Advertisement
E-Paper

অপছন্দ হলে চেপে দেবেন?

সত্যের খাতিরে মেনে নিতেই হবে, কী রাজ্যে কী কেন্দ্রে, সরকারে যে দলই থাকুক না কেন, পরিসংখ্যান থেকে বাস্তবের যে ছবিটা উঠে আসে তা যদি শাসক দলকে অস্বস্তিতে ফেলে, তা হলে তৎক্ষণাৎ এর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে তারা প্রশ্ন তুলবে।

অচিন চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২০ মার্চ ২০১৯ ০০:৫২
প্রতিবাদ: ক্রমশ বাড়তে থাকা বেকারত্বের প্রশ্নে বামপন্থী শ্রমিক সংগঠনের বিক্ষোভ। দিল্লি, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯। ছবি: রমাকান্ত কুশবহা

প্রতিবাদ: ক্রমশ বাড়তে থাকা বেকারত্বের প্রশ্নে বামপন্থী শ্রমিক সংগঠনের বিক্ষোভ। দিল্লি, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯। ছবি: রমাকান্ত কুশবহা

পরিসংখ্যান সংগ্রহ ও সঙ্কলনের জন্য এ দেশে যে জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলি রয়েছে, ওয়াকিবহাল মহলে তাদের সুনাম আছে, কারণ তাদের দক্ষতা ও নিষ্পক্ষতা। তাদের কর্মকাণ্ডকে রাজনৈতিক লাভের উদ্দেশ্যে প্রভাবিত করে কেন্দ্রীয় সরকার এক ভয়ঙ্কর দৃষ্টান্ত স্থাপন করছে। সম্প্রতি ১০৮ জন অর্থনীতিবিদ ও সমাজবিজ্ঞানী এক যৌথ প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ নিয়ে অত্যন্ত উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

সত্যের খাতিরে মেনে নিতেই হবে, কী রাজ্যে কী কেন্দ্রে, সরকারে যে দলই থাকুক না কেন, পরিসংখ্যান থেকে বাস্তবের যে ছবিটা উঠে আসে তা যদি শাসক দলকে অস্বস্তিতে ফেলে, তা হলে তৎক্ষণাৎ এর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে তারা প্রশ্ন তুলবে। কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান সংস্থা (সিএসও) কিংবা জাতীয় নমুনা সমীক্ষা সংস্থার (এনএসএসও) সংগৃহীত তথ্য থেকে শাসকের পক্ষে অস্বস্তিকর এমন ছবি উঠে আসতেই পারে, আগেও এসেছে। যেমন ধরা যাক, জাতীয় আয় বৃদ্ধির হার আগের তুলনায় এই জমানায় কমেছে, কিংবা বেকারত্বের হার বেড়েছে। যাঁরা শাসনক্ষমতায় আছেন, এ রকম পরিসংখ্যান তাঁদের পছন্দ হবে না, সেটাই স্বাভাবিক।

কিন্তু অতীতে অন্তত চেষ্টা থাকত বাস্তব-অবাস্তব নানান বিকল্প তথ্য এনে বা প্যাঁচালো যুক্তি দিয়ে তাকে গুলিয়ে দেওয়ার। ফলে যুক্তি ও পাল্টা-যুক্তির চাপানউতোরের একটা জায়গা থাকত। কিন্তু শাসক দলকে অস্বস্তিতে ফেলতে পারে বলে জাতীয় নমুনা সমীক্ষার রিপোর্ট প্রকাশ করতেই দেওয়া হল না, এমনটা আগে হয়নি। এখন সরকারি নিষেধাজ্ঞার ফলে ২০১৭-১৮-র সমীক্ষার ফল আর জানার উপায় নেই। তবে সরকারের অস্বস্তি বাড়িয়ে সে রিপোর্ট ‘লিক’ হয়ে গিয়েছে এবং জানা গিয়েছে দেশে বেকারত্বের হার যেখানে গিয়েছে তা গত ৪৫ বছরে যায়নি। আর সেটাই সম্ভবত রিপোর্ট প্রকাশ না করার মুখ্য কারণ। এ ছাড়া ভারত সরকারের ‘লেবার বুরো’ প্রতি বছর কর্মসংস্থান নিয়ে সমীক্ষাভিত্তিক রিপোর্ট প্রকাশ করত। গত দু’বছর সেটিও বন্ধ করা হয়েছে, পাছে কর্মসংস্থানের হাল নিয়ে সরকারকে প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়। জাতীয় পরিসংখ্যান কমিশন, যা স্বাধীন ভাবে পরিসংখ্যান সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানগুলির অভিভাবকত্বের ভূমিকায় রয়েছে, এনএসএস ২০১৭-১৮’র রিপোর্টকে ছাড়পত্র দিয়েছিল। কিন্তু সরকার তার ওপর খোদকারি করে সে রিপোর্ট প্রকাশ বন্ধ করে দেয়। প্রতিবাদে কমিশনের চেয়ারম্যান পদত্যাগ করেন। কিছু দিন আগে আরবিআই, এখন জাতীয় পরিসংখ্যান কমিশন। একটার পর একটা প্রতিষ্ঠানকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করতে গিয়ে তাদের বিশ্বাসযোগ্যতাকে টেনে নামানোয় দেশেরই ক্ষতি, অথচ দেশভক্তদের এ দিকটায় নজর পড়তে দেখি না!

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

নিষ্পক্ষ দৃষ্টি দিয়ে দেখলে, ‘‘এনডিএ-২ আমলে এনএসএসও-মাপক অনুসারে বেকারত্ব বেড়েছে’’, এই বাক্যের কিন্তু একাধিক অর্থ কিংবা উপসংহার হতে পারে। সরকারের ব্যর্থতাই একমাত্র নয়। যে হেতু হতদরিদ্র মানুষ রোজগার ছাড়া বাঁচতে পারেন না এবং তার ফলে খুব কম মজুরিতেও কাজ করতে বাধ্য হন, তাঁরা বছরের অর্ধেকের বেশি দিন কাজ না করে জীবনধারণ করছেন, এর সম্ভাবনা কম। আর বছরের অর্ধেকের বেশি দিন কাজ করে থাকলেই আর এনএসএসও-র সংজ্ঞায় এঁরা কর্মহীন নন। তা হলে সমীক্ষায় তাঁরাই নিজেদের বেকার বলে জানাবেন, যাঁরা মনে করেন তাঁরা কাজ খুঁজছেন কিন্তু ‘নেওয়ার মতো’ কাজ পাচ্ছেন না। এক জন হতদরিদ্র মানুষের সে ‘সুযোগ’ নেই। অতএব বেকারের সংখ্যা বাড়া আর দরিদ্রের সংখ্যা কমা, দু’টি একই সঙ্গে ঘটতে পারে। আর দারিদ্র কমলে তো ভালই হয়েছে বলতে হবে। এরও আবার পাল্টা যুক্তি হতে পারে— তা হলে বাপু নির্বাচনের সময়ে ইস্তাহারে কাঁড়ি কাঁড়ি কাজ তৈরি করব বলে অমন অবাস্তব আশা দেখানো কেন? অর্থাৎ সমীক্ষার পরিসংখ্যান নিয়ে একাধিক আখ্যান তৈরি হতে পারত, যেখান থেকে মানুষ ‘সত্য’টা খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করতেন। কিন্তু এ সব সম্ভাবনাকে গোড়াতেই মেরে রাখা হল পরিসংখ্যানের গলা টিপে, ‘‘আমি তো কলা খাইনি’’ মানসিকতার জন্যে।

এর পরিণতি সুদূরপ্রসারী, গণতন্ত্রের পক্ষে বিপজ্জনক। সুস্থ গণতন্ত্রের জন্য চাই সরকারের দায়বদ্ধতা, যা নির্ভর করে নাগরিকদের অধিকার সচেতনতার ওপর। নির্ভরযোগ্য তথ্য এই সচেতনতার প্রধান উপকরণ। পরিসংখ্যান সংগ্রহের ব্যবস্থাপনা রাষ্ট্রের অন্যতম কর্তব্য। সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলির মধ্যে একটি। শিক্ষাব্যবস্থা থেকে রাস্তাঘাট, জাতীয় সুরক্ষা থেকে খাদ্য সুরক্ষা ইত্যাদি নানাবিধ কাজের পরিকল্পনা থেকে শুরু করে তার বাস্তবায়ন, সর্বোপরি অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি বোঝা, নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান ছাড়া অসম্ভব। অথচ এই সরকার যা করল তা পরিসংখ্যানের এই নির্ভরযোগ্যতাকেই ঝাপসা করে দিল। রাজনৈতিক লাভের লক্ষ্যে মানুষজনের মধ্যে এক ধরনের উগ্র জাতীয়তাবাদী বোধ উস্কে দিতে সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করা যেমন বিপজ্জনক, তেমনই বিপজ্জনক রাজনৈতিক লাভের জন্যে পরিসংখ্যানের বিশ্বাসযোগ্যতাকে ধ্বস্ত করা।

উনিশ এবং বিশ শতকে পশ্চিমি দুনিয়ায় মেধাজীবীদের মধ্যে ধর্মবিশ্বাসের মুঠো যখন আলগা হতে থাকল, তখন এক নতুন ধরনের সংলাপের উত্থান হল, যার নাম আধুনিকতা। সেটা এ রকম— ‘‘তুমি যা বলছ সেটা তোমার নিজস্ব মত ছাড়া আর কিছু নয়, তথ্যের সমর্থন নেই।’’ তথ্যভিত্তিক, বস্তুনিষ্ঠ, যুক্তিবাদী চর্চাই এই আধুনিকতার লক্ষণ। সদ্য-স্বাধীন তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রগুলির রাষ্ট্রনায়কদের চেতনার মধ্যে এই আধুনিকতা কমবেশি ছিল। এঁদের মধ্যে অবশ্যই উল্লেখ করতে হয় পণ্ডিত নেহরু আর তানজ়ানিয়ার প্রেসিডেন্ট জুলিয়াস নিয়েরেরের কথা। এই দুই রাষ্ট্রনায়কই আধুনিকতায় অন্য অনেকের থেকে এগিয়ে ছিলেন। নেহরুর কথা বিশেষ ভাবে বলতেই হবে রাষ্ট্রভাবনায় এই আধুনিকতাকে অনেকটা জায়গা দেওয়ার জন্য। এই আধুনিকতা রাষ্ট্র পরিচালনে তথ্য ও পরিসংখ্যানকে প্রধান গুরুত্বের জায়গায় নিয়ে এল। পরিসংখ্যান সংগ্রহ ব্যবস্থাকে বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে গড়ে তুলতে প্রশান্ত মহলানবিশ প্রতিষ্ঠিত ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিকাল ইনস্টিটিউটকে পরিকল্পনা কমিশনের মাধ্যমে পৃষ্ঠপোষকতার ব্যবস্থা করলেন নেহরু, অবশ্যই প্রতিষ্ঠানের স্বাধিকার যথাসম্ভব সুরক্ষিত রেখে। তৈরি হল সিএসও, এনএসএসও, ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান। ভারতের পরিসংখ্যান-সংগ্রহ-ব্যবস্থা দক্ষতা ও পেশাদারিত্বের জন্যে গোটা বিশ্বেই ওয়াকিবহাল মহলে উচ্চ প্রশংসিত। কোনও প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠা ও খ্যাতি দীর্ঘ সময় ধরে অর্জন করতে হয় কষ্টসাধ্য পথে। কিন্তু তা ধ্বংস করতে বেশি সময় লাগে না।

পরিসংখ্যান আসলে পরিশীলিত মিথ্যা, এমন কথা প্রায়শই শোনা যায়। এ কথায় বাহাদুরি হয়তো আছে, দিশা নেই। আবার সব পরিসংখ্যানই একশো শতাংশ খাঁটি হতে হবে, এই চরম শুদ্ধবাদী অবস্থান নিয়েও বেশি দূর যাওয়া যায় না। অধিকাংশ সময়েই দেখা যায়, পরিসংখ্যান ঘিরে অবিরল বিতর্কের উৎস আসলে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে অকৃত্রিম মতবিরোধ, যা স্বাস্থ্যকর। এ থেকে যে হেতু অনেক সময়েই স্পষ্ট ভাবে সাদাকালো সিদ্ধান্তে আসা যায় না, তাই শেষ বিচারে মূল্যায়নের মাপকাঠিটা হয়ে দাঁড়ায়— কোনও নির্দিষ্ট পরিসংখ্যান কতটা গ্রহণযোগ্য।

প্রশ্ন উঠতে পারে, কার কাছে গ্রহণযোগ্য? উত্তর হবে, যাঁরা বিচারবুদ্ধি ব্যবহার করে পরিসংখ্যানকে উল্টেপাল্টে দেখার পরিশ্রমটি করতে রাজি আছেন তাঁদের কাছে। তা হলে দেখুন, পরিসংখ্যান সংগ্রহ ও সঙ্কলন, কখনও বিশ্লেষণও, সর্বত্র মূলত রাষ্ট্রের উদ্যোগে হলেও রাষ্ট্রের ক্ষমতা নেই একে গ্রহণযোগ্যতা দেয়, কারণ গ্রহণ-বর্জন একটি সামাজিক প্রক্রিয়া, যা রাষ্ট্র নির্দেশ জারি করে স্থির করে দিতে পারে না। আর রাষ্ট্রের হঠকারিতায় যদি পরিসংখ্যানের গ্রহণযোগ্যতা তলানিতে ঠেকে, সে ক্ষতি পূরণ করা সহজ নয়। তাই ঠিক যেমন রেলের কামরায় লেখা থাকত ‘‘রেলের সম্পত্তি আপনার সম্পত্তি, একে সুরক্ষিত রাখুন’’, শতাধিক অর্থনীতিবিদ ও সমাজবিজ্ঞানী একজোট হয়ে তেমন আবেদনই হয়তো রাখছেন আপনাদের কাছে। বলছেন, পরিসংখ্যান আপনার সম্পত্তি, একে সুরক্ষিত রাখা এবং শুদ্ধতা বজায় রাখা আপনার আমার কর্তব্যের মধ্যে পড়ে।

আইডিএসকে’তে অর্থনীতির শিক্ষক

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy