Advertisement
০৬ মে ২০২৪
প্রবন্ধ ২

তাঁকে মনে করতে এত দিন লাগল!

ছা ত্রটি একটু হকচকিয়ে গেছে। কারণ, একটু আগেই ক্লাসের মৌখিক পরীক্ষায় তার প্রিয় মাস্টারমশাই তাকে বলেছেন, বাড়ি থেকে বেরিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ব বিভাগে পৌঁছনো অবধি ছাত্রটির যাত্রাপথের পরিপার্শ্বের অনুপুঙ্খ বিবরণ দিতে।

শিবাজীপ্রতিম বসু
শেষ আপডেট: ১৫ নভেম্বর ২০১৬ ০০:০০
Share: Save:

ছা ত্রটি একটু হকচকিয়ে গেছে। কারণ, একটু আগেই ক্লাসের মৌখিক পরীক্ষায় তার প্রিয় মাস্টারমশাই তাকে বলেছেন, বাড়ি থেকে বেরিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ব বিভাগে পৌঁছনো অবধি ছাত্রটির যাত্রাপথের পরিপার্শ্বের অনুপুঙ্খ বিবরণ দিতে। মৌখিক পরীক্ষাটি ছিল ‘ক্ষেত্রসমীক্ষা’ বা ‘ফিল্ড-স্টাডি’ বিষয়ক। নৃতত্ত্ব বা অ্যান্থ্রোপলজি-চর্চায় ক্ষেত্রসমীক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। এটা ছাড়া সামাজিক নৃতত্ত্ব অসম্ভব। সে দিন ছেলেটি অস্বস্তিতে পড়লেও পরে বুঝেছিল, আসলে তার শিক্ষক বলতে চেয়েছিলেন, নৃতত্ত্বের ছাত্র যদি নিজের পরিচিত, প্রাত্যহিক জীবনের চার পাশের ঘটনাবলি ও লোকজনদের যথাযথ বিবরণ দিতে না পারে, কীভাবে সে ভবিষ্যতের নৃতাত্ত্বিক হিসেবে একটি অচেনা সংস্কৃতির লোকজীবনের খুঁটিনাটি পর্যবেক্ষণ করবে?

কলকাতা তথা ভারতে নৃতত্ত্ববিজ্ঞানের প্রথম প্রজন্মের ছাত্রদের তীক্ষ্ণ চোখে লোকজীবন পর্যবেক্ষণ করার কৃৎকৌশল হাত-ধরে শেখানো, এই অসামান্য শিক্ষক, তারকচন্দ্র দাস (১৮৯৮-১৯৬৪) আজ বিস্মৃতির আড়ালে। যে অর্থে পরবর্তী প্রজন্মের নৃবিজ্ঞানীরা নির্মলকুমার বসু, ব্রজশঙ্কর গুহ, ক্ষিতীশপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, ধীরেন মজুমদার, ইরাবতী কার্ভে, ভেরিয়ার এলউইন প্রমুখ পথিকৃৎ নৃতত্ত্বের শিক্ষক/গবেষকদের মনে রেখেছেন, সেই অর্থে, কেন একই প্রজন্মের অতি তন্নিষ্ঠ শিক্ষক, মেধাবী গবেষক ও ভবিষ্যৎ-দ্রষ্টা মানুষটিকে বেমালুম ভুলে গেলেন, তা সত্যিই যুগপৎ বেদনা ও অনুসন্ধানের বিষয়।

অথচ, কেবল ভাল শিক্ষক হিসেবেই নয়, ১৯২২ থেকে ১৯৪০, এই আঠারো বছরের মধ্যে ভারতের উত্তর-পূর্ব ও পূর্ব অঞ্চলগুলির বিভিন্ন আদিবাসী/জনজাতি ও অ-আদিবাসী গোষ্ঠীর, যেমন, মণিপুরের পুরুম কুকি, হো, ভূমিজ, খারিয়া চিরু, ভাটুরি প্রভৃতি নানা জনগোষ্ঠীর উপরে অতি পরিশ্রমী ক্ষেত্রসমীক্ষা চালিয়ে যে তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণভিত্তিক বৈজ্ঞানিক বিবরণ বা ‘এথনোগ্রাফি’ প্রস্তুত করেন তারকচন্দ্র, তা পরবর্তী বহু গবেষণার নির্ভরযোগ্য ভিত হিসেবে কাজ করেছে। ১৯৪১ সালে ইন্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেসের নৃতত্ত্ব বিভাগীয় সভাপতি হিসেবে তিনি যে-বক্তৃতা দেন তাতে কী ভাবে ভারতীয় জাতিগঠনে নৃতাত্ত্বিক জ্ঞানকে কাজে লাগানো যাবে, বা কেন সরকারি নীতিনির্ধারণে নৃতত্ত্ববিজ্ঞানের ভূমিকা থাকা জরুরি— এই সব অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ তুলেছিলেন। এ ছাড়া, তাঁর আর একটি কীর্তি, ১৯৪৩-এর মন্বন্তরের সময়, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ব বিভাগের কিছু দক্ষ শিক্ষক/গবেষকদের নিয়ে একটি অনুসন্ধানী দল গঠন করে কলকাতা তথা অবিভক্ত বাংলার জেলায় জেলায় ঘুরে ‘বেঙ্গল ফেমিন’ নামে বাংলার দুর্ভিক্ষ বিষয়ক একটি তথ্যসমৃদ্ধ গ্রন্থ রচনা করেন, যা পরবর্তী পর্যায়ে এ বিষয়ে যাঁরাই কাজ করেছেন, তাঁদের প্রাথমিক সূত্র হিসেবে কাজ করেছে। অমর্ত্য সেনও বাংলার দুর্ভিক্ষ বিষয়ক জগদ্বিখ্যাত কাজে তারকচন্দ্র দাসের এথনোগ্রাফিকে কাজে লাগিয়েছেন। যদিও দুর্ভিক্ষের কারণ বিষয়ে দাস ও সেন একই সিদ্ধান্তে পৌঁছননি।

এই বিস্মৃতির উল্টো পিঠে আছেন নির্মলকুমার বসু, কিছু সময়ের জন্য মহাত্মা গাঁধীর সচিব, যিনি গাঁধী বিষয়ক নানা গ্রন্থ রচনা করে বা তাঁর রচনার অনবদ্য নির্বাচিত সংকলন প্রকাশ করে নৃতত্ত্ববিদ বা সমাজবিজ্ঞানী পরিচয়ের বাইরে, ভারত এবং বিদেশ— সর্বত্র গাঁধী-অনুরাগী ও গবেষকদের কাছে অতি পরিচিত খ্যাতিমান। ভারতীয় ‘জনজাতি’দের নিয়ে গবেষণা চালিয়ে এক বিশিষ্ট সিদ্ধান্তে উপনীত হন নির্মলকুমার, যা তাঁর এ বিষয়ে রচিত একটি নিবন্ধেরও নাম ‘দ্য হিন্দু মেথড অব ট্রাইবাল অ্যাবসর্পশন’(১৯৫৩)। তাঁর মতে, যেমন পদার্থবিদ্যা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উচ্চতর ক্ষমতাসম্পন্ন অংশ থেকে নিম্নতর অংশে প্রবাহিত হয়, সংস্কৃতির প্রবাহও তেমনই অর্থনৈতিক ভাবে প্রভাবশালী গোষ্ঠীর থেকে দুর্বল গোষ্ঠীর দিকে ধাবিত হয় এবং ইতিহাসের কোনও এক দুর্ঘটনা মুহূর্তে বৃহত্তর উৎপাদন সংগঠন গড়ে তুলতে এই গোষ্ঠীগুলি এক সূত্রে আবদ্ধ হয়।

সমাজতত্ত্বের যে কোনও মনস্ক পাঠকই নির্মলকুমারের এই তত্ত্বের সঙ্গে এর আগের বছর (১৯৫২) প্রকাশিত গ্রন্থে, এম এন শ্রীনিবাস বর্ণিত দক্ষিণ ভারতের কুর্গের জনজাতিদের মধ্যে ব্রাহ্মণ্যসমাজে ‘ওঠা’র (আপওয়ার্ড মবিলিটি) বা ‘ব্রাহ্মণ্যায়ন’-এর— যা পরবর্তী কালে ‘স্যান্‌স্ক্রিটায়ন’ নামে বেশি পরিচিত— সেই প্রক্রিয়ার মিল খুঁজে পেতে পারেন। কেবল শ্রীনিবাস নন, বিশ শতকের জাতীয়তাবাদী চর্চায় অনেকেই, যেমন নৃপেন্দ্রকুমার দত্ত, তাঁর ‘এরিয়ানাইজেশন অব ইন্ডিয়া’ (১৯২৫) বা ভারতের আর্যায়ন গ্রন্থে অনেকটা একই ধরনের সিদ্ধান্তে এসেছিলেন। ‘স্যান্‌স্ক্রিটায়ন’ নামটি চয়নের কৃতিত্ব অবশ্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের। ‘কিরাত’ জনগোষ্ঠী বিষয়ে লেখা বইটিতে (১৯৫১) তিনি এই ধারণার মাধ্যমে দেখাতে চেয়েছেন, ভারত ছাড়িয়ে আফগানিস্তান, পূর্ব ইরান, সিংহল সহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিস্তৃত অঞ্চল, এমনকী চিন ও তৎপ্রভাবিত জাপান, কোরিয়া, ভিয়েতনামের নানা জনগোষ্ঠী এই সাংস্কৃতিক ‘স্যান্‌স্ক্রিটায়ন’-এর মধ্য দিয়ে এক ‘বৃহৎ ভারত’ রচনা করেছে।

নির্মলকুমার বসুর ‘উপজাতিগুলির নৃতাত্ত্বিক অন্তর্ভুক্তির হিন্দু পদ্ধতি’র ধারণা তথা এই বিষয়ক প্রচলিত ও প্রভাবশালী মতের বিপরীতে, কোনও সহজিয়া ব্যাখ্যার ধার না ধেরে, তারকচন্দ্র দাস তাঁর পূর্ববর্তী কাজে (১৯৩১) দেখান, কীভাবে ছোট নাগপুর, ওড়িশা বা বাংলার পশ্চিমাঞ্চলে (‘জঙ্গল মহল’ অঞ্চলে), মুখ্যত রেললাইন পাতা ও অন্যান্য কাজে কাঠের প্রয়োজনে ঔপনিবেশিক শাসকদের আগ্রাসনে আগেকার প্রায়-অগম্য আদিবাসী অধ্যুষিত বনাঞ্চলগুলিতে কেবল বিদেশি শাসক নয়, তাদের দেশজ কর্মী ও হিন্দু ব্যবসায়ী, মহাজন ও পরে উন্নত কৃষিজীবী হিন্দুদের প্রভাব বাড়তে থাকে, এবং আদিবাসীদের বড় অংশ ক্রমশ আরও দুর্গম অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে থাকে। তাদেরই কিছু অংশ যারা পুরনো জায়গায় রয়ে গেল, তাদের অনেকে এই নতুন (হিন্দু) সংস্কৃতির অভিঘাত অগ্রাহ্য না করতে পেরে, ধীরে ধীরে নানা নতুন সামাজিক প্রথা ও ধর্মাচরণের চিহ্ন গ্রহণ করেছে। কিন্তু যারা আরও অভ্যন্তরে চলে গেল, তারা আবার নিজেদের সমাজ ও সংস্কৃতি রক্ষা করতে বহির্জগতের বিরুদ্ধে নানা ধরনের সামাজিক নিষেধের (‘ট্যাবু’) প্রাচীর তুলল।

প্রসঙ্গত, মতাদর্শগত ভাবে তারকচন্দ্রও জাতীয়তাবাদী ছিলেন। কিন্তু একই সঙ্গে তিনি অতি নিষ্ঠাবান দৃষ্টবাদী এথনোগ্রাফারও ছিলেন— যা পর্যবেক্ষণ করেছেন, তার ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, পূর্বনির্ধারিত তত্ত্বের চশমায় ‘বাস্তব’কে দেখতে চাননি। তবে কি স্রোতের বিপরীতে হেঁটেছেন বলেই তিনি আজ বিস্মৃতির অন্তরালে? বস্তুত, প্রভাবশালী (হিন্দু) জাতীয়তাবাদী নৃতত্ত্বের বিপরীতেই নয়, নৃতত্ত্বের মার্ক্সবাদী ঘরানাও তিনি যান্ত্রিক ভাবে গ্রহণ করতে পারেননি। ফলে, কী ভাবে প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নে এশিয়ার প্রথাগত রক্ষণশীলতার ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে এসে মেয়েরা স্বাধীনতার আস্বাদন পেয়েছে, তার যেমন প্রশংসা করেছেন, তেমনই এ দেশে, দুই বামপন্থী বুদ্ধিজীবী, প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ ও ক্ষিতীশপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় কৃত বাংলার মন্বন্তর (১৯৪৩) নিয়ে সমীক্ষাও মেনে নিতে পারেননি। কারণ, যে ৯২ জন সমীক্ষক এই সমীক্ষা চালিয়েছিল, তাদের অধিকাংশই ছিল কমিউনিস্ট পার্টির শাখা সংগঠন, সারা ভারত কিসান সভার বঙ্গ প্রদেশের সদস্য। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করে সমীক্ষা চালানোর প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা অনেকেরই ছিল না। অন্য দিকে, তারকচন্দ্রের সমীক্ষক দল ক) ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ ও জ্ঞান; খ) অণু-সমীক্ষা (জিনিওলজিক্যাল) পদ্ধতি ও গ) আখ্যান পদ্ধতি অনুসরণ করে দুর্ভিক্ষপীড়িতদের এথনোগ্রাফি করে ভয়াবহতার ‘পূর্ণ’ চিত্র পুনর্নির্মাণের তথা মৃতদের প্রকৃত সংখ্যা ও দুর্ভিক্ষের কারণ নির্ণয়ের চেষ্টা করেন। এই প্রসঙ্গে জওহরলাল নেহরু ‘দ্য ডিস্কভারি অব ইন্ডিয়া’য় তারকচন্দ্র পরিচালিত সমীক্ষাটির প্রশংসা করে লেখেন, যখন সরকারি প্রচারে মৃতদের সংখ্যা অনেক কমিয়ে দেখানো হচ্ছে, তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমীক্ষক দলটি বিপুল বৈজ্ঞানিক সমীক্ষা চালিয়ে দেখিয়েছে, এই সংখ্যা ৩৪ লাখের কাছাকাছি!

এমন এক অসামান্য গবেষক-শিক্ষককে অবশ্য কেউ কেউ মনে রেখেছেন, যেমন নৃতত্ত্ব বিজ্ঞানের বিশিষ্ট গবেষক ও শিক্ষক অভিজিৎ গুহ। আন্দ্রে বেতেই থেকে সুরজিৎ সিংহের মতো সুখ্যাত মানুষরা যাঁর ছাত্র, তাঁর জীবন ও গবেষণা নিয়ে একটি মূল্যবান পুস্তিকা রচনা করতে এত সময় লাগল! সত্যি, আমরা আত্মবিস্মৃত জাতি বটে!

ঋণ: অভিজিৎ গুহ, তারকচন্দ্র দাস: অ্যান আনসাং হিরো অব ইন্ডিয়ান অ্যান্থ্রোপলজি, স্টুডেরা প্রেস, দিল্লি

বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE