যাহা ছিল ব্যতিক্রম, তাহা যখন নিয়ম হইয়াছে। বিধ্বংসী ঝড়, অতিবৃষ্টি, প্রবল খরা প্রভৃতি প্রাকৃতিক বিপর্যয় আগে কালেভদ্রে ঘটিত, এখন তাহা ঘনঘন ঘটিতেছে। এবং এই ধারাই বজায় থাকিবে, হুঁশিয়ারি দিয়াছেন বিজ্ঞানীরা। মূলে আছে বিশ্ব উষ্ণায়ন-সঞ্জাত পরিবর্তন। কী করিয়া উষ্ণায়ন নিয়ন্ত্রিত হইবে, তাহা লইয়া রাষ্ট্রপ্রধানেরা বহু বৈঠক করিয়াছেন। তাহাতে স্পষ্ট, পরিবেশ সুরক্ষার নীতি কার্যকর করিতে সময় লাগিবে। ইতিমধ্যে বিপর্যয় তীব্রতর হইবে, তাহার সম্ভাবনা যথেষ্ট। বিজ্ঞানীদের দাবি, অতি-বৃষ্টি বা অনাবৃষ্টির তীব্রতা বাড়িবে, এবং এই সকল দুর্যোগ প্রায় নিয়মিত দেখা দিবে। তাঁহারা ভবিষ্যদ্বাণী করিয়াছেন, প্রায় প্রতি বৎসর অতি-বৃষ্টি হইবে ভারতের পশ্চিম উপকূলে এবং পূর্ব ভারতে। মার্কিন দেশে যে তুফান পাঁচশো বৎসর অন্তর অন্তর আছড়াইয়া পড়িত ভূখণ্ডে, তাহা এখন তিরিশ বৎসর অন্তর আসিতেছে। ইহার পর তাহা হয়তো তিন কিংবা পাঁচ বৎসর অন্তর আসিবে। এগুলি কেবল ভবিষ্যতের আশঙ্কা নহে। বর্তমান পরিস্থিতিও যথেষ্ট সংকটজনক। ভারতে পর পর কয়েক বৎসর রবি মরশুমে অতি-বৃষ্টিতে ফসল নষ্ট হইয়াছে, পূর্বে যাহার নজির নাই। গত বৎসর দক্ষিণ ভারতে যে প্রবল খরা দেখা দিল, তাহা কয়েক দশকে ঘটে নাই। অতএব চূড়ান্ত প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সহিত মোকাবিলা কী উপায়ে করিতে হইবে, কী করিয়া দরিদ্র মানুষের জীবিকা সুরক্ষিত হইবে, তাহার পরিকল্পনা প্রয়োজন।
সে কাজটি সহজ নহে, তাহার ইঙ্গিত ইতিমধ্যেই মিলিয়াছে। কর্নাটকে ক্রমান্বয়ে খরার জন্য রাজ্য সরকার চাষিদের ধান চাষ না করিয়া ‘রাগি’ শস্য ফলাইতে পরামর্শ দিয়াছেন, যেহেতু তাহাতে জলের প্রয়োজন হয় কম। সেই উদ্দেশে সরকার ধানবীজ বিতরণও পূর্বের তুলনায় অনেক কমাইয়াছে। বিশেষত শুষ্ক অঞ্চলগুলিতে চাষিদের ধানচাষে নিরুৎসাহ করিতেছে সরকার। কিন্তু তাহাতে চাষিরা রুষ্ট। তাঁহাদের বক্তব্য, জলের জোগান সরকারের দায়িত্ব, চাষিদের স্বাধিকারে বাধা দেওয়া সরকারের কাজ নহে। এই সংঘাত ইঙ্গিত করে, সুষ্ঠু পরিকল্পনা না থাকিলে চটজলদি পরিবর্তনের নীতি কাজ করিবে না। খরা-আক্রান্ত চাষির দাবি মানিয়া ঋণ মকুব করিল নানা রাজ্যের সরকার। কিন্তু তাহার জন্য যে বিপুল অর্থ রাজকোষ হইতে যাইতেছে, তাহা কি প্রতি বৎসর ব্যয় করা সম্ভব? অথচ আগামী বৎসরই যে এমন বিপর্যয় ফের দেখা দিবে না, তাহার নিশ্চয়তা নাই। ক্ষতিপূরণ করিতে সরকারের টাকা ব্যয় হইলে উন্নয়ন হইবে কাহার টাকায়? নগরজীবনের ব্যবসা-বাণিজ্যেও বিলক্ষণ ক্ষতি হইতেছে দুর্যোগের তীব্রতায়।
অতএব সরকার ও নাগরিক সমাজকে দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের জন্য চিন্তা করিতে হইবে। কৃষক-সহ গ্রামীণ নানা উৎপাদকদের জন্য প্রয়োজন দুর্যোগ বিমা। ইহার ব্যবস্থা বর্তমানে কোনও কোনও রাজ্যে রহিয়াছে, কিন্তু তাহার পরিকাঠামো অত্যন্ত দুর্বল, ফলে যথাযথ প্রাপক তাহার সুযোগ পান না। সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থাও পণ্য নষ্ট হইবার ঝুঁকি কমাইবে। শহরগুলির নিকাশির সংস্কার, বর্জ্য নিষ্কাশন, পরিবহণ ও যোগাযোগের সুষ্ঠু ব্যবস্থা না করিলে দুর্ভোগ বাড়িবে, রোগও দেখা দিবে। তীব্র দুর্যোগের কথা মাথায় রাখিয়া নগরোন্নয়নের পরিকল্পনা করা প্রয়োজন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy