Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

কেন ধর্মনিরপেক্ষ

স্বাধীন ভারতে কেন ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’-র ধারণাটিকে রাষ্ট্রীয় পরিচয়ের অন্তর্ভুক্ত করা হইয়াছিল, আপাতত সেই আলোচনাটি জরুরি। কারণ, স্বাধীনতা অর্জনের সাত দশক পরেও ধর্মীয় প্রশ্নে ভারতের অবস্থাটি, হাইনরিখ হাইনের ভাষায়, ‘পুরাতন বটে, অথচ সর্বদা নূতন’।

শেষ আপডেট: ১৭ নভেম্বর ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

ধর্মনিরপেক্ষতা বিষয়ে যোগী আদিত্যনাথরা ঠিক কী ভাবেন, সে বিষয়ে মাথা না ঘামাইলেও দেশের চলিত। কিন্তু, গণতন্ত্রের মহিমা! হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিক আদিত্যনাথ ধর্মনিরপেক্ষতাকে কী চোখে দেখেন, তাহাকে গুরুত্ব না দিলেও দেশের বৃহত্তম রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী— এবং, যে রাজ্যে প্রায় ২০ শতাংশ মানুষ মুসলমান— কী বলিতেছেন, সে কথা শুনিতে হয় বইকি। আদিত্যনাথ বলিয়াছেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দটি স্বাধীন ভারতের বৃহত্তম মিথ্যা, এবং দেশের রাজনীতিতে যাঁহারা শব্দটি আমদানি করিয়াছিলেন, মানুষের নিকট তাঁহাদের ক্ষমাপ্রার্থনা করা উচিত। তাঁহার মতে, রাষ্ট্র কোনও একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করিবে না বটে, কিন্তু তাহা ধর্মনিরপেক্ষও হইতে পারে না। আধুনিকতার ইতিহাসে রাষ্ট্র এবং ধর্মের সম্পর্ক লইয়া যে দীর্ঘ বিতর্ক হইয়াছে, সে বিষয়ে আদিত্যনাথদের সহিত আলোচনা বাড়াইয়া লাভ নাই। মাথায় গেরুয়া ফেট্টি বাঁধিয়া তরবারি হাতে রাস্তায় নামিয়া সেই তর্ক হয় না। তাহা দার্শনিক তর্ক। স্বাধীন ভারতে কেন ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’-র ধারণাটিকে রাষ্ট্রীয় পরিচয়ের অন্তর্ভুক্ত করা হইয়াছিল, আপাতত সেই আলোচনাটি জরুরি। কারণ, স্বাধীনতা অর্জনের সাত দশক পরেও ধর্মীয় প্রশ্নে ভারতের অবস্থাটি, হাইনরিখ হাইনের ভাষায়, ‘পুরাতন বটে, অথচ সর্বদা নূতন’।

নামোচ্চারণ না করিয়া আদিত্যনাথ যাঁহার দিকে আঙুল তুলিয়াছেন, তিনি জওহরলাল নেহরু। স্বাধীন ভারত যে সত্যই ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হইতে পারিয়াছিল, তাহার কৃতিত্বের সিংহভাগ নেহরুরই প্রাপ্য। ব্যক্তিগত স্তরে ধর্মের প্রতি নেহরুর তীব্র অনীহা ছিল, কিন্তু রাষ্ট্রীয় স্তরে ধর্মনিরপেক্ষতা তাঁহার সেই ব্যক্তিগত অভিরুচির পরিচায়ক নহে। তর্কটি ছিল স্টেট বা রাষ্ট্র এবং নেশন বা জাতির। ব্রিটিশ শাসনের অবসানে, দেশ ভাগ হইবার পর, স্বাধীন রাষ্ট্র মিলিয়াছিল, কিন্তু জাতির পরিচয় তখনও অমীমাংসিত ছিল। যে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে দেশভাগ হইল, তাহাই যে স্বাধীন ভারতের জাতির চরিত্র নির্ধারণ না করিতে পারে— সহজ ভাষায়, ভারত যেন দ্বিতীয় পাকিস্তান না হইয়া উঠে— নেহরু তাহা নিশ্চিত করিতে চাহিয়াছিলেন। ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে কোনও এক গোষ্ঠীর মানুষকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক করিয়া রাখায় তাঁহার আপত্তি ছিল। কারণ, তিনি যে সংজ্ঞায় জাতিকে চিনিতে এবং চিনাইতে চাহিয়াছিলেন, তাহা ছিল উন্নয়নের পরিচয়। উন্নয়নের এক সূত্রে দেশের ভৌগোলিক পরিধির মধ্যে থাকা সব মানুষকে বাঁধিতে চাহিলে কাহারও সহিত বিমাতৃসুলভ আচরণ করা চলে না। সেই কারণেই ভারত ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ হইয়াছিল।

আদিত্যনাথ আপত্তি করিয়া বলিতে পারেন, তিনিও বিমাতৃসুলভ আচরণের কথা বলেন নাই, শুধু রাষ্ট্রকে ধর্মীয় পরিচয়ের অধিকার দিতে চাহিয়াছেন। রাষ্ট্র ধর্মাচরণের অধিকার পাইলে তাহা শেষ অবধি সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মই হইবে। কারণ, রাষ্ট্র ব্যক্তিনিরপেক্ষ নহে। জওহরলাল নেহরুও যেমন রাষ্ট্রের পরিচয় তৈরি করিতেন, যোগী আদিত্যনাথরাও করেন। বস্তুত, দ্বিতীয় দলই সংখ্যাগরিষ্ঠ। নেহরু যখন রাষ্ট্র গড়িতেছিলেন, তখন শুধু নাগপুরই হিন্দুত্ববাদের সুর গাহে নাই, কংগ্রেসের অভ্যন্তরেও সেই দাবি জোরালো ছিল। রাষ্ট্রকে ধর্মাচরণের অনুমতি দিলে শেষ অবধি সংখ্যাগরিষ্ঠের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা ঠেকাইবার উপায় থাকে না, কথাটি নেহরু জানিতেন। আদিত্যনাথরাও জানেন। বস্তুত, পর দিনই আদিত্যনাথ জানাইয়া দিয়াছেন, হিন্দুত্ব আর উন্নয়ন সমার্থক। তাঁহার রাজত্বে রাষ্ট্রের ধর্মাচরণের অধিকার থাকিলে কী হইবে, বুঝিতে কষ্ট নাই। সেই কারণেই নেহরু তাহার বিরোধী ছিলেন, আর আদিত্যনাথরা জোর সমর্থক। ভারত নেহরুকে আদর্শ মানিবে, না কি আদিত্যনাথকে, তাহাই প্রশ্ন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE