Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
মনে করো শুরুর সে দিন

আজকের সঙ্কটের সূত্রপাত কিন্তু এই প্রজাতন্ত্রের আদি পর্বেই

প্রজাতন্ত্রের প্রথম আমল থেকেই সরকারি রাজনীতিক নেতারা এই নিয়মের যথেচ্ছ ব্যবহার করতে দ্বিধা করেননি। জাতি-সরকার-রাষ্ট্রের একীকরণের প্রক্রিয়া ১৯৪৮-৪৯ থেকেই শুরু।

রাষ্ট্রনেতা: স্বাধীনতার পরের বছর এক জনসভায় প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু, পাশে সর্দার বল্লভভাই পটেল, ১৯৪৮।

রাষ্ট্রনেতা: স্বাধীনতার পরের বছর এক জনসভায় প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু, পাশে সর্দার বল্লভভাই পটেল, ১৯৪৮।

শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৬ জানুয়ারি ২০১৯ ০০:০৭
Share: Save:

আজকের প্রজাতন্ত্র দিবসে দেশের হালচাল দেখে অনেকেই ভাবছেন রাষ্ট্র ও সমাজ আজ এক গভীর সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে চলেছে। জাতীয়তাবাদের বাড়াবাড়ি, গণতন্ত্র বিপর্যস্ত, বাক‌্-স্বাধীনতা ও সংবাদমাধ্যমের স্বাতন্ত্র্য সঙ্কুচিত, ধর্মীয় সংখ্যালঘু, দলিত ও আদিবাসী সম্প্রদায় আক্রান্ত। এই অবস্থাকে যদি কোনও সঙ্কটমুহূর্ত বলি, তবে মনে রাখতে হবে হঠাৎ এক দিনে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়নি। এর দায় অনেকের। ইতিহাসের আগ্রহী পাঠক জানেন যে এই অবস্থা ক্রমশ সৃষ্টি হয়েছে প্রজাতন্ত্রের ইতিহাসের আদি পর্ব থেকেই। সম্ভবত এই অবস্থার বীজ নিহিত ছিল আমাদের সংবিধানের মধ্যেও। স্বাধীনতার প্রথম দশকেই আজকের সঙ্কটের পূর্বলক্ষণগুলি দেখা দিচ্ছিল। গত সত্তর বছরে সেগুলি পুরোপুরি বিকশিত হয়েছে!

প্রথমে সংবিধান দিয়েই শুরু করা যাক। ১৯৪৬ সালের ৮ ডিসেম্বর থেকে শুরু করে ৩০৮ জন সদস্যের গণপরিষদ প্রায় তিন বছর আলোচনা করে যে সংবিধানটি রচনা করলেন, তা ছিল পৃথিবীর দীর্ঘতম লিখিত সংবিধান। অনেকেই মনে করেন যে তিরিশ বছরের ঔপনিবেশিকতা-বিরোধী গণআন্দোলন যে আদর্শগুলির ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল, সেগুলিই প্রতিফলিত হয় এই সংবিধানে। এগুলির মধ্যে প্রধান ছিল, গণভিত্তিক সার্বভৌমত্বের (পপুলার সভরেনটি) ধারণা, যে ধারণা অনুযায়ী— স্বাধীন ভারতে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হলেন জনগণ। আর ছিল জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শগুলি। সব ক’টি ক্ষেত্রেই কিছু আপসরফা সন্নিহিত হল। সেখানেই সম্ভবত ঘটল ভবিষ্যতের কর্তৃত্বকামী রাষ্ট্রের বীজরোপণ।

গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, যার ভিত্তি হল সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকার— আমাদের সংবিধানের প্রধান অবদান। অনেকে মনে করেন এই গণতন্ত্রই বিশাল, বহুত্ববাদী ভারতীয় সমাজকে এক সূত্রে গেঁথে রেখেছে। অন্য দিকে কিন্তু রাষ্ট্র গঠনের ক্ষেত্রে সংবিধান রচয়িতারা চেয়েছিলেন একটি ক্ষমতাশালী কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্র— দুর্বল যুক্তরাষ্ট্র নয়। প্রদেশের ওপর কেন্দ্রের প্রাধান্যকে তাই মান্যতা দিলেন তাঁরা। কারণ স্বাধীনতা আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে জাতি গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হলেও ১৯৪৭ সালে সে প্রক্রিয়া শেষ হয়নি। বহুত্ববাদী সমাজে ওপর থেকে জাতি গঠনের দায়িত্ব তাই বর্তাল সংবিধানের ওপর।

অতএব, জনগণ সার্বভৌম ক্ষমতা পেল ঠিকই, কিন্তু তা সরাসরি প্রয়োগ করার অধিকার তাকে দেওয়া হল না। সংসদীয় গণতন্ত্রের কাঠামোর মধ্যে সেই ক্ষমতা তাদের হয়ে প্রয়োগ করবেন সংসদের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা। এর প্রায়োগিক তাৎপর্য দাঁড়াল এই যে, জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার সীমাবদ্ধ হল পাঁচ বছর অন্তর ভোট দেওয়ার মধ্যেই। প্রয়োজনে গণপ্রতিবাদ বা অহিংস আইন অমান্য আন্দোলনের কোনও পরিসরকে মেনে নিতে সরকার পক্ষের রাজনীতিকদের আপত্তি দেখা গেল সেই প্রথম আমল থেকেই।

এইখানে নাগরিক অধিকারের প্রসঙ্গটা উঠে আসে। সংবিধানের প্রধান ঝোঁকটা ছিল ‘সামাজিক ন্যায়বিচার’-এর দিকে, যা নথিভুক্ত হল ডিরেক্টিভ প্রিন্সিপ‌্‌লস বা নির্দেশাত্মক নীতিমালায়। আর সেই সঙ্গে অবশ্যই সংযুক্ত হল নাগরিকের মৌলিক অধিকারগুলি। কিন্তু এই দুই নীতির মধ্যে সংঘাত বাঁধলে ন্যায়বিচারের প্রশ্নটাকেই প্রাধান্য দেওয়া হল। জাতীয়তাবাদী গণআন্দোলনের ফলে ইতিমধ্যেই ব্যক্তিস্বাধীনতার বিষয়টা সমষ্টিগত বা জাতীয় স্বাধীনতার কাছে গৌণ বলে পরিচিত হয়েছে। তাই সংবিধানেও জাতীয় রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের স্বার্থে প্রয়োজনে মৌলিক অধিকার এবং ব্যক্তিস্বাধীনতা খর্ব করার সংস্থান রাখা হল। আর কোন জরুরি অবস্থায় তা কার্যকর করা হবে তা নির্ধারণের দায়িত্ব দেওয়া হল সংসদকে, অর্থাৎ রাজনীতিকদের।

প্রজাতন্ত্রের প্রথম আমল থেকেই সরকারি রাজনীতিক নেতারা এই নিয়মের যথেচ্ছ ব্যবহার করতে দ্বিধা করেননি। জাতি-সরকার-রাষ্ট্রের একীকরণের প্রক্রিয়া ১৯৪৮-৪৯ থেকেই শুরু। সরকারের বা সরকারি দলের সমালোচনা রাষ্ট্রদ্রোহের সমার্থক বলে বিবেচিত হতে লাগল। বিনা বিচারে হাজতবাসের সংস্থানও করা হল প্রিভেন্টিভ ডিটেনশন অ্যাক্ট অথবা বিভিন্ন প্রদেশের সিকিয়োরিটি অ্যাক্ট-এর মাধ্যমে। ১৯৫১ সালের অক্টোবরেই নেহরু সরকার প্রেস বিল এনে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সীমিত করল। দু’বছরের জন্য এই আইন চালু থাকার কথা ছিল। কিন্তু এর ফলে সংবাদমাধ্যমকে রাষ্ট্রের প্রয়োজনে নিয়ন্ত্রণ করার একটা ধারা চালু হয়ে গেল। এই বিল পাসের দু’দিন বাদে কাফি খাঁ এক দৈনিক সংবাদপত্রে একটি কার্টুন এঁকেছিলেন, যার শিরোনাম ছিল ‘বিজয়া দশমী, ১৩৫৮’। ছবি ছিল দুর্গাপ্রতিমা বিসর্জনের, প্রতিমার গায়ে লেখা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা।

আরও একটি মূল্যবান আদর্শ আমাদের সংবিধানে স্বীকৃতি পেল, তা হল ধর্মনিরপেক্ষতা। কিন্তু তার সংজ্ঞা ও প্রয়োগের ব্যাপারটি কিছুটা অস্বচ্ছ রয়ে গেল। ধর্মনিরপেক্ষতার অনেক রকম অর্থ হতে পারে। প্রচলিত পশ্চিমী ধারণায় এর অর্থ হল রাষ্ট্র ও ধর্মীয় সংগঠনের সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্নকরণ ও ধর্মকে ব্যক্তিগত পরিসরে আবদ্ধ রাখা। আমাদের সংবিধানে প্রাধান্য দেওয়া হল গাঁধীবাদী ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণাকে, যাতে কোনও ধর্মই রাষ্ট্রীয় ধর্মের স্বীকৃতি পেল না, সব ধর্মই সমমর্যাদায় অধিষ্ঠিত হল। কিন্তু অন্য দিকে সাম্প্রদায়িকতা রোধের প্রশ্নে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রতি একটা সন্দেহের ভাব প্রকাশ পেল। তাদের জন্য সংরক্ষণ নীতি বর্জন করা হল; সংখ্যালঘুর অধিকার সুরক্ষিত করতে অন্য কোনও রক্ষাকবচও রাখা হল না।

সাম্প্রদায়িকতা প্রসঙ্গে অম্বেডকর এই সময় মন্তব্য করেছিলেন যে, আমাদের সংখ্যালঘুরা যখন তাঁদের অধিকার দাবি করেন তখন তা সাম্প্রদায়িকতা বলে চিহ্নিত হয়, আর সংখ্যাগরিষ্ঠরা যখন তাঁদের আধিপত্য কায়েম করেন, তাকে বলা হয় জাতীয়তাবাদ! ব্যবহারিক ক্ষেত্রে দেশভাগ-পরবর্তী ভারতে সংখ্যালঘুদের প্রতি যে সন্দেহের ভাব বর্তমান ছিল, সে সম্বন্ধে পণ্ডিত নেহরু অবহিত ছিলেন, কিন্তু তাকে প্রশমিত করতে পারেননি। বার বার মুখ্যমন্ত্রীদের চিঠি দিয়ে তিনি বলেছেন যে, মুসলমান সম্প্রদায়ের যাঁরা ভারতে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাঁরাও এই দেশের নাগরিক, সমানাধিকারের দাবিদার। কিন্তু তাতে বিশেষ কাজ হয়নি। গণপরিসরের বিভিন্ন স্তরে সব ধর্মের সম-অধিকার প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে ‘সংখ্যালঘু সাম্প্রদায়িকতা’র মোকাবিলা করার নামে সংখ্যাগরিষ্ঠের ‘জাতীয়তাবাদ’ উত্তরোত্তর তার শক্তি বৃদ্ধি করেছে। অথবা সংখ্যালঘুদের শুধুই ভোট ব্যাঙ্ক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।

সংখ্যাগরিষ্ঠের সামাজিক গোঁড়ামি, বিশেষ করে মহিলাদের অধিকারের বিষয়ে তাঁদের রক্ষণশীলতার পরিচয় অম্বেডকর পেয়েছিলেন ১৯৫১ সালে, আইনমন্ত্রী হিসেবে হিন্দু কোড বিল চালু করতে গিয়ে। তবে সংবিধান রচয়িতা হিসেবে তাঁর দু’টি বড় সাফল্য ছিল— অস্পৃশ্যতা নিষিদ্ধ হয়ে যায় আর তফশিলি জাতি ও জনজাতিদের জন্য সংরক্ষণের নীতি গৃহীত হয় দশ বছরের জন্য। আশা করা গিয়েছিল এই সময়ের মধ্যেই তাদের আর্থসামাজিক অবস্থানের উন্নতি ঘটবে, কিন্তু বিভিন্ন কারণে তা আজও কার্যত হয়নি। অস্পৃশ্যতা ও জাতপাতের বৈষম্য দূর করা যায়নি পুরোপুরি। অন্য দিকে, সংরক্ষণ নীতির ফলে দলিত সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ ও আক্রোশ বেড়েছে। দলিতদের ওপর অত্যাচারের ঘটনা প্রায় নিত্যই শোনা যায় আজকাল।

অর্থাৎ যে ঘটনাগুলিকে আজ অনেকেই একটা সঙ্কটের লক্ষণ বলে মনে করছেন, সেগুলির সূত্রপাত কিন্তু প্রজাতন্ত্রের আদি পর্বেই। গত সত্তর বছরে এই সামাজিক রাজনীতিক প্রবণতাগুলি পরিপুষ্ট হয়েছে দলমতনির্বিশেষে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় এবং নাগরিক ঔদাসীন্যে। আমরা এখন একটি দীর্ঘ ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার পরিণতিপর্ব লক্ষ করছি মাত্র।

নিউজিল্যান্ডে ইউনিভার্সিটি অব ওয়েলিংটন (ভিক্টোরিয়া)-য় ইতিহাসের শিক্ষক, নিউজিল্যান্ড ইন্ডিয়া রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টর

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Republic Day Press Freedom Jawaharlal Nehru
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE