একশো বছর আগে, ১৯১৫-তে, ৫০ নম্বর বাগবাজার স্ট্রিট থেকে প্রকাশিত হয় জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের বঙ্গের বাহিরে বাঙ্গালী৷ বঙ্গকূপ ছেড়ে মণ্ডূকটিকে বের করে নিয়ে আসার একটা ইঙ্গিত ছিল ওই নামেই৷ বাংলা সংস্কৃতি নিয়ে গ্রাম্য মাতামাতির এই সময়ে প্রচেষ্টাটা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ৷
বিশ শতকের শুরুতেই বাঙালির আত্মপরিচয় খোঁজার চেষ্টাটা শুরু হয় বাংলার বাইরে৷ শুরু করেছিলেন রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, তাঁর সম্পাদিত ‘প্রবাসী’ পত্রিকায়৷ ১৩০৮-এর (১৯০১) বৈশাখে, বাংলার বাইরে, ইলাহাবাদ থেকে প্রবাসী প্রথম প্রকাশিত হয়৷ আষাঢ় সংখ্যাতেই সম্পাদক একটি প্রবন্ধ প্রতিযোগিতা ঘোষণা করলেন৷ বিহারে বাঙালি, উত্তর পশ্চিম প্রদেশ-অযোধ্যা-পঞ্জাবে বাঙালি, মধ্যভারতে বাঙালি এবং ব্রহ্মদেশে বাঙালি এই চার বিষয়ে শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধের জন্য পদক দেওয়া হবে৷ দ্বিতীয় বিষয়ে প্রবন্ধ লেখেন জ্ঞানেন্দ্রমোহন, সেটাই বঙ্গের বাহিরে বাঙ্গালী-র সূচনা৷
এ বছর রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের (১৮৬৫-১৯৪৩) জন্মের সার্ধশতবর্ষ৷ তাঁর জীবন ও কাজ নিয়ে সভাসমিতি, প্রবন্ধনিবন্ধের পালা এখন। শঙ্কা হয়, প্রথাগত তর্পণে তাঁর সর্বভারতীয় প্রেক্ষিতটা মনে রাখা হবে তো? এক সময় ভারতে তিন জন শ্রেষ্ঠ সাংবাদিকের নাম একসঙ্গে উচ্চারিত হত৷ ট্রিবিউন-এর কালীনাথ রায়, লীডার-এর সি ওয়াই চিন্তামণি এবং রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, প্রবাসীর জন্য নয়, মডার্ন রিভিউ-এর জন্য৷ সর্বভারতীয় প্রেক্ষিতে বাংলা প্রবাসী-র চেয়ে ইংরেজি মডার্ন রিভিউ-ই বেশি গুরুত্ব পাবে তা খুব স্বাভাবিক৷ কিন্তু বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি এমনকী বাংলার ভূগোল থেকেও বেরিয়ে গিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ সাময়িকপত্র প্রকাশের প্রথম চেষ্টাটা প্রবাসী-তেই ছিল৷ শুরুর আগেই ঢাক পেটানোর মানসিকতা থেকেও মুক্ত ছিলেন রামানন্দ৷ পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় ছোট্ট একটি সংযমী ভূমিকায় রামানন্দ লিখেছিলেন, ‘প্রারম্ভের আড়ম্বর অপেক্ষা ফল দ্বারাই কার্য্যের বিচার হওয়া ভাল৷ এইজন্য আমরা আপাততঃ আমাদের আশা ও উদ্দেশ্য সম্বন্ধে নীরব রহিলাম৷’
উদ্দেশ্যটা স্পষ্ট হয়েছিল প্রথম সংখ্যা থেকেই৷ রামানন্দ নিজে দীর্ঘ সচিত্র প্রবন্ধ লিখেছিলেন, ‘অজণ্টা গুহা চিত্রাবলী’৷ অজিন্ঠা নিয়ে প্রবন্ধ বাংলা ভাষায় সম্ভবত সেই প্রথম৷ ‘প্রবাসী’ যে কবিতা-গল্প-উপন্যাস-নকশায় ভরা আরও একটা বাংলা পত্রিকামাত্র নয় তার প্রমাণ ছিল প্রথম বর্ষের সূচিতেই৷ জীববিদ্যা, শর্করা বিজ্ঞান, জগদীশচন্দ্র বসুর আবিষ্কার, জাপান ভ্রমণ, ফতেপুর সিক্রি, হিন্দি পরিভাষা, হিন্দু, গ্রিক ও রোমান, মেয়েলি সাহিত্য ও বারব্রত— বাঙালির মননচর্চার নানা দিক প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন রামানন্দ, বিংশ শতকের সেই প্রথম বছরেই৷ প্রচ্ছদেও ভারতীয়ত্বের একটা বার্তা ছিল— মঠ-মন্দির, চৈত্য-বিহার, তাজমহল-মিনার, অমৃতসরের স্বর্ণমন্দির, তখনকার ব্রহ্মদেশের প্যাগোডার ছবি দিয়ে কোলাজ করে তৈরি হয়েছিল প্রচ্ছদ৷
বাঙালিকে প্রথমে ‘ভারতীয়’ ভাবার ও ভাবানোর এই মানসিকতা ধারাবাহিক ভাবে প্রবাসী এবং পরে মডার্ন রিভিউ-তে প্রবল ভাবে বজায় রেখেছিলেন রামানন্দ৷ উল্টো দিক থেকে, ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় বাংলাটি ছেড়ে যাঁরা বেরোতে পেরেছিলেন তাঁদের অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখার ট্র্যাডিশনটাও ভাঙতে চেয়েছিলেন৷ প্রবাসী বাঙালিদের প্রতি তাঁর নিবেদন ছিল, ‘...এমন এক সময় ছিল, শুনিয়াছি তখন প্রবাসী বাঙালীরা বঙ্গের বাঙালীদের পরিহাস উপহাস ও অবজ্ঞার পাত্র ছিলেন৷ ইহা সত্য, যে বহু পূর্বে ইংরেজ শাসনকালের প্রারম্ভে, যে-সব বাঙালী যুবক শিক্ষার অল্পতা বা অন্য কোন প্রকার অবস্থা বৈগুণ্যবশতঃ বঙ্গে উপার্জ্জন করিতে পারিতেন না, প্রধানত তাঁহারাই ‘বিদেশে’ যাইতেন৷ কিন্তু এই সব যুবক পণ্ডিত না হইলেও একটা কথা সকলকেই স্বীকার করিতে হইবে যে তাঁহাদের স্বাবলম্বন, আত্মনির্ভরশীলতা, পৌরুষ ছিল৷...যে সব ইংরেজ বিদেশে গিয়া প্রথমে বাণিজ্য ব্যবসা দ্বারা, সাম্রাজ্য স্থাপন দ্বারা, ইংলণ্ডের শক্তি ও সম্পদ বাড়াইয়াছে তাহারাও অক্সফোর্ড কেম্ব্রিজের ডিএসসি পিএইচডি ছিল না৷’
রামানন্দের ভারতবর্ষ মোটেই এলিটের ভারত ছিল না৷ ভারতীয় নানা ভাষার সাহিত্য থেকে অনুবাদ যেমন প্রকাশিত হত, পাশাপাশি চাক্মা, নাগা, খাসিয়া, কোল প্রভৃতি আদিবাসীদের জীবনসমস্যাও আলোচিত হত৷ বিশেষ করে প্রতি সংখ্যায় যে একাধিক পুরো-পাতা রঙিন ও সাদা-কালো ছবি ছাপা হত রামানন্দ-সম্পাদিত দুটি পত্রিকায়, সেখানেও কোনও সঙ্কীর্ণ, কুণ্ঠিত বাঙালিয়ানা ছিল না৷ নির্বিচারে বিদেশি-বর্জনের যুগেও নিয়মিত রাফায়েল, বিসোঁ, হফম্যান প্রমুখ ইউরোপীয় শিল্পীদের বিশ্বখ্যাত ছবিগুলির প্রতিরূপ ছেপে গিয়েছেন রামানন্দ৷ সমালোচনার উত্তরে পরিষ্কার জানিয়েছিলেন, শিল্পের কোনও দেশ বা জাতিবিচার তাঁর কাছে নেই৷ পাশাপাশি রাজা রবিবর্মা, গণপত কাশীনাথ ক্ষাত্রে, মহাদেব বিশ্বনাথ ধুরন্ধর, অবনীন্দ্রনাথ-গগনেন্দ্রনাথ এমনকী জাপানী তাইকান ও হিসিডার আঁকা কালী ও সরস্বতীর ছবি ছাপতেও দ্বিধা করেনি প্রবাসী৷ রবীন্দ্রনাথের ভারতবর্ষকে যে উপন্যাসে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ করে পাওয়া যায় সেই ‘গোরা’-ও প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল প্রবাসী-তেই৷ ‘গোরা’ই ছিল প্রবাসীতে প্রকাশিত প্রথম উল্লেখযোগ্য উপন্যাস৷
বঙ্গভঙ্গ প্রতিরোধ আন্দোলন তথা বিলিতি বর্জনের সেই আগুনের মধ্যে ‘গোরা’ প্রকাশ করলেন রামানন্দ (১৯০৭)৷ বোঝাই যায়, তিনি ছিলেন উল্টোপথের পথিক৷ কূপমণ্ডূকতা থেকে মুক্তির সাধনাতেই তিনি অন্য রকম বাঙালি৷ ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে প্রবাসী-তে ‘স্বদেশী প্রসঙ্গ’ প্রবন্ধে সেই মুক্তচিন্তার সাহস, ‘কেহ যদি জিজ্ঞাসা করে, এ বৎসর আমাদের দেশে সর্ব্বপ্রধান স্বদেশী ঘটনা কি ঘটিয়াছে, তাহা হইলে আমরা কি উত্তর দিব? চুড়ি ভাঙ্গা নয়, বিলাতী কাপড় পোড়ানো নয়, জাতীয় দলের সহিত মোকদ্দমায় পূর্ব্ববঙ্গের গবর্ণমেণ্টের পরাজয়ও নয়, এমন কি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়াদি স্থাপনও নয়, সর্ব্বপ্রধান স্বদেশী ঘটনা বিজ্ঞানাচার্য্য জগদীশচন্দ্র বসুর উদ্ভিদের সাড়া (Plant Response) নামক গ্রন্থ প্রকাশ৷’
একশো দশ বছর পরেও এই সাহসে কতটা সাড়া দিতে পেরেছে পয়লা বৈশাখী বাঙালি?
বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগের ডেপুটি ম্যানেজার, প্রোডাকশন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy