স্বীকৃতি: রাষ্ট্রপুঞ্জের অনুষ্ঠানে পুরস্কৃত কন্যাশ্রী প্রকল্প। পুরস্কার হাতে মুখ্যমন্ত্রী। নিজস্ব চিত্র
কোনও কোনও সরকারি প্রকল্প থাকে, যাহাদের সাফল্য কেবল হিসাবের খাতায় যোগবিয়োগে পরিমাপ করা যায় না। সমাজমানস নামক যে অলক্ষ্য বস্তুটি আছে, সেখানে তাহার ছাপ পড়িতে থাকে— সদর্থক ছাপ, যাহা হিসাবের অঙ্কে পরিমাপ করা কঠিন হয়। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কন্যাশ্রী প্রকল্পটি তাহার দৃষ্টান্ত। প্রকল্পটি যে স্পষ্টত জনমনোরঞ্জনার্থে এবং আরও স্পষ্টত ভোটাকর্ষণার্থে পরিকল্পিত ও প্রযোজিত, তাহাতে সন্দেহ করিবার কারণ নাই। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম হইতেই দিবার বিনিময়ে পাইবার নীতি অনুসরণ করিয়া আসিতেছেন, কন্যাশ্রীও সেই লক্ষ্যেই সূচিত। কিন্তু উদ্দেশ্য যাহাই হউক, এই প্রকল্প রাজ্যের গ্রামীণ পরিবেশে একটি বিশেষ সদর্থক পরিবেশ তৈরি করিতে পারিতেছে, এমন সিদ্ধান্ত করা সম্ভব। ভারতের অনেক রাজ্যের অপেক্ষা পশ্চিমবঙ্গে কন্যাবৈষম্য তুলনায় কম হইলেও অবস্থা সন্তোষজনক নয়। বিশেষত অর্থনৈতিক অবস্থার তারতম্যে এই বৈষম্য সর্বত্রই অধিক ঘটিয়া থাকে, বাংলার গ্রামগঞ্জেও। বিবাহের বয়স না হইতেই মেয়ের বিবাহ দেওয়া এবং মেয়েকে বিদ্যালয়ে না পাঠানো, এই দুই দিক দিয়া পশ্চিমবঙ্গ মোটেই প্রশংসাযোগ্য জায়গায় নাই। তাই, কন্যাশ্রী প্রকল্পের অর্থ হাতে-কলমে কত জন মেয়েকে বিবাহ নামক ফাঁদ হইতে বাহির করিয়া শিক্ষার দিকে ঠেলিয়া দিয়াছে সেই হিসাব জরুরি, কিন্তু সেই হিসাবের উপর দিয়া যায় সচেতনতার বিস্তার। মেয়েদের পড়াশোনা করাইবার, নিজেদের পায়ে দাঁড় করাইবার, সুস্থ জীবনদানের অনুকূল সচেতনতা।
রাষ্ট্রপুঞ্জের দরবারে পুরস্কার প্রাপ্তির ঘটনাটি মূলত এই সাফল্যের স্বীকৃতি। জগৎসভায় পশ্চিমবঙ্গ তাহার কন্যাদের জন্য মাথা তুলিয়া দাঁড়াইবার সুযোগ পাইল। রাজ্য, দেশ, জাতির সার্বিক ঘোর দুর্দিনে ইহা কম কথা নয়! যে মঞ্চে ইউরোপ, আফ্রিকা, এশিয়ার বিভিন্ন দেশের নেতা-নেত্রীরা নিজেদের দেশের বিভিন্ন গৌরবগাথা পেশ করিতেছেন, সেখানে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর কন্যাশ্রী বিষয়ক বক্তব্য করতালিমুখরিত অভিনন্দন পাইতেছে, ইহা তুচ্ছ করিবার মতো ঘটনা নহে। অনুষ্ঠানের শিরোনামটি ছিল, ফিউচার ইজ নাও— এখনই ভবিষ্যৎ গড়িবার সময়, এই মর্মে বিভিন্ন সরকারি নীতি ও প্রকল্পের আলোচনা। এখনকার একটি ছোট পদক্ষেপও যে আগামী দিনে বড় পরিবর্তনের দিশারি হইয়া উঠিতে পারে, তাহা মনে করাইয়া দিবার অবকাশ।
প্রশংসা, স্বীকৃতি মন ভরাইয়া দেয় ঠিকই। কিন্তু সেইটুকুতেই যেন লক্ষ্য পূর্ণ না হয়, মুখ্যমন্ত্রীকে তাহা নিশ্চিত করিতে হইবে। প্রথমত, গত ছয় বৎসরে ৪০ লক্ষ ৩৩ হাজার কন্যার নিকট কন্যাশ্রীর অর্থ পৌঁছাইয়া দিবার পর কত লক্ষ পরিবার তাহার যথার্থ ব্যবহার করিয়াছে, কত কন্যা শিক্ষা-সুযোগ গ্রহণ করিবার পর সেই শিক্ষা সমাপ্ত করিয়াছে, কত জন তাহা হইতে জীবনযাপনে একটি ভিন্ন দিশা আনিতে পারিয়াছে, এ বার তাহার একটি সমীক্ষা জরুরি। ইহা কেবল শুষ্ক যোগবিয়োগ নহে, একটি প্রকল্পের সার্বিক মূল্যায়ন, যাহা ব্যতীত তাহার ব্যাপ্তি বা পরিসর বাড়ানো কঠিন। কন্যাশ্রী এই রাজ্যের মুখোজ্জ্বল করিয়াছে। অতঃপর এই রাজ্যের কন্যাসমাজের মুখশ্রী যাহাতে গোটা দেশের মধ্যে উজ্জ্বলতম হয়, সেই লক্ষ্য ধার্য হউক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy