Advertisement
০৩ মে ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

গণতন্ত্রের শর্ত

প্রশ্ন শুধু শিষ্টাচারের নহে। প্রশ্ন গণতন্ত্রের প্রতি দায়িত্বের। গণতন্ত্রে শাসক দলের গুরুত্ব যতখানি, বিরোধীদের গুরুত্ব তাহার তুলনায় তিলমাত্র কম নহে।

শেষ আপডেট: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০০:৫৯
Share: Save:

আমরা ২৩৫, উহারা ৩০’-এর দম্ভের অবসানে তিনি রাজ্য রাজনীতির অলিন্দে শিষ্টাচারের সুবাতাস বহিয়া আনিয়াছিলেন। বিধানসভা নির্বাচনের বিপুল জয় তাঁহাকে বিরোধীদের অবজ্ঞা করিতে প্ররোচিত করে নাই। বরং, তিনি শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে পূর্বসূরিদের আমন্ত্রণ জানাইয়াছিলেন, করজোড়ে স্বাগত জানাইয়াছিলেন। সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কি আজকের মুখ্যমন্ত্রী হারাইয়া ফেলিলেন? বিধানসভায়— রাজ্যে গণতন্ত্রের শীর্ষ পীঠে— দাঁড়াইয়া তিনি কেন বলিবেন, বিরোধীদের সঙ্গে যত কম দেখা হয়, ততই ভাল? কেন তিনি বিরোধীদের ‘ওয়াক আউট’ করিতে বলিবেন? আত্মপক্ষ সমর্থনে তিনি বলিতে পারেন, এই অশিষ্টতাই ভারতীয় রাজনীতির বর্তমান ধারা। জ্যোতি বসু বা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের বঙ্গীয় (অপ)সংস্কৃতি যদি এখন ইতিহাস হয়ও, মাত্র চার বৎসর পূর্বেও লোকসভায় বিজেপি কংগ্রেসকে ‘প্রধান বিরোধী দল’-এর মর্যাদা দেয় নাই, কারণ ন্যূনতম প্রয়োজনীয় আসনসংখ্যা ছিল না কংগ্রেসের। অথবা, তিনি বলিতে পারেন, তাঁহার আচরণ সর্বদা অশিষ্ট নহে। কয়েক মাস পূর্বেই তিনি অসুস্থ বুদ্ধদেববাবুকে দেখিতে তাঁহার বাড়িতে হাজির হইয়াছিলেন, বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের অসুস্থতার খোঁজখবর লইয়াছিলেন। কিন্তু, তিনিও জানেন, কোনওটিই যুক্তি নহে। অন্য কাহারও অশিষ্টতা দিয়া যেমন নিজের অশিষ্টতাকে ‘বৈধ’ করিয়া তোলা যায় না, তেমনই নিজের একটি শিষ্ট আচরণ অপর কোনও অশিষ্টতার পরিপূরক হইতে পারে না। বস্তুত, যাঁহার আচরণে শিষ্টতার সন্ধান মিলে, প্রত্যাশাও তাঁহার নিকট থাকে। তাঁহার বিচ্যুতি আরও বেশি পীড়াদায়ক হয়।

প্রশ্ন শুধু শিষ্টাচারের নহে। প্রশ্ন গণতন্ত্রের প্রতি দায়িত্বের। গণতন্ত্রে শাসক দলের গুরুত্ব যতখানি, বিরোধীদের গুরুত্ব তাহার তুলনায় তিলমাত্র কম নহে। প্রথম কারণ, উভয় পক্ষই মানুষের দ্বারা নির্বাচিত, ফলে উভয়ের মতই মানুষের মতামতের প্রতিফলক। দ্বিতীয় কারণ, ক্ষমতার ঔদ্ধত্যে শাসকরা যদি কর্তব্যচ্যুত হন, বিরোধীদের সমালোচনা তাঁহাদের পথে ফিরাইয়া আনিতে পারে। ভিন্ন মতের আদানপ্রদানের, এমনকী সংঘাতের, মাধ্যমে অগ্রসর হওয়াই গণতন্ত্রের ধর্ম। অতএব, বিরোধীকে বলিতে দেওয়া শাসকের অপরিহার্য কর্তব্য। বিশেষত, যেখানে আসনসংখ্যায় বিরোধীরা শাসকের তুলনায় ক্ষীণবল, সেখানে। একদা এই রাজ্যে, এই দেশেই সেই রীতি ছিল। তরুণ বামপন্থী বিধায়ক জ্যোতি বসু যাহাতে বিধানসভায় বলিবার জন্য যথেষ্ট সময় পান, তাহা নিশ্চিত করিতেন স্বয়ং বিধানচন্দ্র রায়। সরকারের কঠোর সমালোচনা করিবার জন্য জওহরলাল নেহরুর নিকট বিশেষ অধিবেশনের দাবি পেশ করিয়াছিলেন অটলবিহারী বাজপেয়ী। তাঁহাকে নিরাশ হইতে হয় নাই।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে এই কথাগুলি স্মরণ করাইয়া দিতে হইতেছে, তাহা দুর্ভাগ্যের। রাজনৈতিক অশিষ্টতা এবং বিরোধীদের জমি না ছাড়িবার প্রবণতা কতখানি মারাত্মক হইতে পারে, তিনি অভিজ্ঞতায় জানেন। বামফ্রন্ট আমলে তিনি ক্ষমতার সিঁড়ির ভুল প্রান্তটিতে ছিলেন। ক্ষমতাসীন হইয়া তিনি সেই আচরণ ফিরাইয়া দিবেন না, তেমন প্রত্যাশা ছিল। প্রতিশোধ লওয়া অতি সহজ, অশিষ্ট হইতেও প্রকৃত শক্তির প্রয়োজন নাই। ‘আমার প্রতি যে অন্যায় করিয়াছে, তাহার প্রতিও আমি ন্যায়ের, ন্যায্যতার পথেই থাকিব’ এই অবস্থানটি অনেক বেশি শক্তি দাবি করে। মুখ্যমন্ত্রী কি সেই শক্তির পরিচয় দিতে ব্যর্থ হইবেন? উপনির্বাচনের লড়াইয়ে পর্যুদস্ত হওয়া মানেই যে মতপ্রকাশের অধিকারটিও খোয়ানো নহে, বরং এই দুর্বলতর মুহূর্তেই বিরোধীদের গণতান্ত্রিক পরিসর রক্ষায় শাসককে অধিকতর মনোযোগী ও যত্নশীল হইতে হইবে, মুখ্যমন্ত্রী কি তাহা স্বীকার করিবেন না?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Ruler Opponents Mamata Banerjee TMC
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE