Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
মৌমাছি

মৌমাছি উড়ে গেল মৌচাকে

আমাদের পুরনো পাড়া নয়াটোলার স্বর্ণাসন এবং আশেপাশের ছেলেমেয়েরাও সভ্য হয়েছিল।

—ফাইল চিত্র

—ফাইল চিত্র

দিলীপ দাশগুপ্ত
শেষ আপডেট: ১২ ডিসেম্বর ২০২০ ০১:০৮
Share: Save:

১৯৪১ সালের কথা। পটনায় আমাদের বাড়িতে আনন্দবাজার পত্রিকা আসত। আনন্দবাজার-এ প্রতি সোমবার ছোটদের বিভাগ প্রকাশিত হত, নাম আনন্দমেলা। পরিচালনা করতেন ‘মৌমাছি’ ছদ্মনামে কোনও শিশুসাহিত্যিক। থাকত গল্প, ছড়ার কবিতা, ধাঁধা, ছোটদের আঁকা ছবি, হাস্যকৌতুক। সঙ্গে ‘মৌমাছির চিঠি’। চিঠিতে থাকত ছোটদের জন্য উপদেশ ও পরামর্শ। খুব ভাল লাগত বিভাগটি। বিভাগের নীচে কুপন থাকত আনন্দমেলা-র সভ্য হওয়ার জন্য। আমি, আমার ভাই ও কুট্টিকাকা কুপন ভর্তি করে এক টাকার ডাকটিকিট কিনে আনন্দমেলা-য় পাঠালাম। তিনটি রঙিন কার্ড চলে এল।

আমাদের পুরনো পাড়া নয়াটোলার স্বর্ণাসন এবং আশেপাশের ছেলেমেয়েরাও সভ্য হয়েছিল। ‘মৌমাছির চিঠি’ পড়ে মানুষটির উপর শ্রদ্ধা-ভক্তি অত্যন্ত গভীর হয়েছিল এবং সেই কারণেই সকলেরই এক প্রশ্ন— কে এই মৌমাছি? তাঁর আসল নাম কী?

এক দিন স্বর্ণাসনের অলকাদি (অলকা গুপ্ত) জানালেন, গর্দানিবাগে গোখেলবাবুর বাড়িতে সাহিত্যসভায় ‘মৌমাছি’ আসছেন। গিয়ে দেখি বহু লোক জড়ো হয়েছেন সভার জন্য। কিন্তু কোথায় মৌমাছি? দিনের আলো ক্ষীণ। মঞ্চে কারও মুখই দেখা যাচ্ছে না ভাল করে। এঁদের মধ্যেই এক জন মৌমাছি নিশ্চয়ই। কৌতূহলের শেষ নেই। এক এক জন ভাষণ শেষ করছেন, কিন্তু মৌমাছির নাম তো ঘোষণা করছেন না। অলকাদি হঠাৎ উঠে আমাদের মধ্যে এসে নন্দিতাকে নিয়ে গেলেন। সে তখন পাঁচ বা ছয় বছরের। অলকাদি ওর কানে মন্ত্রণা দিয়ে মাইকের সামনে দাঁড় করিয়ে দিলেন। নন্দিতা দিব্যি মাইকটা ধরে মৌমাছিকে উদ্দেশ্য করে ছোট্ট ভাষণ দিল। “মৌমাছি ভাই, তোমার জন্য বহু দূর থেকে এখানে সমবেত হয়েছি। এক বার এসে দাঁড়াও আর কিছু বলো। ভয় নেই, আমরা তোমাকে ধরার চেষ্টা করব না। তুমি নির্ভয়ে উড়ে এসে দাঁড়াও, দেখা দাও, মধু দাও, আবার মৌচাকে ফিরে যেয়ো।” প্রচণ্ড হাততালির পরেই দেখি শ্রোতাদের মধ্যে থেকেই সুন্দর ও বেশ বলিষ্ঠ চেহারার এক ভদ্রলোক উঠে মাইকের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন, নন্দিতাকে ডেকে নাম জানতে চাইলেন। তার পরেই শুরু করলেন—“নন্দিতার আকুল আহ্বানে সাড়া না দিয়ে পারলাম না। আমিই ‘মৌমাছি’ ছদ্মনাম নিয়ে আনন্দমেলা-র পরিচালনা করি। আসল নাম জানাতে চাই না। দু’-চারটি কথা বলে আজই ফিরে যাব। আমি মৌমাছি, আমার কাজই হল দেশের বিভিন্ন পুষ্পোদ্যান থেকে মধু সংগ্রহ করে মৌচাক অর্থাৎ আনন্দমেলা-য় জমা করা এবং তোমাদের কাছে পরিবেশন করা। তোমাদেরও এই মধু সংগ্রহ করে ছড়িয়ে দিতে হবে শহরের, গ্রামের ও শহরতলির দূরদূরান্তে। এ বিষয়ে আমার বিশেষ পরিকল্পনা আনন্দমেলা-র মারফত তোমাদের জানাব। আনন্দমেলা-র দিকে নজর রেখো। বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, মহাত্মা গাঁধী, নেতাজি, দেশবন্ধু, বিদ্যাসাগর, রামমোহন রায় প্রমুখ মহাপুরুষেরা যে শিক্ষা সামনে রেখে গিয়েছেন তাকে সার্থক করে তোলাই হবে তোমাদের আদর্শ ও লক্ষ্য। সেই লক্ষ্যে কী ভাবে পৌঁছাবে তাই নিয়ে আমি এবং কয়েক জন সহকারী বন্ধু চিন্তা করছি এবং তোমাদের জানাব আনন্দমেলা-র মাধ্যমে।...”

তার পরই অন্ধকারের মধ্যেই ভিড়ের ভিতর দিয়ে মুহূর্তের মধ্যে মৌমাছি অদৃশ্য হয়ে গেলেন। গোখেলবাবু রসিকতা করলেন— “মৌমাছি! উড়ে চলে গেল। আর কী করে পাবে তাকে!”

অলকাদি ঘোষণা করলেন, প্রতি মঙ্গলবার বিকালে স্বর্ণাসনে ছেলেমেয়েদের নিয়ে সভা হবে। সেখানে আমরা ‘মৌমাছির চিঠি’ পড়ব, আলোচনা করব। কেউ গান শোনাবে, কেউ আবৃত্তি করবে, বিতর্কসভাও হবে। জ্ঞানী মানুষকেও ডাকব আলোচনার জন্য। বুঝলাম মৌমাছিভাই যে সংগঠনের ইঙ্গিত দিয়ে গিয়েছেন, অলকাদি আগেভাগেই আমাদের অঞ্চলে তার সূত্রপাত ঘটাতে চাইছেন। অলকাদি বললেন, আমাদের এই আনন্দ-সভার পক্ষ থেকে মৌমাছিরই লেখা যেদিন জাগবে মুকুল নাটকটি মঞ্চস্থ করা হবে। সেটি ছিল রূপক নাটক, সংলাপ ছিল কবিতার ছন্দে লেখা।

আনন্দমেলা-র পৃষ্ঠায় মৌমাছির সেই সাংগঠনিক পরিকল্পনাটি বিশদে প্রকাশিত হল। আনন্দমেলা-র সভ্যদের নিয়ে দেশের শহরে ও গ্রামাঞ্চলে যে সংগঠনগুলি গড়া হবে, তার নামকরণ করা হল ‘মণিমেলা’। ষোলো বছরের নীচে যে ছেলেমেয়েরা সংগঠনে যোগদান করবে, তারা ‘মণি’ অর্থাৎ রত্ন। সংগঠনটির প্রধান পরিচালক বা পরিচালিকা হবে ‘মধ্যমণি’। মণিমেলার তত্ত্বাবধানের ভারপ্রাপ্ত বয়স্ক শুভানুধ্যায়ী ‘মণিরক্ষক’ বা ‘মণিরক্ষিকা’।

নাট্যানুষ্ঠানের মধ্য দিয়েই প্রতিষ্ঠিত হল আমাদের ‘বাঁকিপুর মণিমেলা’। ৫০-৬০টি ছেলেমেয়ে নিয়েই শুরু হল মণিমেলার কাজ। গর্দানিবাগে, মিঠাপুরেও তৈরি হল মণিমেলা। ভারতের বিভিন্ন বড় শহরেও মণিমেলাগুলি গড়ে উঠেছিল। আনন্দবাজার পত্রিকা-র অনুপ্রেরণায় ছোটদের জন্য মৌমাছির এই সাংগঠনিক সাংস্কৃতিক আন্দোলনটি ঘিরে গড়ে উঠেছিল মৌমাছির মণির ভান্ডার। পরে জেনেছিলাম, ‘মৌমাছি’-র আসল নাম শ্রদ্ধেয় বিমল ঘোষ (ছবিতে)। আজ এই প্রথিতযশা শিশুসাহিত্যিকের জন্মবার্ষিকী, ১১০ বছরের। এখনকার দিনে শিশু-সাহিত্যিক গোত্রটিই যখন অদৃশ্য হতে বসেছে, এঁদের কথা যেন বিশেষ করে মনে পড়ে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE