Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ২

অক্সিজেন কম পড়িতেছে

অ জুহাত দিতেই পারতাম। কে না জানে, পৃথিবীর অক্সিজেন লেভেল সাংঘাতিক কমে যাচ্ছে। এক বিরাট ডাক্তারবাবু তো বলেই দিয়েছেন, অক্সিজেন কমলেই খিস্তি বাড়ে, তাই আমি একটু হাবিজাবি বকে ফেলি সভায়-সমিতিতে। কিন্তু উঁহু, অক্সিজেন সিলিন্ডারের আড়ালে লুকিয়ে থাকার বান্দা আমি নই।

শেষ আপডেট: ১১ অক্টোবর ২০১৫ ০০:০৩
Share: Save:

অ জুহাত দিতেই পারতাম। কে না জানে, পৃথিবীর অক্সিজেন লেভেল সাংঘাতিক কমে যাচ্ছে। এক বিরাট ডাক্তারবাবু তো বলেই দিয়েছেন, অক্সিজেন কমলেই খিস্তি বাড়ে, তাই আমি একটু হাবিজাবি বকে ফেলি সভায়-সমিতিতে। কিন্তু উঁহু, অক্সিজেন সিলিন্ডারের আড়ালে লুকিয়ে থাকার বান্দা আমি নই। আমার সিধে প্রশ্ন হল, ভুলটা কী করেছি? যুদ্ধে নেমেছি, গালিগালাজ করব না? আগেকার দিনে যুদ্ধের সময় বাছাই বাছাই স্ল্যাং প্রয়োগ করাকে কী যেন একটা শক্ত সংস্কৃত নামে ডাকা হত, মোদ্দা কথা, সেইটা ছিল শত্রুকে হাটাবার ও নিজেকে তাতাবার চাম্পি কৌশল। আমার দলের হয়ে বক্তৃতা দেব আর অপোজিশনকে যাচ্ছেতাই বলব না? সমর্থকদের বলব না তির মারো বা বোম ফেলো? তা হলে এত বড় জনতাকে চার্জ দেব কী করে? মিটিং করছি মানে কী? আমার ভোট বেস বাড়াচ্ছি। আমি তো ডিকশনারি অনার্স নিয়ে, থিসিস পেপারের ওরাল পরীক্ষা দিচ্ছি না! তা হলে বিরোধীদের পিস পিস কোপাবার ফ্র্যাংক আহ্বানের মধ্যে পৌরাণিক বীরত্ব না খুঁজে বালিগঞ্জের ড্রয়িং রুমে কাগের বিষ্ঠা দেখতে পাচ্ছিস কেন? আসলে জাতটার নাগাড়ে মিনমিন করতে করতে এমন হ্যাবিট হয়ে গেছে, কেউ উগ্র বা তীব্র প্যাটার্নে ছক্কা চাললেই খ্যাচখ্যাচ শুরু। তা হলে যা, আগে মা কালীর মূর্তিটা বঙ্গোপসাগরে ফেলে আয়!

নবারুণ সাহিত্যে খিস্তি লিখলে তাঁকে মাথায় তুলে নেত্য শুরু হয়ে গেল, আর আমি বক্তিমেয় খিস্তি ইন্ট্রোডিউস করলে হয়ে গেলাম ছোটলোক? কেন? কেন আমাকে দেওয়া হচ্ছে না সমাজের ভণ্ডামির ও দ্বিচারিতার ধুতি টেনে ছিঁড়ে দেওয়ার কালাপাহাড় প্রাইজ? আমার চেলারা খুব খানিক ঝাপসা আর শক্ত টার্ম জানে না বলে? তারা এমন প্যারাগ্রাফ লিখতে পারে না বলে, যা ভেগোলজির জেঠিমা? যদি পুরন্দর ভাটের পদ্যগুলো হয় ভাষাবিপ্লব, লাইনে লাইনে চার অক্ষর হয় মধ্যমেধাঘাতী তরবারির শোঁ-চক্কর, তা হলে আমি যা করছি তা দুরন্ততর: সাহিত্যের মধ্যে বিপ্লবটাকে সেফ কৌটোবন্দি না রেখে, সরাসরি বাস্তবের ময়দানে নিয়ে আসছি। আরে, এ রাজ্যে আদ্ধেকের বেশি নিরক্ষর। তা হলে সেই জনতার মধ্যে ফালাফালা করে নয়া কাণ্ড সেঁধাতে হলে, চম্পূকাব্যে চ্যাম্পিয়নি দেখালে হবে না, হাটেমাঠে যেতে হবে, চায়ের দোকানের চল্‌টা ওঠা বেঞ্চিতে, ক্লাবে ক্লাবে ক্যারমের ইঞ্চি ফেলার টিপে, পটল কেনার দরাদরি ও ফুটো থলের ফাঁকে গলে গিয়ে, মানুষের রিয়েল জীবনে নতুনত্ব পুশ করতে হবে। অ্যাকাডেমিতে কাঙাল মালসাট দেখে হাততালি দিয়ে ফাটিয়ে দেব, আর পলিটিকাল বক্তৃতায় ওর পৌনে-ভাগ খিস্তি শুনলে চিল্লাব ‘হাড়-অশিক্ষিত’, এ পেজোমি তো চলবে না বাওয়া!

আসল কথা হল, হায়ারার্কিটা ভাঙতে হবে। মনে রাখতে হবে, শব্দই ব্রহ্ম। ভাষাই ঈশ্বর। তা হলে, সেই ভাষার মধ্যে এতটা জাতপাত ভেদ, ছোটলোক বলে একে ঘেন্না করে ছুড়ে ফেলে দেওয়া তাকে সেন্সর করে কেটে ল্যাংড়া করে দেওয়া— অধর্মাচরণ নয়? এ তো অনেকটা, সাধু ভাষায় জমানায় চলিত এসে থাবা বসানোর থিমে ভ্যাঁপ্পোটা বাজল। তখন বঙ্কিমকেও লোকে বলেছিল, শব পোড়া মড়া দাহের দল। আর এখন? সাধুভাষা দেখলেই বরং নাক সিঁটকে ওঠে। আসলে, যে শুরু করে, তার কপালে আধলা ইট এসে পড়ে। কিন্তু শেষ অবধি তার পথ ধরেই পুরো সমাজটা, পুরো সংস্কৃতিটা বয়ে যায়। আমি সাম্যবাদ শুরু করে দিয়েছি। বুঝিয়েছি, শব্দের আবার ভাল-মন্দ কী রে? শব্দ ইজ শব্দ। বিদেশিরা যা-তা ওয়ার্ড সর্ব ক্ষণ ব্যবহার করছে। গানে, উপন্যাসে, কবিতায়, নাটকে। তাতে তাদের সৃষ্টি আরও শার্প হচ্ছে, গরগর গর্জাচ্ছে। মুশকিল হল, ডি এইচ লরেন্সের কথা বলতে গেলে, বুদ্ধদেব বসু বা সমরেশ বসুর হয়ে সওয়াল করতে গেলে, বাঙালি ইন্টেলেকচুয়ালদের এই যুক্তিগুলো একেবারে পর পর সারি বেঁধে জিভের ডগায় চলে আসে। যেন ফুচকার পর চুরমুর। তার পর অম্বল। কিন্তু যেই না রাজনৈতিক নেতার কাছ থেকে তারা হুবহু একই ডোজ পায়, তক্ষুনি সেটা হয়ে যায় ভয়াবহ রাবিশ। এও আর এক হায়ারার্কি। সাহিত্যিকরা শিল্পীরা পির, তারা সবার মাথা কিনে নিয়েছে, আর পলিটিশিয়ানরা লট কে লট শয়তানের আখড়া, তাদের হতেই হবে স্টিরিয়োটাইপ ব্রাহ্মিন। কেন বে? এন্তার ফুটনোট বাগাচ্ছি না বলে, ‘কী করিলাম’— সেই ইনার মিনিংগুলো ইন্টারভিউয়ে তরল করে বুঝিয়ে দেওয়ার দীনতা দেখাচ্ছি না বলে, আমরা জনজীবনে নতুন ব্যাপার আনছি না, প্রথাগত বন্দোবস্তকে অ্যাটাক করছি না, কে বললে? কে বললে, ম্যানিফেস্টোটা স্পষ্ট ভাবে তোর সামনে মেলে ধরিনি বলেই আমার কাজের পেছনে একটা সচেতন মিশন নেই?

জলের মতো ব্যাপার। যেখানে সত্যি দুনিয়ায় উঠতে-বসতে সবাই খিস্তি করছে, রাজনীতিতে সেই স্বাভাবিক ও জনপ্রিয় জিনিসটাকে আমদানি করলে দোষ কোথায়? এ কী ধরনের শুচিবাই, যে, প্রতিটি রকে, বাসেট্রামে, শোওয়ার ঘরে যে ব্যাপারটার উচ্চণ্ড রবরবা (এবং তেজের ডিগ্রি চড়াতে দুর্ধর্ষ উপযোগিতা)—সভায় মাইক মুখে বললেই সেগুলো হয়ে যাচ্ছে দূষিত পদার্থ? সারা দিনের চলতি কথাবার্তা আর একটা বেিদতে উঠে মাইক ধরে লেকচার, এর মধ্যে ভেদ থাকবেই বা কেন? কেন একটার মধ্যে অন্যটা অনায়াসে মিশে যাবে না?

শোনো ভাই আঁতেলরা, সাবঅল্টার্ন সাবঅল্টার্ন বলতে দরদে তোমাদের মুখে রেগুলার দই উঠে আসছে। কিন্তু আনখা সাবঅল্টার্ন কনশাসনেস দেখলে তখন কানে আঙুল দিয়ে পালাতে পথ পাচ্ছ না। তা হলে ত্রুটিটা কার? তোমরা সেমিনারে আর লিটল ম্যাগে হবে সাবোতাজওয়ালা কুঠারবাজ, আর বাস্তবে হবে পিউরিটানের বাবা মিউ-রিটার্ন। তা হলে, এই সমাজে কাদের আসলে অক্সিজেন কম পড়িতেছে?

লেখাটির সঙ্গে বাস্তব চরিত্র বা ঘটনার মিল থাকলে তা নিতান্ত অনিচ্ছাকৃত, কাকতালীয়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE