Advertisement
১১ মে ২০২৪
সম্পাদকীয় ২

রক্তসিক্ত বালি

রাজনীতির নিকট পুলিশ-প্রশাসন নতিস্বীকার করিলে নাগরিকের কী দশা হয়, তাহার দৃষ্টান্ত বীরভূম। অবৈধ বালির বখরা লইয়া সংঘর্ষে নয় জনের মৃত্যুর পর দশ দিন পার হইয়াছে।

শেষ আপডেট: ০৩ মে ২০১৭ ০০:৪১
Share: Save:

রাজনীতির নিকট পুলিশ-প্রশাসন নতিস্বীকার করিলে নাগরিকের কী দশা হয়, তাহার দৃষ্টান্ত বীরভূম। অবৈধ বালির বখরা লইয়া সংঘর্ষে নয় জনের মৃত্যুর পর দশ দিন পার হইয়াছে। কয়েক শত বোমা উদ্ধার হইল, কয়েক জন গ্রামবাসী গ্রেফতার হইল। কিন্তু রাজনৈতিক প্রশ্রয়পুষ্ট যে চক্র অবাধে বালি তুলিবার ও বিক্রয়ের কাজ করিতেছে, যাহা একের পর এক গ্রামকে অপরাধের আঁতুড়ঘর করিয়া তুলিতেছে, তাহাকে নিবৃত্ত, নিষ্ক্রিয় করিবার উদ্যোগ দেখা গিয়াছে কি? যথাবিহিত নিলামের মাধ্যমে যত শীঘ্র সম্ভব অবৈধ খাদানগুলির সুষ্ঠ বিলিব্যবস্থা হইবে, এবং তাহা না হওয়া পর্যন্ত সেগুলিতে পাহারা বসিবে, এমন কোনও ইঙ্গিতও মেলে নাই। আশঙ্কা হয়, এতগুলি গ্রামবাসীর মৃত্যুসংবাদ কবে সকলে বিস্মৃত হইবে তাহারই প্রতীক্ষায় রহিয়াছে পুলিশ-প্রশাসন। অবশ্য এই রীতিকে নিষ্ফল কর্ম বলা চলে না। নানা স্তরের কর্তাদের মধ্যে বিলিব্যবস্থা না করিয়া অবৈধ বালিখাদানের সম্পদ খোলাখুলি বিপণন হইতে পারিত না। দ্বারকা, ময়ূরাক্ষী ও অজয়ের তীরে শতাধিক বালিঘাট হইতে বালি উঠাইয়া চালান হইতেছে। তাহাতে রাজস্বের ক্ষতি, পরিবেশ-সংক্রান্ত সকল নিয়ম লঙ্ঘিত। এবং অপরাধের এই বিস্তৃতি গোটা জেলার জনজীবন বিষাইয়া দিতেছে। বালি-মাফিয়াদের সংঘাতে গ্রামবাসীরাও শামিল হইতে বাধ্য হইতেছেন। তাঁহাদের লড়াই কখনও রাজনৈতিক বিরোধিতা, কখনও এলাকা দখলের লড়াই বলিয়া সম্মুখে আসিতেছে।

বীরভূমবাসীর ভাগ্য মন্দ। পাথর, কয়লা, খড়ি, বালি, এমন নানা প্রাকৃতিক সম্পদ জেলার অধিবাসীদের সম্পন্ন না করিয়া বিপন্ন করিতেছে। কালো টাকার দৌরাত্ম্যে তাঁহারা নিজভূমে পরবাসী হইয়া বাঁচিয়া আছেন। অপরাধমূলক কাজ এবং কালো টাকার কুচক্রে পড়িয়া সম্মান শান্তি সকলই গিয়াছে তাঁদের। জেলার রাজনীতি যে শাসক দলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে উত্তপ্ত হইয়া ওঠে, স্থানীয় নির্বাচনগুলিও রক্তপাত না করিয়া সম্পন্ন হয় না, তাহা এই অবৈধ লুঠের ভাগ দখলের লড়াই। প্রকাশ্যে গুলি, বোমাবাজি, খুনোখুনি বার বার ঘটিয়াছে। এই বালিকে কেন্দ্র করিয়াই কম অশান্তি হয় নাই বীরভূমে। প্রতিবারই এমন ঘটনার তদন্ত ও বিচার করিতে গিয়া প্রশাসন যাহা করিয়াছে, তাহাকে বলা চলে প্রশাসনের ভূমিকায় অভিনয়। যে সকল নেতা-কর্মী এই কাজগুলিতে মদত দিতেছে, এমনকী সরাসরি যুক্ত রহিয়াছে, তাহাদের জিজ্ঞাসাবাদেরও সাহস দেখায় নাই পুলিশ। বরং জেলার ছোটবড় নেতাই পুলিশকে নিয়মিত হেনস্থা করিতেছে।

মন্ত্রী-সাংসদদের রাজ্যবাসী ভোট দেন, কিন্তু বেতন দেন সরকারি কর্মীদের। তাঁহাদের প্রধান কর্তব্য নাগরিকের প্রতি। কিন্তু চাকরি বাঁচাইতে তাঁহারা এতই ব্যস্ত যে নাগরিকের মৃত্যুও তাঁহাদের স্পর্শ করিতে পারে না। বদলি রুখিতে, পদোন্নতি নিশ্চিত করিতে, উৎকোচ আদায় করিতে তাঁহারা এমনই নিবিষ্ট হইয়াছেন যে নিজেদের মৌলিক কর্তব্যটি ভুলিয়াছেন। নিষ্ক্রিয়তার দ্বারা রাজ্যবাসীকে বিপন্ন করিতেছেন সরকারি কর্তারা। ইহার অধিক শোচনীয় আর কী হইতে পারে? নয়টি গ্রামবাসীর একযোগে মৃত্যুর মতো ভয়ানক ঘটনাও তাঁহাদের পরিস্থিতির ভয়াবহতা সম্পর্কে সজাগ করিতে পারে নাই। নিজেদের সম্মান তাঁহারা ভুলিয়াছেন, দেশের সম্মানও ধুলাবালিতে লুটাইতেছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Sand Mafia Birbhum
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE