Advertisement
১১ মে ২০২৪

নেশার সেকাল-একাল, সংযমই একমাত্র ওষুধ

মহাকাব্য, পুরাণ, সাহিত্যে বারবার উঠে এসেছে নেশার প্রসঙ্গ। উঠে এসেছে এ বিষয়ে সচেতনতার কথাও। কর্তব্যে অবহেলাকারী যক্ষকে রামগিরি পর্বতে নির্বাসিত হতে হয়েছিল। আর এ ক্ষেত্রে চাকরি তো যাবেই। একটা সুস্থ মানুষ নেশাগ্রস্থ হয়ে পড়লে কী দশা হয়, সে কথা হয়তো অনেকেই জানেন। কিন্তু নেশামুক্তির উপায় কিছু কিছু জানা থাকলেও জীবনে সে উপায়কে ব্যবহার করার লোকের সংখ্যা নিতান্তই স্বল্প। 

সৌরেন বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৫ ডিসেম্বর ২০১৮ ০৪:১৬
Share: Save:

মালদহের ইংরেজবাজারের অভীকের সাত বছরের ছেলে বুবাই দৌড়ে গিয়ে বাবাকে বলল, ‘‘জানো তো, ত্রিশক্তির কেয়ারটেকার-কাকুর চাকরি চলে গিয়েছে! বিকেলে কার সঙ্গে খেলব? কাকু না থাকলে খেলাই তো হবে না!’’ কেয়ারটেকার ভাল মানুষ, বাচ্চাদের ভালবাসেন, পরোপকারী। কিন্তু কী হল? জানা গেল, রাতে কোনও আবাসিকের ঘরে ঢুকে মদ্যপান করার কারণেই কর্তব্যে অবহেলার দায়ে চাকরি খতম। বুবাইয়ের দাদু বললেন, ‘‘বিষমদ খেয়ে মারা গেলে না হয় সরকারি সাহায্য পেত! কিন্তু এ ক্ষেত্রে কিছু করার নেই!’’

কর্তব্যে অবহেলাকারী যক্ষকে রামগিরি পর্বতে নির্বাসিত হতে হয়েছিল। আর এ ক্ষেত্রে চাকরি তো যাবেই। একটা সুস্থ মানুষ নেশাগ্রস্থ হয়ে পড়লে কী দশা হয়, সে কথা হয়তো অনেকেই জানেন। কিন্তু নেশামুক্তির উপায় কিছু কিছু জানা থাকলেও জীবনে সে উপায়কে ব্যবহার করার লোকের সংখ্যা নিতান্তই স্বল্প।

ফাঁকা স্টেডিয়াম, সে সল্টলেকই হোক বা রতুয়া, মদ্যপানের আসর সে সব জায়গায় বসতে পারে দুষ্কৃতী-সৌজন্যে। বিষমদ পান করে প্রতি বছরই বহু মানুষ মারা যান। অবৈধ ভাটিখানার সংখ্যাও কম নয়। গ্রাম-শহর-নগর সমগ্র বাংলা জুড়েই মদ্যপানের বিরোধিতায় মহিলারা ডান্ডা-ঝাঁটা হাতে ভাঙচুর চালান। কিন্তু লাভের লাভ কিছুই হয় না। লাভজনক ব্যবসা কি সহজে বন্ধ হয়? অনেকে মদ বেচে দুধ খান, আবার অনেকে দুধ বেচে মদ খান। সরকার অবশ্য আবগারি শুল্ক সব চেয়ে বেশি মদ বিক্রি থেকেই পেয়ে থাকে। ২০১৮ সালে দুর্গাপূজার সময় অক্টোবরে মদ বিক্রি হয়েছে ১২৭৫ কোটি টাকার, সরকারের মুনাফা ৯৮২ কোটি টাকা। ভাবা যায়, বছরে ১০ হাজার কোটি টাকা! রাশিয়ার সঙ্কটের দিনে শিক্ষকের বেতন দেওয়া হয়েছিল ১৫ বোতল ভদকা। মদ বেচে খাও। বিহার সরকার অবশ্য চেষ্টা করেছে, আবগারি শুল্কের হাতছানিকে দূরে সরিয়ে সমাজ সংশোধনের। তবে, এ নেশার আকর্ষণ থেকে দেব-দানব-গন্ধর্ব-রাক্ষস বা মনুষ্য— কেউই রক্ষা পায়নি। স্বয়ং শিবশম্ভুর অধীনেই সমস্ত নেশাভাঙ। বৈদিক যুগে যজ্ঞে সোমরস পানের প্রসঙ্গ বারবার এসেছে। সীতাদেবী শ্রীরামচন্দ্রকে মৈতরেয় মদ নিজ হাতে পান করিয়েছেন। নিধুবনে হনুমান-সহ বানরদল মদ্যপান তো করেইছে, মাতলামিও করেছে। রাক্ষস সেনাদের মদ্যপানের বিচিত্র চিত্র পাওয়া যায়। মহাভারতে কৌরবকুলের পাশা খেলায় জয়ের আনন্দে এবং বারণাবতে পাণ্ডবদের মৃত্যুসংবাদের ভুয়ো খবর আসার পরে মদ্যপানের কথা জানা যায়। যদুবংশের মদ্যপানের কথা তো ধ্বংসেরই বার্তা। গ্রিক-পারস্য-আরব-মিশরীয় প্রভৃতি সাহিত্যে ও ইতিহাসে মদ্যপানের ব্যাপক চিত্র পাওয়া যায়। ভারতীয় তন্ত্রসাধনায় মদ প্রধান উপকরণ।

ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাঙালি যখন ইংরেজের অনুকরণে বিদেশি মদ্যপানে ঘোর আসক্ত হচ্ছিল, তখন বাবুদের উৎশৃঙ্খল জীবনের নানা চিত্র সাহিত্যেও আসতে শুরু করে। ১৮২১ খ্রিস্টাব্দের ৭ জুলাই ‘সমাচার দর্পণ’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল— ‘বাবু জিজ্ঞাসা করেন ভট্টাচার্য মহাশয়, সুরাপানে কি পাপ হয় ? উত্তর, ইহাতে পাপ হয় যে বলে তাহার পাপ হয়। ইহার প্রমাণ আগম ও তন্ত্রের দুইটা বচন অভ্যাস দিলেন, পাঠ করিলেন এবং কহিলেন মদ্য ব্যতিরেকে উপাসনাই হয় না। বলরাম ঠাকুরও মদ্যপান করিয়াছিলেন। বাবু তুষ্ট হইয়া ভট্টাচার্যকে টোল করিয়া দিলেন’। ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচনা ছাড়াও কালীপ্রসন্ন সিংহের রচনাতেও এসেছে— ‘মদ খাওয়া বড় দায় জাত রাখার কি উপায়’। রচনায় কালীপ্রসন্ন সংস্কার ও সংস্কার-মুক্তির দোলাচলতার চিত্র তুলে ধরেছেন— ‘মদ্যপানে যে কেবল শরীর নষ্ট হয়, এমত নহে, শরীরের সঙ্গে বুদ্ধি ও ধনও যায়... বাঙালিরা মদ খাইতে আরম্ভ করিলে প্রায় মদে তাহাদের খায়’। গ্রন্থটিতে মদ্যপানের ধ্বংসাত্মক দিকে এবং সমকালের বিপন্ন জাতি রক্ষার নামে ভ্রষ্টাচারের চিত্র উঠে এসেছে। নববাবুর মদ্যপান ও প্রাচীনপন্থী জাত রক্ষার নামে বাগাড়ম্বর, অলসতা, নেশাখোর ও নিষ্কর্মা মনোভাবের বিরুদ্ধে বক্তব্যের সন্ধান পাওয়া যায়। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় লিখছেন— ‘এক দিকে পুতুলনাচ, বাইনাচ এবং গণিকাচর্চার বনেদি বাবুয়ানা, অন্য দিকে মদ্যপান এবং চলনে-বলনে-লিখনে বিকৃত ইংরেজিয়ানা গ্রিক পুরাণের ইউলিসিসের মতো এই শিলা ও ক্যারিবডিসের মধ্য দিয়ে আশ্চর্য শক্তির সাহায্যে খাঁটি মানুষ হয়ে বেরিয়ে এসেছিলেন কালীপ্রসন্ন’। ঊনবিংশ শতাব্দীর নাটকে-সাহিত্যে মদ্যপানের প্রসঙ্গ এসেছে।

ব্যক্তিজীবনে শিল্পী-সাহিত্যিকেরাও মদ্যপানে বিমুখ ছিলেন না। মধুসূদনের শৌখিনতা ও বিলাসের সঙ্গে মদ্যপানের আয়োজন কম ছিল না। গিরিশচন্দ্র, অমৃতলাল থেকে শুরু করে শিশির ভাদুড়ী, প্রত্যেকেই পানে উৎসাহী ছিলেন। মধুসূদনের ‘একেই কি বলে সভ্যতা’য়় মদ্যপানের উৎশৃঙ্খল চিত্র রয়েছে। দীনবন্ধু মিত্রের ‘সধবার একাদশী’তে নিমচাঁদের মতো চরিত্র সৃষ্টির মধ্য দিয়ে মদ্যপানের অন্তরঙ্গ ও বহিরঙ্গ উভয় দিকেরই প্রতিফলন ঘটেছে। ‘সুরাপান নিবারণী সভা’য় নকুলেশ্বর নাম লেখাবে বলায় নিমচাঁদ বলেছে, ‘বাবা ব্রান্ডীর ভাঁটিতে না চোঁয়ালে তোমার ক্ষুধা হয় না, তুমি নাম লেখালে সাড়ে তিন হাত ভূমির মৌরসি পাট্টা নিতে হবে’। নিমচাঁদ এ কথাও বলে, ‘মদ কি ছাড়বো। আমি ছাড়তে পারি বাবা, ও আমায় ছাড়ে কই? সে কালে ভূতে পেতো; এখন মদে পায়— ডাক ওঝা, ঝাড়য়ে আমার মদ ছাড়ায়ে দেক’। মদ্যপান থেকে নিবৃত্ত হবার লক্ষ্যে নাট্যকার এলুবু বারেটের একটি দুরন্ত মন্তব্য করেছেন— “টাচ নট, টেস্ট নট, স্মেল নট, ড্রিন্ক নট, অযানিথিং দ্যাট ইনটক্সিকেটস’। নাটকে রামমাণিক্য অবশ্য বিদেশি মদ্য ব্র্যান্ডি খাওয়ার সময় মন্ত্র পড়ে তা শোধন করে নেয়। দুঃখ-যন্ত্রণা ভোলার জন্য মদ্যপানের আগ্রহ, আবার সমাজে ‘স্ট্যাটাস’ বজায় রাখার ক্ষেত্রেও মদ্যপানের বিষয়টি গুরুত্ব পায়।

বঙ্কিমের ‘কপালকুণ্ডলা’য় কাপালিকের কথা বাদ দিলে আমরা ‘বিষবৃক্ষ’-এ দেবেন্দ্রের মুখে যখন শুনি, ‘যদি স্ত্রীর মৃত্যুসংবাদ শুনি তাহা হইলে মদ ছাড়িবো’, তখন আর এক বিপ্রতীপ জীবনের কথা উঠে আসে। আবার শ্রমিকজীবনে আনন্দ ও স্ফূর্তির জন্য মদ্যপানের প্রসঙ্গ বারবার উঠে আসে। রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’ নাটকে ফাগুলাল চন্দ্রাকে বলেছে— ‘আমার মদ কোথায় লুকিয়েছ, চন্দ্রা?’ মদ্যপানে দাম্পত্যজীবন বিঘ্নিত হয়। শরৎচন্দ্রের রচনায় এই মদ্যপান প্রসঙ্গ যথেষ্ট পরিমাণে রয়েছে। ব্যক্তিজীবনে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় মদ্যপানে আসক্ত ছিলেন। তবে, মদ্যপানের কুফলের কথাও তাঁর রচনায় খুঁজে পাওয়া যায়।

নিজেদের রচনায় মদ্যপান প্রসঙ্গ এবং ব্যক্তিজীবনে মদ্যপানের ক্ষেত্রে কোনও শতাব্দীতেই কবিরা পিছিয়ে ছিলেন না। জীবনানন্দের রচনায় ‘রক্তিম গেলাসে তরমুজ মদ’ নিয়েই মদমত্ততার প্রসঙ্গ। শীতের দেশে অবশ্য শরীর চাঙ্গা রাখার জন্য মদ্যপানের প্রয়োজনের কথা অনেকেই স্বীকার করেন। তবে, মদ ছাড়ানোর নাম করে অন্য আর এক ধরনের পানীয়ের প্রতি নেশাগ্রস্ত করে তোলার উপায়ও এখন বিজ্ঞাপনে চোখে পড়ে। সংসারে মদ্যপানের বিষয়টি অনুপ্রবিষ্ট হলে সংসার ধ্বংস হওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা। আত্মসচেতন এবং সংযমী না হওয়ার কারণেই মানুষ নেশার কবলে পড়ে থাকে। এই ভয়ঙ্কর ব্যাধি থেকে সমাজকে বাঁচানোর লক্ষ্যে সকলেরই এগিয়ে আসা উচিত।

(লেখক গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার শিক্ষক। মতামত লেখকের ব্যক্তিগত। উদ্ধৃতির পুরনো বানান এবং যতিচিহ্ন অপরিবর্তিত)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Drug Addiction Self Restraint
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE