Advertisement
১৮ মে ২০২৪
ছক ভাঙা ছাত্রধারা

সদিচ্ছাতেই ‘শিশুমিত্র’, গ্রামবাসীর চাঁদায় কম্পিউটারও

কোথাও স্কুলের মিড ডে মিলের হিসেব রাখে কচিকাঁচারা। কোথাও স্কুলেই তৈরি হচ্ছে কেঁচো সার। বেলপাহাড়ি ও নয়াগ্রামের দু’টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ঘুরে লিখলেন কিংশুক গুপ্তকোথাও স্কুলের মিড ডে মিলের হিসেব রাখে কচিকাঁচারা। কোথাও স্কুলেই তৈরি হচ্ছে কেঁচো সার। বেলপাহাড়ি ও নয়াগ্রামের দু’টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ঘুরে লিখলেন কিংশুক গুপ্ত

পড়াশোনার সঙ্গে সমাজ সচেতনতার কাজও করে সিঙ্গাডুবা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের খুদেরা ।

পড়াশোনার সঙ্গে সমাজ সচেতনতার কাজও করে সিঙ্গাডুবা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের খুদেরা ।

শেষ আপডেট: ২৬ ডিসেম্বর ২০১৮ ০১:২৫
Share: Save:

তৃতীয় শ্রেণির সুদীপ সিংহ স্কুলের খাদ্যমন্ত্রী! তারই সহপাঠিনী লীলা মাহাতো হল স্বাস্থ্যমন্ত্রী! স্কুলে মিড ডে মিলের পাতে কবে কী থাকবে তা সবার সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয় খাদ্যমন্ত্রী। পুষ্টিকর ও সুস্বাদু রান্নার বিষয়ে অভিভাবকরাও পরামর্শ-প্রস্তাবও দেন। স্কুলেরই কিচেন গার্ডেনের আনাজ থাকে মিড ডে মিলের পাতে। মাসে এক-দু’বার মেনুতে থাকে মুরগির মাংস। টিচার ইনচার্জের ব্যক্তিগত খরচে মাঝে মধ্যেই থাকে চাটনি, পাঁপড়।

শুধু মিড ডে মিলই নয়, পড়ুয়ারা নিয়মিত হাতের নখ কাটছে কি-না, মিড ডে মিল খাওয়ার সময় নিয়ম মেনে সাবান দিয়ে হাত ধোওয়া হচ্ছে কি-না, সেই সব দেখার দায়িত্ব স্বাস্থ্যমন্ত্রী। বেলপাহাড়ির শিমূলপাল পঞ্চায়েতের প্রত্যন্ত পাহাড়ি গ্রাম সিঙাডুবার প্রাথমিক বিদ্যালয়টিকে ছবির মতো সাজিয়ে তুলেছেন শিক্ষক-শিক্ষিকারা। এই কাজে অগ্রণী ভূমিকা রয়েছে টিচার ইনচার্জ বিষ্ণু মণ্ডলের। ঝাড়গ্রাম জেলার উত্তর প্রান্তে ঝাড়খণ্ড রাজ্যের সীমানা লাগোয়া সিঙাডুবা গ্রামের এই প্রাথমিক স্কুলটির সঙ্গে ভীষণই মিল রয়েছে নয়াগ্রাম ব্লকের আঁধারিশোল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের। কারণ দু’টি স্কুলই এ বছর ‘শিশুমিত্র পুরস্কার’ পেয়েছে।

বেলপাহাড়ির সিঙাডুবা প্রাথমিক স্কুলের পড়ুয়া সংখ্যা ৬০ জন। রয়েছেন তিন জন শিক্ষক-শিক্ষিকা। পার্শ্বশিক্ষক একজন। স্কুলের পথচলা শুরু ১৯৭৯ সালে। ২০১০ সালে সহ শিক্ষক হিসেবে স্কুলে যোগ দেন বিষ্ণু মণ্ডল। তিনিই এখন টিচার ইনচার্জ। বিষ্ণুবাবুর বাড়ি উত্তর ২৪ পরগনার হাবড়ার কাশীপুর গ্রামে। স্কুল সামলানোর জন্য তিনি এখন বেলপাহাড়ির বাসিন্দা। বিষ্ণুবাবুর কথায়, “আমার বাড়ি থেকে স্কুল প্রায় ৩০০ কিলোমিটার দূরে। সেই কারণে বেলপাহাড়িতে ভাড়া বাড়িতে থাকি। স্কুল নিয়েই সময় কেটে যায়।”

বিষ্ণুবাবুর কাজের প্রশংসা করে জেলা শিক্ষা দফতরের এক আধিকারিক বলেন, ‘‘বিষ্ণুবাবুর মতো কিছু শিক্ষক-শিক্ষিকা পেশাগত দায়িত্বের বাইরেও স্কুলের জন্য ভাবেন, সময় দেন। স্কুলকে ভালবাসেন। সেই কারণেই সীমিত পরিকাঠামো এবং বরাদ্দের অভাব সত্ত্বেও আদর্শ স্কুল গড়ে তোলা সম্ভব হচ্ছে।’’

আঁধারিশোল প্রাথমিক বিদ্যালয় চত্বরেই তৈরি হয় কেঁচো সার। নিজস্ব চিত্র

সিঙাডুবা প্রাথমিক স্কুলে ২০১০ সাল পর্যন্ত পড়ুয়া ও শিক্ষকদের জন্য একটিও শৌচাগার ছিল না। ২০১৩ সালে তৎকালীন টিচার-ইনচার্জ অবসর নেওয়ার পরে স্কুলের দায়িত্ব বর্তায় বিষ্ণুবাবুর উপর। তখন তিনি ছাড়া স্কুলে ছিলেন মাত্র একজন পার্শ্বশিক্ষক। পরে অন্যান্য শিক্ষক-শিক্ষিকারা স্কুলে নিয়োগ পান। দায়িত্ব নিয়েই বিষ্ণুবাবু শিক্ষা দফতর ও প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে তদ্বির করে একের পর এক সরকারি বরাদ্দ আদায় করেন। সেই টাকায় স্কুলে নতুন ভবন ও আধুনিক সুবিধা যুক্ত তিনটি শৌচাগার হয়েছে। মিড ডে মিল রান্নার জন্য আলাদা ঘর হয়েছে। বসেছে বেসিন, জলের পাম্প।

স্কুলে কোনও প্রাচীর নেই। তাই বাঁশ-দরমার সুদৃশ্য বেড়ায় লতানো ফুল গাছ লাগিয়ে স্কুল প্রাঙ্গণে মনোরম পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে। শিক্ষক ও পড়ুয়ারা প্রতিদিন স্কুল চত্বর সাফাই করেন। পচনশীল ও অপচনশীল ডাস্টবিনে ভাগ করে আবর্জনা ফেলা হয়। পচনশীল আবর্জনা থেকে তৈরি সার কিচেন গার্ডেনে ব্যবহার করা হয়। শুধু স্কুল চত্বর সাফাই নয়, গ্রামে গ্রামে পদযাত্রা করে আবর্জনামুক্ত পাড়া, শৌচাগারের গুরুত্ব বোঝায় পড়ুয়ারা। স্কুলে পড়ুয়াদের আঁকা ও নানা হাতের কাজ শেখানো হয়। বিষ্ণুবাবু নিজের উদ্যোগে স্কুলে একটি সাউন্ড বক্স কিনেছেন। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দিন ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ওই সাউন্ড বক্স ব্যবহার করা হয়। একটি বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কাছে আবেদন জানিয়ে ১৮টি বেঞ্চ মিলেছে। সরকারি বরাদ্দের টাকায় স্কুল বাড়ির ভেতরে ও বাইরের দেওয়ালে শিশু থেকে চতুর্থ শ্রেণির পাঠ্যসূচির বিষয়বস্তু ছবি-সহ চিত্রিত করা হয়েছে। প্রতি বছর বের হয় স্কুলের দেওয়াল পত্রিকা ‘পঠনমেলা’।

নয়াগ্রামের আাঁধারিশোল গ্রামটিও আদিবাসী অধ্যুষিত। ওই ব্লকের বালিগেড়িয়া পঞ্চায়েতের আঁধারিশোল প্রাথমিক বিদ্যালয় তৈরি হয়েছিল ১৯৭৯ সালে। সেখানে এখন পড়ুয়ার সংখ্যা ৮০ জন। বছর কয়েক আগেও সেখানে পড়ুয়ার সংখ্যা যথেষ্ট কম ছিল। ওই গ্রামের প্রায় কোনও পরিবারেই শৌচাগার ছিল না। পড়ুয়ারা স্কুলে শৌচাগারের গুরুত্ব বুঝে তাদের পরিবারকে সচেতন করে। এখন কিছু পরিবারে শৌচাগার হয়েছে। বাকি পরিবারগুলিতেও শৌচাগার করে দেওয়ার জন্য স্থানীয় পঞ্চায়েতে আবেদন জানিয়েছে স্কুলের শিশু-সংসদ।

স্কুলের প্রধান শিক্ষক হরিশচন্দ্র বেরা এক সময়ে স্কুলের একমাত্র শিক্ষক ছিলেন। পরে আসেন সহ শিক্ষক নিশিকান্ত শাসমল। এখন মোট শিক্ষক-শিক্ষিকার সংখ্যা ৫ জন। স্কুলে পরিকাঠামোর অভাব রয়েছে। সীমিত সামর্থ্যের মধ্যেই স্কুলকে সাজিয়ে তোলা হয়েছে। দেওয়ালে স্বামীজি, বিদ্যাসাগরের মতো মনীষীদের ছবি আঁকা রয়েছে। মিড ডে মিল খাওয়ার আলাদা জায়গা রয়েছে। স্কুল ভবনের বাইরের দেওয়াল-বোর্ডে স্কুল সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য লেখা থাকে। রয়েছে শৌচাগার ও পরিস্রুত জলের ব্যবস্থা। তবে এখনও পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ নেই।

স্কুলে কেঁচো সার প্রকল্প করা হয়েছে। শিশু সংসদের খাদ্যমন্ত্রী আব্রাহাম মুর্মু জানায়, মিড ডে মিলের পাতে নানা আনাজ থাকে। প্রতি সপ্তাহে দেওয়া হয় ডিম। শনিবার করে খাওয়ানো হয় খিচুড়ি ও চাটনি। স্কুলে রয়েছে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা। স্কুল চত্বরে পড়ুয়াদের দিয়ে ফুল ও পাতাবাহার গাছ লাগানো হয়। স্থানীয় বাসিন্দারা চাঁদা তুলে স্কুলকে একটি কম্পিউটার দান করেছেন। সেটির সাহায্যে স্কুলে দৃশ্য-শ্রাব্য মাধ্যমে আংশিক পঠন-পাঠন হয়। স্কুলের গ্রন্থাগারটিও সাজানো গোছানো। সেটির দায়িত্বে রয়েছে শিশু সংসদের শিক্ষামন্ত্রী পূজা শী।

ঝাড়গ্রাম জেলা প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিদর্শক শুভাশিস মিত্র বলেন, “আদর্শ স্কুল গড়ে তোলার জন্য সদিচ্ছা চাই। ওই দু’টি স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকা, অভিভাবক ও গ্রামবাসীরা সেটা করে দেখিয়েছেন। গ্রামের পরিবেশের উন্নতির ক্ষেত্রেও ভূমিকা নিচ্ছেন শিক্ষক-শিক্ষিকারা। এটা খুবই সদর্থক দিক।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Education Students School
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE