Advertisement
E-Paper

ফ্রান্সে ভোটের ফল মিলেছে, পরিণাম অজানা

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নাগরিকরা দ্বিতীয় বার এমন একটা ধর্মসংকটের মুখোমুখি হলেন। নিজেদের রাজনৈতিক ও আদর্শগত বিভেদ সরিয়ে রেখে তাঁদের চরম দক্ষিণপন্থী ন্যাশনাল ফ্রন্ট দলের মোকাবিলা করতে হয়েছে।

জয়ন্ত চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১১ মে ২০১৭ ১২:২০
উত্তীর্ণ: লুভ্‌র্-এর সামনে ফরাসি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী ইমানুয়েল মাক্‌রঁ-র সমর্থকরা। প্যারিস, ৭ মে। রয়টার্স

উত্তীর্ণ: লুভ্‌র্-এর সামনে ফরাসি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী ইমানুয়েল মাক্‌রঁ-র সমর্থকরা। প্যারিস, ৭ মে। রয়টার্স

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নাগরিকরা দ্বিতীয় বার এমন একটা ধর্মসংকটের মুখোমুখি হলেন। নিজেদের রাজনৈতিক ও আদর্শগত বিভেদ সরিয়ে রেখে তাঁদের চরম দক্ষিণপন্থী ন্যাশনাল ফ্রন্ট দলের মোকাবিলা করতে হয়েছে। এর আগে, ২০০২ সালে উপনিবেশবাদী ফ্যাসিস্ট দল ন্যাশনাল ফ্রন্টের কর্ণধার জঁ মারি ল্য পেন সোশ্যালিস্ট প্রার্থী লিয়নেল জসপ্যাঁকে হারিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দ্বিতীয় তথা চূড়ান্ত পর্বে পৌঁছে গিয়েছিল। ফ্রান্সের মানুষ সেই ঘটনায় প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়ে দ্বিতীয় পর্বের নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রার্থী জাক শিরাককে বিপুল ভোট দিয়ে জয়ী করেন, ল্য পেন প্রত্যাখ্যাত হন।

কিন্তু গত পনেরো বছরে ফ্রান্সের সমাজ অনেক বদলে গিয়েছে। ন্যাশনাল ফ্রন্টের বিরুদ্ধে সংহতি এখন অনেক দুর্বল। দুই প্রধান দল, রিপাবলিকান এবং সোশ্যালিস্টরা কেউই দ্বিতীয় পর্বের দৌড়ে নেই। ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে বেড়ে চলা বৈষম্য, সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার হ্রাস, সরকারি পরিষেবার অবক্ষয়, আমেরিকায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয়, ব্রিটেনের ইইউ ত্যাগের সিদ্ধান্ত— সব মিলিয়ে মানুষের মনে এই ধারণা জোরদার হয়েছে যে, বিশ্বায়ন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন ব্যর্থ। অভিবাসী এবং ইসলামের প্রতি সমাজে বিরূপতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জাতি-রাষ্ট্র এবং তার সীমান্তের মহিমা উত্তরোত্তর বাড়ছে। সিরিয়া, ইরাক ও লিবিয়ায় হানাহানি এবং আফ্রিকায় ভূতপূর্ব ফরাসি উপনিবেশগুলিতে অস্থিরতার ফলে বিপুল সংখ্যায় শরণার্থীর প্রবাহে পরিকাঠামো ও পরিষেবার ওপর আরও চাপ পড়েছে। ফ্রান্সের ভূখণ্ডে স্বদেশি ও বিদেশি সন্ত্রাসীদের উপর্যুপরি আক্রমণ বুঝিয়ে দিয়েছে, প্রধানত ফ্রান্সের প্রাক্তন উপনিবেশগুলি থেকে আসা অভিবাসীদের সমাজের অঙ্গীভূত করে নেওয়ার কাজটা ভাল ভাবে হয়নি। এর পাশাপাশি মনে রাখতে হবে, ২০০২ সালে ফ্রান্সে বেকারত্বের অনুপাত ছিল প্রায় ৮ শতাংশ, ২০১৭ সালে সেটা ১০ শতাংশ ছাড়িয়েছে। ২৪ বছরের কম বয়সিদের ক্ষেত্রে অনুপাতটা ২৪ শতাংশ। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বর্তমান প্রেসিডেন্ট ফ্রঁসোয়া ওলাঁদ-এর জনপ্রিয়তায় অস্বাভাবিক পতন। এখন সেই হার ২০ শতাংশেরও নীচে। অবস্থার চাপে পড়ে তিনি দ্বিতীয় বার প্রার্থী হননি, ১৯৫৮ সালের ৪ অক্টোবর ফ্রান্সের পঞ্চম প্রজাতন্ত্রের সূচনার পর থেকে এমন ঘটনা এই প্রথম ঘটল।

প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী ইমানুয়েল মাক্‌রঁ অনেক দিক থেকেই গতানুগতিক ধারার বাইরে। তাঁর বয়স মাত্র ৩৯। কোনও রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা নেই তাঁর। এক বছর আগে অঁ মার্শ (অভিযাত্রা) নামক একটি রাজনৈতিক আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন তিনি। তিনি অতীতে ওলাঁদ-এর অন্যতম পরামর্শদাতা ছিলেন, ওলাঁদ প্রেসিডেন্ট হয়ে তাঁকে অর্থনীতি মন্ত্রকের দায়িত্ব দেন। গত অক্টোবরে তিনি সেই মন্ত্রিপদে ইস্তফা দেন। তিনি বাম বা দক্ষিণ, দুই পন্থা থেকেই নিজেকে সরিয়ে রেখেছেন, এমনকী তাঁকে মধ্যপন্থীর তকমা দেওয়াও শক্ত। এটা দেশের সমাজে ও রাজনৈতিক মহলে তাঁর জনপ্রিয়তা বাড়িয়েছে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রথম পর্বে তিনি প্রায় ২৪ শতাংশ ভোট পেয়ে এক নম্বর স্থানে ছিলেন। তিনি বড় ব্যাঙ্ক এবং অর্থ লগ্নি সংস্থার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, অতীতে রথসচাইল্ড ব্যাঙ্কের উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত থেকেছেন। আশঙ্কা আছে যে, তিনি ক্ষমতা পেয়ে সমাজের উচ্চবর্গের অনুকূল নীতি অনুসরণ করবেন এবং তার ফলে গরিবদের সমস্যা আরও বাড়বে।

অন্য দিকে, ন্যাশনাল ফ্রন্ট নেত্রী মারিন ল্য পেন তাঁর দলের অতি-দক্ষিণ, ফ্যাসিভাবাপন্ন চরিত্র থেকে অনেকটা সরে এসেছেন। তাঁর চরমপন্থী বাবা, দলের প্রতিষ্ঠাতা জঁ মারি ল্য পেনকে এক পাশে সরিয়ে তিনি দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যাগুলিকে নিজের রাজনীতির কেন্দ্রে আনতে তৎপর। বিশ্বায়নের অর্থনীতিতে সাধারণ মানুষ দারিদ্রের শিকার, মারিন তাঁদের কথা বলেছেন, যাতে সমাজে তাঁর এবং তাঁর দলের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ে। এর ফলে এখন আর ন্যাশনাল ফ্রন্ট আগের মতো একঘরে হয়ে নেই, অন্যরা কেউ কেউ তার সঙ্গে হাত মেলাতে রাজি। আইনশৃঙ্খলার অবনতি, সন্ত্রাসী হানা এবং পশ্চিম এশিয়া ও উত্তর আফ্রিকা থেকে প্রধানত মুসলিম শরণার্থীদের বিপুল স্রোত পুলিশ, সেনা এবং প্রশাসনকর্মীদের একটা বেশ বড় অংশকে ন্যাশনাল ফ্রন্টের দিকে ঠেলে দিয়েছে।

ফরাসি ভোটদাতাদের সামনে নির্বাচনটা তাই সহজ ছিল না। দুই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী আসলে বিশ্বায়িত ধনতন্ত্রের সংকট থেকে উঠে আসা দুটি পরস্পরবিরোধী স্বার্থগোষ্ঠীর প্রতিনিধি। মাক্‌রঁ আছেন বিশ্বায়নের পক্ষে, অর্থনীতিতে রাষ্ট্রের ভূমিকা কমিয়ে বাজারকে আরও বেশি জায়গা করে দিতে চান তিনি, চান আরও প্রসারিত ইউরোপ। অন্য দিকে মারিন জাতীয়তাবাদের ধ্বজাধারী, তিনি চান প্রবল রাষ্ট্র, তার নিয়ন্ত্রণে থাকবে যথেষ্ট জনপরিষেবা, কিন্তু তার সুযোগ পাবেন কেবল দেশের বৈধ নাগরিকরা, এবং সীমান্তের বাধা হবে অনেক বেশি জোরদার, যাতে অভিবাসীদের প্রবেশের পথ অনেক বেশি কঠিন হয়ে যায়।

মারিন ল্য পেন বড় ব্যবধানে পরাজিত হয়েছেন বটে, কিন্তু তাঁর দলের স্বীকৃতি বাড়ছে, গত বারের তুলনায় জনসমর্থনের অনুপাত দ্বিগুণ হয়েছে। তাই প্রশ্নটা এখন আর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সীমিত নেই। আগামী মাসে দেশে পার্লামেন্ট নির্বাচন। ৫৭৭টি আসনের ফরাসি আইনসভায় এখন ন্যাশনাল ফ্রন্টের সদস্য মাত্র ২ জন। রিপাবলিকান এবং সোশ্যালিস্ট, দুই দলেই অভ্যন্তরীণ বিরোধ প্রবল। ইমানুয়েল মাক্‌রঁ তাঁর শিবিরের পরিধি প্রসারিত করতে তৎপর, তিনি নিজের দলের নাম দিয়েছেন লা রেপুব্লিক অঁ মার্শ, অর্থাৎ অভিযাত্রায় প্রজাতন্ত্র। বিভিন্ন রাজনৈতিক মতামতের মানুষকে তিনি নিজের শিবিরে নিয়ে আসতে চান, তাঁর লক্ষ্য আইনসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন।

কিন্তু জঁ লুক মেলঁশঁ-কে অগ্রাহ্য করার উপায় নেই। লা ফ্রাঁস য়্যাঁসুমিস (অদম্য ফ্রান্স) দলের এই নায়ক প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রথম পর্বে প্রায় ২০ শতাংশ— সংখ্যায় ৭৫ লক্ষ— মানুষের ভোট পেয়ে চতুর্থ হয়েছেন। কট্টর বামপন্থী আর্থসামাজিক কর্মসূচির জোরে তিনি একাই সোশ্যালিস্ট পার্টিকে পথে বসিয়ে দিয়েছেন, যে কর্মসূচির প্রভাব এখন ইউরোপে, বিশেষত স্পেন গ্রিস ইতালি পর্তুগালের মতো মহাদেশের দক্ষিণের দেশগুলিতে বাড়ছে।

৮ মে, সোমবার, প্যারিসে একটা বিরাট মিছিল হল। প্রধানত জঁ লুক মেলঁশঁ-এর সমর্থকরা ছিলেন তাতে। ইমানুয়েল মাক্‌রঁ-র জয়ে তাঁরা চিন্তিত। ওই মিছিল থেকে তাঁরা খুব জোর দিয়ে বললেন, মনে রাখতে হবে মানুষ ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছেন, প্রেসিডেন্টকে কোনও ব্ল্যাঙ্ক চেক দেননি।

এ বারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দুটি ধারণা সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে: ‘সিস্টেম-বিরোধী’ এবং ‘বিকল্প’। চূড়ান্ত পর্বের দুই প্রার্থীই মূলধারার বাইরে থেকে এসেছেন, তাঁরা কেউই দেশের আর্থিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক সমস্যার দায়ভাগ স্বীকার করেননি। দুজনেই বলেছেন, বর্তমান সিস্টেমই সংকটের মূলে। দুজনেই প্রচলিত কাঠামোটা পালটানোর কথা বলেছেন। কী ভাবে? উত্তর মেলেনি।

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফল পাওয়া গিয়েছে, কিন্তু তার পরিণাম কী, সেটা একেবারেই পরিষ্কার নয়।

প্যারিসে ‘মাল্টিডায়মেনশন’ পত্রিকার সম্পাদক

vote Result out France consequence
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy