গ্রিক চিকিৎসক হিপোক্রেটিস-এর প্রণীত শপথ বাতিল করিতে চাহে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ-ঘনিষ্ঠ চিকিৎসক সংগঠন, ন্যাশনাল মেডিকোস অর্গানাইজেশন। সম্প্রতি গুজরাতের অধিকাংশ মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রছাত্রীদের চরক সংহিতায় উল্লিখিত আত্রেয় অনুশাসন পাঠ করানো হইল। ওই চিকিৎসকেরা হয়তো নজর করেন নাই যে, বিশ্বের অধিকাংশ মেডিক্যাল কলেজে এখন হিপোক্রেটিসের প্রাচীন শপথ গ্রহণ করা হয় না। সমসাময়িক কোনও একটি সংস্করণ পাঠ করা হয়। ইউরোপে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জেনিভাতে চিকিৎসকদের শপথের একটি সংস্করণ লেখা হয়, যাহা রোগীর মানবাধিকার এবং চিকিৎসকের সামাজিক দায়বদ্ধতাকে গুরুত্ব দিয়াছিল। সেটি সর্বত্র জনপ্রিয় হইয়াছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মেডিক্যাল কলেজগুলিতে যে শপথটি অধিক প্রচলিত, তাহাতে অতিরিক্ত চিকিৎসার প্রবণতা হইতে সংযত হইবার, এবং রোগীকে একটি রোগ হিসাবে না দেখিয়া সম্পূর্ণ এক মানুষ হিসাবে দেখিবার নির্দেশ রহিয়াছে। অনেক মেডিক্যাল কলেজে শিক্ষক ও ছাত্রেরা তাঁহাদের শপথবাক্য নিজেরাই লিখিয়াছেন। অর্থাৎ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসার সংকটের রূপ যত বদলাইতেছে, চিকিৎসকের শপথবাক্যও বদলাইয়াছে। এই স্বাভাবিক বিবর্তন সংঘ-ঘনিষ্ঠ চিকিৎসকদের দৃষ্টিতে বিচ্যুতি। সমগ্র বিশ্ব বদলাইবে, ভারত থাকিবে দুই হাজার বৎসর পূর্বের পরিস্থিতিতে। তাই চরক সংহিতায় ফিরিতে হইল গুজরাতের তরুণ-তরুণীদের।
অথচ আত্রেয় অনুশাসনেই বলা হইয়াছে, ‘যে বুদ্ধিমান, সমগ্র বিশ্ব তাহার শিক্ষক। যে মূর্খ, বিশ্ব তাহার শত্রু।’ সেখানে স্পষ্ট নির্দেশ, জীবনের বিজ্ঞান, চিকিৎসার জ্ঞানের কোনও সীমা নাই। অতএব কোনও অভিযোগ না করিয়া শিক্ষার্থী অপরের নিকট, এমনকী বিদ্বিষ্ট ব্যক্তির নিকটও দক্ষতার পাঠ লইবে, তাহার কথামত কাজ করিবে। অর্থাৎ চরক সংহিতার অনুশাসনে সংকীর্ণতার স্থান নাই। যাহা স্থানীয়, তাহাই উত্তম, বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে তাহা যদি গ্রহণযোগ্য না হয়, নীতির প্রশ্নেই বা হইবে কেন? চিকিৎসকের কোনও কোনও মৌলিক নীতি সকল দেশ ও কালেই সমান। রোগীর ক্ষতি না করিবার, পারিবারিক গোপনীয়তা বজায় রাখিবার অঙ্গীকার হিপোক্রিট ও চরক, উভয়েই রহিয়াছে। আধুনিক শপথগুলিতেও রহিয়াছে। কিন্তু চরকের ভারতের সহিত আজিকার ভারতের সমাজেরও যথেষ্ট পার্থক্য ঘটিয়াছে। পাশ্চাত্যে আজ যে নৈতিক নির্দেশ মানা হইতেছে, তাহার চাইতে দুই সহস্রাব্দের পূর্বের নীতি একবিংশের ভারতের জন্য অধিক গ্রহণযোগ্য হইবে কোন হিসাবে? ভারতীয়রা কি আরশোলা? তাহাদের কি বদলাইতে নাই?
হিন্দু শাস্ত্রগ্রন্থগুলিও যুগধর্ম, কালধর্ম মানিতে নির্দেশ দেয়। অতএব সংঘ-ঘনিষ্ঠ চিকিৎসকেরা চরককে টানিয়া আনিয়া শাস্ত্রের দৃষ্টিতেও প্রশংসনীয় কিছু করেন নাই। তাঁহাদের বক্তব্য, চরকের শপথ লইতে ক্ষতি কী? তাহার উত্তর, ক্ষতি আছে বইকি। আত্রেয় অনুশাসন বলিতেছে, যাহারা রাজার প্রতি বিদ্বিষ্ট, এবং রাজা যাহাদের বিদ্বেষ করে, তাহাদের চিকিৎসা করা চলিবে না। রোগীর চরিত্র ও আচরণ বিচার করিয়া চিকিৎসা করিবার কথাও বলা হইয়াছে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এই শপথ অচল। বরং জেনিভা শপথের অনুসরণ করিয়া চিকিৎসককে শপথ লইতে হইবে, রোগীর জাত-বর্ণ-মতাদর্শ নির্বিশেষে তাহার চিকিৎসা করিব। শত্রুরও চিকিৎসার অধিকার রহিয়াছে, এই চিন্তা হইতেই রেড ক্রস আন্দোলনের শুরু। অনুরূপে, কোনও মহিলা রোগীর সহিত পুরুষ অভিভাবক না থাকিলে তাহার চিকিৎসা করা চলিবে না, আজ এই অনুশাসন হাস্যকর। অতীতকে আঁকড়াইয়া বাঁচিবার এই ভ্রান্ত প্রচেষ্টা ত্যাগ করুক সংঘ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy