Advertisement
১১ মে ২০২৪
Politics

বিপজ্জনক

বহু মানুষ দারিদ্রসীমার নীচে তলাইয়া গিয়াছেন। অর্থের প্রয়োজন তাঁহাদের প্রত্যেকেরই।

শেষ আপডেট: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২০ ০০:০১
Share: Save:

ভাতা পাইবেন পুরোহিতরা। রাজ্য সরকার সম্প্রতি ঘোষণা করিয়াছে, আগামী পূজার মাস হইতেই ৮০০০ পুরোহিতকে মাস প্রতি এক হাজার টাকা করিয়া দেওয়া হইবে। শুধু তাহাই নহে, যে সমস্ত পুরোহিতের নিজস্ব গৃহ নাই, আবাস যোজনায় তাঁহাদের বাড়ি দিবার দায়িত্বটিও সরকার লইয়াছে। প্রসঙ্গত ২০১২ সাল নাগাদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ইমাম ও মুয়াজ্জিনদের ভাতার কথা ঘোষণা করিয়াছিলেন। তখনই সমালোচনা তুঙ্গে উঠিয়াছিল— হিন্দু পুরোহিতরাই বা সরকারি দাক্ষিণ্য হইতে বাদ পড়িলেন কেন? বিজেপি নিরন্তর ইমামভাতার প্রসঙ্গটি তুলিয়া সংখ্যালঘু তোষণের অভিযোগ আনিয়াছে তাঁহার বিরুদ্ধে। অতএব, নির্বাচনের ঢাকে কাঠি পড়িবার সঙ্গে সঙ্গেই পুরোহিত ভাতা চালু করিবার সিদ্ধান্তটি কেন, তাহা অনুমান করা চলে।

প্রশ্ন হইল, ভারত নামক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে কোনও সরকার ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে কোনও নাগরিককে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার চেষ্টা করিবে কেন? তাহা দেশের সংবিধানের চরিত্রবিরোধী। ধর্ম নাগরিকের ব্যক্তি পরিসরে সীমাবদ্ধ থাকিবে, রাষ্ট্র সকল ধর্মের প্রতি সমদর্শী হইবে, কিন্তু কোনও ধর্মকেই রাষ্ট্রীয় পরিসরে প্রবেশাধিকার দিবে না, ইহাই ভারতের সাংবিধানিক আদর্শ। ইমামভাতা যেমন এই নীতটিকে লঙ্ঘন করিয়াছিল, একই ভাবে পুরোহিতদের ভাতার ঘোষণাও সেই সাংবিধানিক আদর্শের পরিপন্থী। কেহ স্মরণ করাইয়া দিতে পারেন, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হিন্দু পুরোহিতদের আর্থিক দুর্দশার কথাটিও বলিয়াছেন— অতএব, এই ভাতাটিকে ধর্মের চশমায় না দেখিয়া দুঃস্থ নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্রীয় সাহায্য হিসাবেও দেখা চলে। দরিদ্রের পার্শ্বে দাঁড়ানোই যদি উদ্দেশ্য হয়, রাজ্যের বহু কোটি মানুষ সেই সাহায্যের দাবিদার। অতিমারির ধাক্কায় অসংগঠিত ক্ষেত্রের বিপুলসংখ্যক মানুষ জীবিকা হারাইয়াছেন। বহু মানুষ দারিদ্রসীমার নীচে তলাইয়া গিয়াছেন। অর্থের প্রয়োজন তাঁহাদের প্রত্যেকেরই। সেইখানে শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট পেশার মানুষকে— যাঁহাদের ধর্মীয় সংযোগটি প্রশ্নাতীত, এবং ধর্মের সংযোগে যাঁরা হয়তো রক্ষণশীলতার দিকেই ঝুঁকিয়া— তাঁহাদের পৃথক ভাবে সাহায্য করিবার অর্থ প্রশাসনকে সেই ধর্মের মধ্যে টানিয়া আনা। একটি ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামোয় যাহা ঘোরতর অন্যায়।

বিপজ্জনকও বটে। কেন্দ্রীয় সরকার ইতিমধ্যেই সেই বিপজ্জনক কাজে লিপ্ত। ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শের বিপরীতে গিয়া দেশের সর্বোচ্চ অভিভাবক হিন্দু মন্দিরের ভূমিপূজা অনুষ্ঠানে যোগ দিয়াছেন, মন্দির আন্দোলনকে স্বাধীনতা সংগ্রামের সহিত তুলনা করিয়াছেন। তাঁহার দলেরই এক মুখ্যমন্ত্রী সদর্পে বলিয়াছেন, তিনি মসজিদ প্রতিষ্ঠার আমন্ত্রণে সাড়া দিবেন না। ধর্ম হইতে প্রশাসনকে বিচ্ছিন্ন রাখিবার নীতিটি দেশে ভূলুণ্ঠিত। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাহা বিলক্ষণ জানেন, তবুও ভোটের চাপে তিনিও সেই পথটি পরিহার করিতেছেন না। প্রথমে একটি ধর্মীয় পরিচিতির ভিত্তিতে কিছু মানুষকে অতিরিক্ত সুবিধা প্রদানের পর চাপের মুখে অন্য সম্প্রদায়টিকেও খানিক তোষামোদ করিয়া ভারসাম্য রক্ষার নীতিকে ধর্মনিরপেক্ষতা বলে না। প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষতা— ধর্মকে তাহার নিজের জায়গায় রাখে, এবং প্রশাসনকে ধর্ম, জাত, সম্প্রদায়ের ঊর্ধ্বে সর্বসাধারণের জন্য স্থাপন করে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE