Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

ভয় যখন ভয়ের প্রতিষেধক

এখানে পড়ে থাকাও সহজ নয়। আশ্রয় খুড়তুতো দাদার বাড়ি। বাড়ি তো নয়, পলিথিন শিট টাঙিয়ে থাকা। খাস জায়গা, কবে তুলে দেবে ঠিক নেই।

কুমার রাণা
শেষ আপডেট: ২২ মে ২০১৮ ০০:০৪
Share: Save:

ফ্ল্যাটবাড়ির অখণ্ড বিচ্ছিন্নতা। দেওয়ালের কানও কারও কথা শুনতে পাবে না। তবু গোসাবা থেকে পালিয়ে আসা মানুষটা এতটাই ফিসফিস করে কথা বলছিলেন যে আমাকে ওঁর মুখের কাছে কান পাততে হচ্ছিল। বললাম, ‘‘একটু জোরে বলুন না, এখানে আপনাকে কেউ দেখছে না, কেউ শুনতে পাবে না।’’ অর্ধস্ফুট জবাব, ‘‘তোমরা শহরের লোকরা বুঝবে না। সাত দিন ঘরছাড়া। তার আগে এক মাস ধরে নিয়ম করে হুমকি, ‘মারব, ঘর জ্বালিয়ে দেব!’ জ্বালিয়েওছে কারও কারও। ভোটের ক’দিন আগে রাতের বেলা দেওয়ালে কারা যেন বিরোধী প্রার্থীর পোস্টার মেরে গেল। ব্যস, সকাল থেকে ঝামেলা। আমাদের বেদম মারল। দাদার মাথা ফেটে গেল। আমার সারা গায়ে এখনও ব্যথা। পুলিশের কাছে যাওয়ার সাহস নেই। ওরা বলে গেল, গাঁয়ে থাকা চলবে না। কী করব, পালিয়ে এলাম। ভোট হয়ে গিয়েছে, ওরা জিতেও গিয়েছে, কিন্তু রাগ যায়নি, রোজ এক বার করে নাকি হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। তাই এখানে পড়ে আছি।’’

এখানে পড়ে থাকাও সহজ নয়। আশ্রয় খুড়তুতো দাদার বাড়ি। বাড়ি তো নয়, পলিথিন শিট টাঙিয়ে থাকা। খাস জায়গা, কবে তুলে দেবে ঠিক নেই। এমনিতেই সুন্দরবন আর লোক ধরে রাখতে পারছে না। তার ওপর আয়লার পরে তো বেঁচে থাকাই দায়। হাজারে হাজারে লোকে এ দিক ও দিক ছড়িয়েছিটিয়ে গিয়েছে। খুড়তুতো দাদাও আর এক পাড়াতুতো দাদার সঙ্গে কলকাতায়। শুধু সুন্দরবন কেন, জলঙ্গী, রতুয়া, মাদারিহাট, গোপীবল্লভপুর— পশ্চিমবাংলার তামাম গ্রাম-মাতৃকা কি ছেলেদের ঘরে ধরে রাখতে পারছে? পাড়ার এক জন কোনও ভাবে পৌঁছে গেল তামিলনাডুর পোলট্রি ফার্মে— তার পিছু ধরে চলল বাকিরা। তার পরও যারা থেকে গেল বৌ-বাচ্চা-ঘরের টানে, কায়ক্লেশকে বিধিলিপি মেনে নিয়েও তাদের শান্তি নেই।

‘‘কেন নেই? অসুবিধেটা কোথায়?’’

‘‘নিজের মতো খেটে খাব, তার উপায় নেই। পার্টির কাছে মাথা বাঁধা রাখতে হবে। যখন ডাকবে মিছিলে যেতে হবে। আচ্ছা, আমি যদি অন্য কোনও পার্টি করি, অন্য কাউকে ভোট দিই, তাতে তোমার গায়ে এত জ্বালা কেন? আমি তো তোমার কাছে কিছু চাইনি। তোমরা যে টাকার ভাগ বখরা করো, আমরা সব জানি, তা নিয়ে তো কিছু বলিনি। দু’টাকা কিলো চাল দিচ্ছ। বেশ কথা। কিন্তু চাল দিচ্ছ বলেই তোমাকে ভোট দিতে হবে, এটা কেমন কথা? কিন্তু কে শোনে? বলেছিল ভোটে অন্য কেউ দাঁড়াতেই পারবে না। তবু লোকে দাঁড়িয়ে গেল। সেটাই রাগ। প্রার্থীকেও গাঁ-ছাড়া হয়ে যেতে হল।’’

‘‘সে তো ওদের পার্টির লোকদেরও অন্যরা মারছে। কাগজে বেরিয়েছে, যত লোক খুন হয়েছে তার অর্ধেকের বেশি তৃণমূলের।’’

‘‘হতে পারে। মারামারি হলে কেউ না কেউ তো মরবে। কথাটা কী জানো, মরার পর কেউ আর পার্টির লোক থাকে না। তারা তো মড়া। তারা কি আর বলতে আসবে, আমি অমুক পার্টির? যে মরে গেল সে তো এক প্রকার তরে গেল। এ বার দগ্ধে দগ্ধে মরবে তো তার বৌ ছেলেমেয়ে বুড়ো মা-বাপ। তাদের কি পার্টি দেখবে? বড় জোর কিছু টাকা দেওয়া হল, ক্ষতিপূরণ। সে টাকায় তাদের ক’দিন চলবে? টাকা দিয়ে জীবন কেনা যায়? আগে মারবে, তার পর বলবে টাকা নাও, এটা আবার কোন নীতি?’’

‘‘না, না, আপনি বোধ হয় ভুল করছেন, টাকা তো যারা মারছে তারা দিচ্ছে না, টাকা তো দিচ্ছে সরকার।’’

‘‘না, আমি ঠিকই বলছি। মারছে তো সরকারই। সরকার যদি বাঁচাতে না পারে, সেটা মারার সামিল নয়? সরকারেরই তো আমাদের বাঁচাবার কথা, না হলে সরকার আছে কেন? দেশের লোক কার ভরসায় থাকবে? যারা মারছে, মারবার হুমকি দিচ্ছে, তারা বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আসল কথাটা অন্য, মরছে তো গরিব লোকে, সরকার তো গরিব লোকের জন্য নয়।’’

বাস্তবিক, গরিবকে দয়াদাক্ষিণ্য করা যায়, কিন্তু সে স্বাধীন ভাবে চলবে, তার কোনও স্বাধীন মতামত থাকবে, শাসক এটা মেনে নেয় কী করে? তাকে দু’চার কাঠা জমি দেওয়া যায়, তার মজুরি একটু বাড়িয়ে দেওয়া যায়, তার জন্য সস্তায় অন্নের সংস্থান করা যায়, কিন্তু সে নিজে নিজের কপাল বদলানোর স্বপ্ন দেখবে এটা বড্ড বাড়াবাড়ি। মুশকিল হল, বারংবার মার খেয়েও লোকে এই বাড়াবাড়ির ‘ভুল’টা করতেই থাকে। সে ভুলের পরিণতিতে শাসক বদলায়, লাল হয় সবুজ, সবুজ গেরুয়া, কিন্তু লোকের আকাঙ্ক্ষা বদলায় না। ভোটের আগে পুরুলিয়া শহরে শাসক দলের এক নেতা বলেছিলেন, ‘‘জঙ্গলমহল আমাদের দুর্ভেদ্য ঘাঁটি, সরকার উন্নয়ন করে ভাসিয়ে দিয়েছে।’’ সেই দিনই সরকারি খাদ্য সুরক্ষা প্রকল্পের সুবিধা পেয়ে জীবনযাপনে কিছুটা উন্নতি আনতে পারা এক গ্রামবাসী আবার জানিয়েছিলেন, ‘‘চাল দিচ্ছে বলে তো মাথা কিনে নেয়নি। দু’টাকা বেঁটে দু’শো টাকা নিজেদের পকেটে ভরবে, অথচ কেউ কিছু বলতে পারবে না, এটা কি চলে? ভোট যদি দিতে পারি, মা মনসার কিরা, উলটে দেব।’’ একই কথা শোনা গিয়েছে গোপীবল্লভপুরে, গোসাবায়, কালচিনিতে।

‘‘যাদের দেবেন, তারাও তো তা-ই করবে, তার বেলা?’’

‘‘কত দিন করবে? ভোটটাকে তো আর যুগ যুগ ধরে আটকে রাখতে পারবে না। আজ না হোক কাল ভোট হবে। যারা আমাদের মাথা কিনতে চাইবে তাদের মুখে ঠিক ঝামা ঘষে দেব।’’

গোসাবা থেকে পালিয়ে আসা মানুষটির অস্ফুট কণ্ঠেও একই কথার প্রতিধ্বনি, ‘‘কত জনকে মারবে? কত দিন ঘরছাড়া করে রাখবে? রাস্তা একটা বেরোবেই বেরোবে। যেখানে লোকে ভোট দিতে পেরেছে, সেখানেই উচিত শিক্ষা দিয়ে দিয়েছে।’’

অবশ্য মানুষ যে বৃহত্তর স্বাধীনতা চাইতে পারেন, রাজনীতি থেকে সেই বিশ্বাস ক্রমশ বিলীন। সাম-দান-দণ্ড-ভেদ-এর বাইরে ভাববার বোধটাই যেন অবশিষ্ট নেই। বামফ্রন্ট সূর্য যখন মধ্যগগনে, তখন জঙ্গলমহলে, দার্জিলিঙে, কোচবিহারে ব্যক্ত অসন্তোষকে নেতৃত্ব বিচ্ছিন্নতাবাদের উস্কানি বা লোকের বোঝার ভুল বলে এড়িয়ে গিয়েছেন। তাঁরা ভুলে গিয়েছিলেন বাম সরকারের বিপুল সমর্থনভিত্তির কারণ শুধু জমি বা মজুরি ছিল না, ছিল অন্য কিছু— মানুষের আত্মমর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার স্বাধীনতা। সেই স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হওয়ার বোধ থেকে ২০১১। একই ভাবে আজ জঙ্গলমহলে, এবং অন্যত্র যেখানে লোকে নিজের মতো করে ভোট দিতে পেরেছেন সে সব জায়গায় ভোটের বাক্সে যে অসন্তোষ, তৃণমূলের নেতারা তাকে কর্মসূচি রূপায়ণের ফাঁকফোকর, মাওবাদীদের অনুপ্রবেশ ইত্যাদির দোহাই দিয়ে এড়িয়ে যাচ্ছেন। আবার সদ্য সদ্য কিছু সাফল্য পাওয়া বিজেপি মনে করছে এটা তাদের প্রাক-নির্বাচনী পৌরুষ প্রদর্শন, মারের বদলে মার, শ্মশানে পাঠিয়ে দেওয়ার হুমকির পুরস্কার। এটাই শাসকীয় স্বভাব, রাজনৈতিক ক্ষমতা যার নির্মাতা। যত ক্ষণ ক্ষমতা থাকে তত ক্ষণ শাসক নিজেকে অজেয় বলে মনে করে। এই শাসকীয় অহঙ্কারের সঙ্গে মানুষের স্বাধীন ইচ্ছার নিরন্তর দ্বন্দ্বে ভারতীয় গণতন্ত্রের গঠন। ঠিক এই কারণেই প্রতিষ্ঠান, নৈতিক পরম্পরা, এবং প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য প্রতিবাদের উপর এত আক্রমণ। কেন্দ্রীয় সরকার ভাঙছে সংবিধান, সংসদ, বিচারবিভাগ, রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক; রাজ্য সরকার ভাঙছে নির্বাচন কমিশন, আমলাতন্ত্র, প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা। বহু কষ্টে অর্জিত ভারতীয় গণতন্ত্রের একটা স্বরূপ, নির্বাচন-সহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান; সেখানে শাসক ও প্রজাকুলের স্বার্থের সংঘাত। শাসকরা সে সব প্রতিষ্ঠানকে সম্পূর্ণ মূক-বধির করে তুলতে পারছে না। কর্নাটকে চলমান রাজনৈতিক লড়াইয়ে অমিত পরাক্রমশালী মোদী-শাহ জুটির পরাজয় থেকে জঙ্গলমহলে তৃণমূল কংগ্রেসের নির্বাচনী ব্যর্থতা থেকে এই বার্তাটা পড়তে না পারার কারণ নেই।

অস্বীকার করার উপায় নেই, শাসকীয় রাজনীতির ঠিকাদাররা লোকের মনে ভয়টা ভাল ভাবেই ঢুকিয়ে দিতে পেরেছে। গোসাবার লোকটি যে হাঙ্গামাবাজদের অধরা দূরত্বেও ফিসফিস করে কথা বলছিলেন সে তো তাঁর মনে বাসা বাঁধা ভয় থেকেই। কিন্তু, একেবারে সাম্প্রতিক ইতিহাসও বলে, ভয় ভয়ের প্রতিষেধকও বটে, যা ভয়ের বিরুদ্ধে লড়বার শক্তি দেয়। সঙ্কট যতটা বাস্তব, তাকে নিজের মতো করে মোকাবিলার জন্য লোকেদের স্ফুট-অস্ফুট প্রতিজ্ঞাটাও ততটাই সত্যনিষ্ঠ। রাজনীতির কারবারিদের কানে সে বার্তা পৌঁছোক বা না পৌঁছোক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Ruler invincible power
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE