীণ প্রতিনিধি রাজা সাহেবের সঙ্গে। কথা বলেন পরিবারের অন্যান্য সদস্য প্রতিনিধিদের সঙ্গেও। রাজনগর থানা থেকে ঢিলছোঁড়া দূরত্বে রাজাসাহেবের বাংলো বা বৈঠকখানা অবস্থিত। সময়ের বহু ওঠাপড়া, পরিবর্তন ও ইতিহাসের সাক্ষী এই বৈঠকখানাটিও। সাধারণ থেকে অনেক বিখ্যাত মানুষ, সমাজসেবী থেকে বিদ্বজ্জন বিভিন্ন সময়ে এসেছেন এখানে৷ সে দিক থেকে আলাদা একটা ঐতিহ্য রয়েছে তার। এখানে রাখা প্রাচীন পালকি বর্তমানে সিউড়ি তথ্য সংস্কৃতি বিভাগের সংগ্রহশালায় রয়েছে। প্রায় দুশো বছরের পুরনো পাগড়ী স্থানীয় রাজবাটীতে আজও সযত্নে রাখা। এ ছাড়া পাথরের তৈরি একটি প্রদীপ এখানে রয়েছে।

সবেবরাত, বেড়া পরবে রাজাদের আমলে এগুলি ব্যবহার করা হতো বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে। স্থানীয় মালিপাড়ার মালাকারদের হাতের তৈরি বেড়া কিনে নিয়ে গিয়ে উৎসব পালন করেন এলাকাবাসী। রাজাদের আমল থেকে এই ধরণের পরবের চল রয়েছে আজও। শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধর্ম ও সামাজিক ক্ষেত্রে রাজনগরের রাজাদের যে বিশেষ অবদান রয়েছে তার প্রমাণ ইতিহাস বই থেকেই পাওয়া যায়। এলাকার একাধিক মন্দিরে জায়গা দান ও মন্দির নির্মাণে আর্থিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে রাজনগরের পাঠান রাজাদের ভূমিকা প্রশংসার দাবি রাখে। আর এই সব কারণে ওই রাজপরিবারের বর্ষীয়ান প্রতিনিধি ও সদস্যদের আজও মর্যাদা ও শ্রদ্ধার চোখে দেখেন এলাকা ও সংলগ্ন অঞ্চলের জনতা।

পরিশেষে বলা যায়, প্রাচীন ঐতিহাসিক স্থান রাজনগর জেলা তথা রাজ্যের পর্যটন মানচিত্রে গুরুত্বপূর্ণ স্থান পাওয়ার আশায় অসীম সম্ভাবনা বুকে নিয়ে আজও জেগে রয়েছে। ঠিক এমন ভাবেই।

(লেখক সাংস্কৃতিক কর্মী ও রাজনগর রাজ পরিবারের সদস্য, মতামত নিজস্ব)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Rajnagar Heritage Travel
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE