Advertisement
E-Paper

রাস্তায় নামল অর্ধেক আকাশ

দক্ষিণ কোরিয়া এখন গোপন ক্যামেরার দেশ। পাবলিক টয়লেট, পোশাকের ট্রায়াল রুম, টেবিলের নীচের পায়া, স্কুলের ক্লাসরুম, গাড়ির স্টিয়ারিংয়ের পাশ, সর্বত্র লাগানো থাকছে স্পাই ক্যামেরা। অসাধু ব্যক্তিরা কারও একান্ত গোপন বিষয়ের ছবি ইন্টারনেটে ভাইরাল করে বা পর্নো ভিডিয়ো বানিয়ে বিক্রি করে টাকা রোজগার করছে।

সোনালী দত্ত

শেষ আপডেট: ১০ অগস্ট ২০১৮ ০০:০০

মুণ্ডিতমস্তক নারী মঞ্চে উঠলেন। উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করলেন, “এই হল তোমাদের প্রতি আমার বার্তা। আমি তোমার যৌনতার সাধ মেটাবার উপকরণ নই! আমি এই দেশের এক প্রথম শ্রেণির নাগরিক, ঠিক যেমন তুমিও।’’ মুহূর্তে এই বার্তা নারীর তথাকথিত শরীরকেন্দ্রিক সৌন্দর্যকে ছাপিয়ে এক মুক্ত মানসের ক্যানভাসে তাঁকে অনন্য সুন্দর অস্তিত্ব হিসাবে এঁকে ফেলল। দক্ষিণ কোরিয়ার সোল-এ গুয়ানঘামুন স্কোয়ারে তখন মিছিলের লাল সমুদ্র। হাতে হাতে পোস্টার। কোনওটায় লেখা, “যদি আমরা পুড়ি, তোমরাও পুড়বে।’’ কোনওটায় লেখা, “আমার জীবন তোমার অশ্লীলতার জায়গা নয়।’’ ‘আমি’ কে? দক্ষিণ কোরিয়ার সেই নারী, যার জীবনের অমূল্য গোপনীয়তার অধিকার সেখানে প্রতি মুহূর্তে লঙ্ঘিত হচ্ছে। আর ‘তুমি’? বিকৃতকাম পুরুষ, যে গোপন ক্যামেরায় ইচ্ছামতো বে-আব্রু করছে নারীকে। আর সেই স্টিল বা ভিডিয়ো ইন্টারনেটের মাকড়সা জালে ছড়িয়ে দিচ্ছে ভাইরাসের মতো।

দক্ষিণ কোরিয়া এখন গোপন ক্যামেরার দেশ। পাবলিক টয়লেট, পোশাকের ট্রায়াল রুম, টেবিলের নীচের পায়া, স্কুলের ক্লাসরুম, গাড়ির স্টিয়ারিংয়ের পাশ, সর্বত্র লাগানো থাকছে স্পাই ক্যামেরা। অসাধু ব্যক্তিরা কারও একান্ত গোপন বিষয়ের ছবি ইন্টারনেটে ভাইরাল করে বা পর্নো ভিডিয়ো বানিয়ে বিক্রি করে টাকা রোজগার করছে। মুখ বাঁচাতে দেশের পুলিশ দাবি করেছে, শুধু নারী কেন, পুরুষও আজ গোপন ক্যামেরার শিকার। পরিসংখ্যান এই প্রশ্নের যোগ্য জবাব দিয়ে দেখাচ্ছে, ২০১২ থেকে ২০১৬-র মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ায় যত পর্নো ছবি করা হয়েছে, তার আশি শতাংশই নারীশরীর নিয়ে। গোপনে নারীর অশ্লীল ছবি তুলে তাই নিয়ে ব্যবসা বা কাম চরিতার্থ করার ঘটনা পুলিশের খাতায় উঠেছিল ২০১০ সালে ১০১০টি। গত বছর এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৫০০। এমনকি এখন সে দেশে প্রচণ্ড গরম পড়া সত্ত্বেও সমুদ্রের ধারে মেয়েরা নিজেদের মতো ঘুরতে পারছেন না স্পাই ক্যামেরার ভয়ে। বাথরুমে ঢুকতে আতঙ্কিত হচ্ছেন লরা বাইকারের মতো ‘বিবিসি’র সাংবাদিকও।

দক্ষিণ কোরিয়া ২০০৪ সাল থেকেই নিয়ম করেছে, মোবাইল ক্যামেরায় ছবি তোলার সময় একটি শব্দ হতে হবে। কিন্তু এখন নির্দিষ্ট কিছু অ্যাপ্লিকেশন ডাউনলোড করে শব্দ মিউট করে দেওয়া হচ্ছে। গোপনে কারও অশ্লীল ছবি তুলে ধরা পড়লে পাঁচ বছর জেল ও জরিমানার শাস্তি সে দেশের আইনে আছে। ছবি তুলে বিক্রি করে অর্থোপার্জন করলে জেল আরও দু’বছর বাড়বে, জরিমানা বাড়বে অনেকটা। কিন্তু এই শাস্তিও ক্যামেরা দুষ্কৃতকারীদের মোটেই ঠেকাতে পারছে না। অভিযোগ উঠেছে, স্পাই ক্যামেরার শিকার পুরুষ হলে পুলিশ গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করছে। যেমন কিছু দিন আগে এক তরুণী তাঁর কলিগের নুড ছবি তুলে ইন্টারনেটে দিয়েছেন বলে গ্রেফতার হয়েছেন। অথচ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে যখন অন্যায়ের শিকার নারী, পুলিশ তখন চুপ। নয়তো কেস বন্ধ করে দিচ্ছে। তাদের বক্তব্য, বছরখানেক তদন্ত চালিয়ে তারা নাকি অভিযোগের সত্যতা প্রমাণের সপক্ষে কিছুই জোগাড় করতে পারেনি। সোল মেট্রোপলিটনের পুলিশ চিফ লি জু-মিন বলেছেন, ‘‘পুরুষ-নারী বিশেষে তদন্তে কোনও বৈষম্য বা অবিচার করা হচ্ছে না।’’ অথচ থানার দরজায় বারেবারে জনতা কড়া নেড়ে বলছে, “তাদের শাস্তি দাও, যারা নারী শরীর নিয়ে ছবি বানায়, যারা অশ্লীল ভিডিয়ো ইন্টারনেটে আপলোড করে, যারা এই সব ভিডিয়ো পয়সা দিয়ে কেনে।’’

প্রতিবাদে পথে নেমেছেন দক্ষিণ কোরিয়ার মেয়েরা। গত বছর থেকে সে দেশে ‘মি টু’ আন্দোলন শুরু হয়েছে। বহু নামী মানুষের মুখোশ খুলে গিয়েছে। এর মধ্যে আছেন শাসক দলের নেতা আহন-হি-জুংও। আন্দোলন আঙুল তুলেছে সমাজের তথাকথিত ভাল মানুষদের দিকে। এঁদের পঁচানব্বই শতাংশই পুরুষ। শিক্ষক, যাজক, অভিনেতা, সরকারি অফিসার, পুলিশ এমনকি কোর্টের বিচারক পর্যন্ত রয়েছেন সে তালিকায়। এই মাসের প্রথম শনিবার সোলের অর্ধেক আকাশ রাস্তায় নেমে এসেছিল। কত মেয়ে শামিল হয়েছিলেন প্রতিবাদে? প্রত্যক্ষদর্শী এবং সংগঠকরা বলছেন, মিছিলে পা মিলিয়েছেন কমপক্ষে পঞ্চান্ন হাজার নারী। নারীর সম্মানের জন্য, মানবাধিকার রক্ষার জন্য, অশ্লীল ভিডিয়োর বিষয় হওয়া থেকে বাঁচার জন্য, অপমানকারীকে সাজা দেওয়ার জন্য, সরকারকে নাড়িয়ে দেওয়ার জন্য এমন উদ্যোগ এর আগে পৃথিবী কমই দেখেছে।

হ্যাঁ, সরকারের টনক নড়েছে। দেশের প্রেসিডেন্ট মুন জে ইন এই সব ঘটনায় দুঃখপ্রকাশ করেছেন৷ বিরক্ত হয়ে বলেই ফেলেছেন, “দক্ষিণ কোরিয়ার লোকেদের হল কী?” দোষীদের কঠোর শাস্তি দেওয়ার অঙ্গীকার করে তিনি আরও বলেছেন, “অপরাধীরা তার চেয়ে বেশি যন্ত্রণা পাবে, যতটা যন্ত্রণা তারা দিয়েছে।’’ পুলিশকে বিরাট পরিমাণ অর্থ দেওয়ার কথা ঘোষণা করা হয়েছে তদন্তের স্বার্থে। পুলিশ এত দিন অপরাধের ‘প্রমাণ’ না পেলেও এখন তদন্ত জোরদার করেছে। স্পেশাল টিম গঠিত হয়েছে। তারা ‘ইনফ্রারেড স্ক্যানার’ দিয়ে ক্যামেরার লেন্স বা ডিভাইস খুঁজতে শুরু করেছে। বিভিন্ন জায়গায় সাধারণ মানুষকে নিয়ে ওয়ার্কশপ করে তারা দেখিয়ে দিচ্ছে কেমন করে বেসবল হ্যাট, বেল্ট, ঘড়ি, লাইটার, ইউএসবি স্টিক, নেকটাই, গাড়ির চাবি ইত্যাদির মধ্যে ক্যামেরা লুকিয়ে রাখা হয়। প্রতিবাদের ঝড় না উঠলে সচেতনতার এই সদর্থক চেহারা দেখা যেত কি না সন্দেহ।

সে দিন সোলের মিছিলে মেয়েরা হেঁটেছিলেন মুখ ঢেকে। না, লজ্জায় নয়। বেসবল হ্যাট, সানগ্লাস, সার্জিকাল মাস্ক-এ চেহারা লুকিয়ে তাঁরা কামুক পুরুষের মনের নগ্নতাকে আড়াল করে সভ্যতাকে অশ্লীলতার কলঙ্ক মুক্ত করার চেষ্টা করছিলেন। তীব্র ক্ষোভে টি-শার্টে লিখে রেখেছিলেন, “ক্রুদ্ধ নারী পৃথিবী বদলে দিতে পারে।’’ কোন পৃথিবী বদলাতে চান তাঁরা? সেই পৃথিবী, যে বুদ্ধি-বিবেক সমস্ত বিসর্জন দিয়ে অর্ধেক জনতাকে ভোগদখলের মাংসপিণ্ড হিসাবে দেখে। নারীর মধ্যে যত লড়াই, যত প্রতিভাই থাক, পুরুষের স্পাই ক্যামেরায় ধরা পড়ে কেবল কিছু গোপনাঙ্গ। সে ক্যামেরা দক্ষিণ আমেরিকার ট্রায়াল রুমে লাগানো থাকতে পারে, ফ্রান্সের টয়লেটে কিংবা ভারতবর্ষের মহিলা বিশ্রামাগারে। মিছিলে শামিল মানুষের হাতে হাতে ঘুরছিল লিফলেট: “মেয়েদের দিকে ধাবিত সমস্ত রকম সামাজিক বাধার বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই চলতে থাকবে। আমরা সেই পৃথিবী তৈরি করব, যার নেতৃত্ব দেব আমরা নিজেরাই।’’ সেই পৃথিবী শুধু দক্ষিণ কোরিয়ার নয়, গোপন চোখ সর্ব ক্ষণ যাঁদের রক্ত মাংস খুঁজে বেড়ায়, তাঁদের সক্কলের।

South Korea Protest Women Spy Camera
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy