Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
মার্কিন দেশটা গড়েই উঠেছে আগ্নেয়াস্ত্রের ছায়ায়

হাতে বন্দুক, সঙ্গে ভগবান

আমাদের দেশ থেকে আমরা হয়তো ঠিক বুঝতে পারি না, বন্দুক এ দেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি, রাজনীতি, আর অর্থনীতির সঙ্গে কেমন অঙ্গাঙ্গি ভাবে যুক্ত। দেশটাই যে গড়ে উঠেছে বন্দুকের ছত্রছায়ায়।

সারণ ঘটক
শেষ আপডেট: ০৯ মে ২০১৮ ১১:১৫
Share: Save:

বব ডিলানের গানে আছে, মার্কিন দেশে অনেকেই ভাবেন যে ইতিহাসে নায়কদের সর্বদাই হাতে বন্দুক থাকে আর সঙ্গে থাকেন ভগবান। সেই দেশে ২০১৮ সালে এর মধ্যেই চার হাজারের বেশি মানুষ বন্দুকের শিকার হয়েছেন। সরকারি তথ্য অনুযায়ী আত্মহত্যা, দুর্ঘটনা, ও হত্যাকাণ্ড মিলিয়ে প্রত্যেক বছর গড়ে ত্রিশ হাজারের ওপর মৃত্যুর কারণ বন্দুক।

আমাদের দেশ থেকে আমরা হয়তো ঠিক বুঝতে পারি না, বন্দুক এ দেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি, রাজনীতি, আর অর্থনীতির সঙ্গে কেমন অঙ্গাঙ্গি ভাবে যুক্ত। দেশটাই যে গড়ে উঠেছে বন্দুকের ছত্রছায়ায়। মার্কিন সংবিধানের দ্বিতীয় সংশোধন (১৭৯১) ঘোষণা করেছিল যে, দেশের সুরক্ষার জন্যে সশস্ত্র নাগরিক বাহিনীর প্রয়োজন, তাই তাঁদের অস্ত্র রাখার অধিকার থেকে সরকার বঞ্চিত করতে পারে না। অষ্টাদশ শতকের প্রেক্ষিতে এর নিশ্চয়ই একটা অর্থ ছিল। কারণ তখন এ দেশে যথেষ্ট শক্তিশালী জাতীয় সেনাবাহিনী ছিল না।

কিন্তু এ-ও তো ঠিক যে, সেই ধারা বইতে বইতে একবিংশ শতাব্দীতে এসে একটা বড় বিতর্কের কারণ হতেই পারে। অথচ ইতিহাসের ধুয়ো ধরে অনেক বন্দুকপ্রেমী দাবি করেন আজও, দেশরক্ষার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও, এই নীতির কোনও রকম ব্যতিক্রমই স্বীকার করা চলে না। এমনকী বন্দুকের উপর নিয়ন্ত্রণ অসাংবিধানিক, এমন কথাও তাঁরা বলেন। দেশের শীর্ষ আদালতের রক্ষণশীল বিচারকরাও সেই রকমই রায় দিয়েছেন।

বন্দুক উৎসাহীদের জাতীয় সংস্থা ন্যাশনাল রাইফ্‌ল অ্যাসোসিয়েশনের (এনআরএ) এ দেশের রাজনীতিতে বিশেষ প্রতিপত্তি। এই সংস্থার প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৮৭১ সালে, নাগরিকদের ‘শিকার’ তথা বন্দুক ব্যবহার প্রশিক্ষণের জন্যে। তবে ১৯৭০ দশকের মাঝামাঝি এই সংস্থার নেতৃত্ব দখল করে এক কট্টর রক্ষণশীল গোষ্ঠী, যারা বন্দুকের অধিকার নিয়ে কোনও রকম আপস বা নতুন বিধিনিষেধের বিরোধিতা করাটাই সংগঠনের প্রধান দায়িত্ব বলে ঘোষণা করে।

১৯৮০ সালের নির্বাচনে এই সংস্থা প্রথম সরাসরি রাজনীতিতে যোগ দেয় রোনাল্ড রেগনের সমর্থনে। প্রেসিডেন্ট রেগন নিজে বন্দুকের মালিক হওয়া সত্ত্বেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণের পক্ষপাতী ছিলেন। যেমন একে-৪৭ বা এম-১৬ গোছের মিলিটারি রাইফেলের ওপর বিধিনিষেধ তিনি সমর্থন করেছিলেন। তবু অবশ্য আশির দশকে নতুন কোনও বন্দুক নিয়ন্ত্রণের আইন জারি হয়নি। তার প্রধান কারণ রেগনের আমলে ছিল মার্কিন রাজনীতিতে রক্ষণশীলতার জয়জয়কার। এনআরএ দেশের শক্তিশালী দক্ষিণপন্থী গোষ্ঠীদের জোটের অন্যতম শরিক হিসাবে এই সময় থেকেই মার্কিন রাজনীতিতে প্রভাবশালী হয়ে ওঠে।

প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টনের আমলে ওরেগন রাজ্যের রুবি রিজ-এ উগ্রপন্থী আরিয়ান ব্রাদারহুড-এর এক সদস্যের বাড়িতে, এবং একই সময়ে টেক্সাসে মৌলবাদী ব্রাঞ্চ দ্রাভিডিয়ান গোষ্ঠীর প্রাঙ্গণে কেন্দ্রীয় সুরক্ষা বাহিনীর বেআইনি বন্দুক বিরোধী অভিযানে একাধিক প্রাণহানি ঘটেছিল। তার পর থেকেই অতি-দক্ষিণপন্থী মহলে একটা সরকার-বিরোধী মনোভাব আরও জাঁকিয়ে বসে। এই দলগুলির সঙ্গে এনআরএ-র সরাসরি যোগাযোগ না থাকলেও বন্দুকপ্রীতি আর মতাদর্শের মিল ছিল। ১৯৯৪ সালে সংসদীয় ডেমোক্র্যাট দল এবং ক্লিন্টন প্রশাসনের জারি করা এক নতুন আইন বলে, বন্দুক বিক্রয়ের সময় ক্রেতার মানসিক রোগ বা ফৌজদারি মামলার ইতিহাস যাচাই করতে হবে। এর সঙ্গে মিলিটারি ধাঁচের রাইফেল বিক্রির উপর দশ বছরের নিষেধাজ্ঞাও ঘোষণা হয়। এর পর থেকেই ডেমোক্র্যাট দলের সঙ্গে এনআরএ-র শত্রুতা পাকাপাকি দাঁড়িয়ে যায়।

বুশ প্রশাসনের সময় সংসদীয় রিপাবলিকান দলের সঙ্গে এনআরএ-র এক রকম মতাদর্শগত এবং রাজনৈতিক মৈত্রী ছিল। ২০০৪ সালে মিলিটারি ধাঁচের রাইফেলের উপর নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ ফুরোলে বুশ সরকার তা আর নতুন করে জারি করেনি। সেই সময় থেকে আবার এই অস্ত্র বিক্রি হওয়া শুরু হয়। ইদানীং অনেক গণহত্যায় এআর-১৫ নামক একটি রাইফেল ব্যবহার হয়েছে, যা মার্কিন সেনাবাহিনী ব্যবহৃত এম-৪ বা এম-১৬ রাইফেল-এর নাগরিক সংস্করণ।

বারাক ওবামা রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরে মার্কিন দেশে রিপাবলিকান দল এবং নতুন গড়ে ওঠা টি পার্টি গোছের দক্ষিণপন্থী গোষ্ঠীগুলির পাশাপাশি এনআরএ-ও নতুন সরকারের সম্পূর্ণ বিরোধিতার পথ ধরে। ২০১০ সালের সংসদীয় নির্বাচনে রিপাবলিকান দলের জয়জয়কারের পর বোঝা যায়, নতুন বন্দুক নিয়ন্ত্রণ আইনের আর কোনও আশাই নেই। এমনকী ২০১৩ সালে কনেটিকাট রাজ্যের এক স্কুলে মানসিক রোগগ্রস্ত এক কিশোর-বন্দুকবাজের হামলায় বহু শিশুর প্রাণ যাওয়ার পরেও ওবামা প্রশাসন কোনও নতুন নিয়ম চালু করতে পারেনি। উল্টে কোনও কোনও ষড়যন্ত্রমনস্ক বন্দুক-উৎসাহী দাবি করে বসে যে পুরো ব্যাপারটাই মিথ্যা প্রচার— যাতে ওবামা সরকার নিজের সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘন করে বন্দুক বাজেয়াপ্ত করার ‘অসাংবিধানিক’ চেষ্টা চালাতে পারে।

২০১৬ সালের নির্বাচনে ট্রাম্প ও রিপাবলিকান প্রার্থীদের সমর্থনে এনআরএ কোটি কোটি ডলার খরচ করে। তাঁর আচমকা, বিতর্কিত জয়ের পরে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দেশের শীর্ষ আদালতে রক্ষণশীল, এনআরএ সমর্থিত বিচারক নিল গরসচকে নিয়োগ করেন। ট্রাম্প সরকারের কাছে প্রথম থেকেই দক্ষিণপন্থী গোষ্ঠীদের অবারিত দ্বার। ট্রাম্পবিরোধী আন্দোলনকে বামপন্থী বুদ্ধিজীবী ও হলিউড সমর্থিত বন্দুকবিরোধীদের ষড়যন্ত্র বলে ঘোষণা করে এনআরএ, বন্দুকপ্রেমীদের ‘স্বাধীনতা রক্ষা’র লড়াইয়ের জন্যে প্রস্তুত থাকতে বলে। ২০১৭ সালে অগস্ট মাসে ভার্জিনিয়া রাজ্যের শারলটসভিল শহরে বর্ণবিদ্বেষী, অভিবাসনবিরোধী, ফ্যাসিবাদী গোষ্ঠীদের মিছিলে একাধিক বন্দুকধারী মিলিশিয়াও হাজির ছিল।

মনে রাখতে হবে, মার্কিন দেশে বেশির ভাগ বন্দুক অল্পসংখ্যক নাগরিকের হাতে। এঁদের কেউ শখে, কেউ শিকারের জন্য, কেউ আত্মরক্ষার জন্য বন্দুক সংগ্রহ ও রক্ষা করতে চান। পরিসংখ্যান বলছে এই দেশে বন্দুক-উৎসাহীরা সাধারণত বয়স্ক, শ্বেতাঙ্গ, গ্রাম বা ছোট শহরের বাসিন্দা, ও রক্ষণশীল পুরুষ। এই ধরনের মানুষ এ দেশে আজ কমে আসছে, তা সত্ত্বেও দেশের রাজনীতিতে এখন এঁদের মাত্রাতিরিক্ত ক্ষমতা প্রদর্শন করার অবকাশ আছে, সব নির্বাচনেই এঁরা এনআরএ সমর্থিত প্রার্থীদের ভোট দিয়ে থাকেন। ফলে বোঝাই যাচ্ছে, রিপাবলিকান দলকে যদি জিততে হয়, এনআরএ-র বিরোধিতা করা প্রায় অসম্ভব। তা ছাড়াও, এনআরএ বন্দুক কোম্পানি থেকে শুরু করে দেশবিদেশের নানা জায়গা থেকে যুদ্ধ তহবিলে অগাধ টাকা সঞ্চয় করেছে, যে টাকা তারা সমর্থিত প্রার্থীর জন্যে (বা বিপক্ষ প্রার্থীর বিরুদ্ধে) দরাজ হাতে খরচ করতে প্রস্তুত।

এত শত সত্ত্বেও, এনআরএ এই মুহূর্তে একটি বড় রাজনৈতিক সঙ্কটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ফ্লরিডা রাজ্যের পার্কল্যান্ডের স্কুলে বন্দুকধারীর হামলায় ১৭ জন ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক, ও কর্মচারী প্রাণ হারানোর পর সেই স্কুলের বাকি ছাত্রছাত্রীরা অতি অল্প সময়ের মধ্যে এক শক্তিশালী বন্দুকবিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলেছে, যা নিশ্চিত ভাবে এ দেশের রাজনীতিতে একটা নতুন হাওয়া এনেছে। ২৪ মার্চ এদের ডাকা মিছিলে সারা দেশ জুড়ে লাখ লাখ মানুষ যোগ দিয়েছেন। যে ফ্লরিডার রাজনীতিতে এনআরএ-র অশেষ প্রতাপ এবং যে প্রদেশের সরকার পুরোপুরি রিপাবলিকান দলের কবলে, সেই রাজ্যে বন্দুক নিয়ন্ত্রণের এক নতুন আইনও জারি হয়েছে! এই আইন অতি সীমিত হলেও এনআরএ-র পক্ষে এ এক বিরাট পরাজয়। স্বভাবতই আপাতত দক্ষিণপন্থী প্রচারমাধ্যম ও রাজনীতিক মহলে এই ছাত্রছাত্রীদের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত আক্রমণ ও কুৎসার বন্যা বইছে। অন্য অনেক দেশের মতোই মার্কিন রাজনীতিতে আজকাল নানা রকম আজব ঘটনা ঘটছে, যার বেশির ভাগই গণতন্ত্রের পক্ষে আশাজনক নয়। তবে এর মধ্যে পার্কল্যান্ডের ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলনের সাফল্য এক ব্যতিক্রমী উদাহরণ, গোটা বিশ্বের পক্ষেই যা আশাজনক।

ডিলানের যে গানের কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম, সেটির শেষে আছে যে, ভগবান সত্যিই থাকলে তিনি ভবিষ্যতে আর যুদ্ধ লাগতে দেবেন না। অতটা আশাবাদী আজ হওয়া মুশকিল। যুদ্ধ বন্ধ করা যদি কঠিন কাজও হয়, অন্তত স্কুল ছাত্রছাত্রীরা যেন বন্দুকের রোষের থেকে রক্ষা পেয়ে বড় হয়ে ওঠার একটা সুযোগ পায়, এটুকু আশাও কি আজ বেশি হয়ে যাবে?

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ হ্যাম্পশায়ারে কিন স্টেট কলেজ-এর সমাজতত্ত্বের শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Crime Gunshot Violence United States
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE