Advertisement
১০ মে ২০২৪

জলঙ্গি খাতে লুকিয়ে রয়েছে কত না অতীতের সব গল্প

১৬৬০ খ্রিস্টাব্দে ভ্যান-ডে-ব্রুকের মানচিত্রে বড়-বড় করে লেখা ‘জলগাছি’ বলে যে নদীধারাটি দেখানো হয়েছে, সেটাই ছিল জলঙ্গির প্রবাহ। লিখছেন রাহুল হালদার ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দে ভ্যান-ডে-ব্রুকের মানচিত্রে বড়-বড় করে লেখা ‘জলগাছি’ বলে যে নদীধারাটি দেখানো হয়েছে, সেটাই ছিল জলঙ্গির প্রবাহ।

শেষ আপডেট: ০৫ মার্চ ২০১৯ ০১:৫১
Share: Save:

১৫১১ খ্রিস্টাব্দে চৈতন্যদেব পুরী থেকে শান্তিপুরে ফিরে এলে শচীমাতা ও অন্য ভক্তদের এই সংবাদ দেওয়ার জন্য নিত্যানন্দ ঠাকুর নবদ্বীপে গিয়েছিলেন। সেই সময়ে শান্তিপুরে অবস্থানকালে চৈতন্যদেব ফুলিয়ায় গিয়েছিলেন হরিদাসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। নিত্যানন্দ ঠাকুরের কাছ থেকে চৈতন্যদেবের ফিরে আসার সংবাদ পেয়ে নবদ্বীপবাসী যে খেয়াঘাটে এসেছিলেন, সেটাই ছিল জলঙ্গির খেয়াঘাট।

জলঙ্গির এই শাখাটি যে শান্তিপুরগামী ছিল তার আর একটি নির্ভরযোগ্য প্রমাণ হল নবদ্বীপস্থ শ্যামসুন্দর চৌধুরীকে মহারাজ শিবচন্দ্র রায়ের দত্ত সনন্দ। এই সনন্দে লেখা ছিল ‘চৌধুরী মহাশয়ের মহিশুরা গ্রামের সাবেক ব্রহ্মোত্তর ১৬/০ জমি খড়িয়ার ভাঙনের সিকস্তি হওয়ায় পুনরায় ১০/০ বিঘা জমি এত্তজ দেওয়া গেল'। সনন্দটি ১১৯১ সালের ৬ই আশ্বিন দেওয়া হয়েছিল এবং খড়িয়ার ভাঙন অর্থে এখানে জলঙ্গির কথাই বলা হয়েছিল। সেই সময় নবদ্বীপ থেকে শান্তিপুর-ফুলিয়া যেতে যে নদী পার হতে হতো, সেটা যে জলঙ্গি ভিন্ন অন্য কোনও নদী নয় তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

শুধু ব্রুকের মানচিত্রই নয়, তাঁর সমসাময়িক ১৬৮১ সালে বঙ্গীয় উপকূলের কোম্পানির এজেন্ট এবং গর্ভনর উইলিয়াম হেজেস ১৫ ও ১৬ অক্টোবর লেখা তাঁর দিনলিপিতে যা লিপিবদ্ধ করেছিলেন তাতেও আমরা ব্রুকের মানচিত্রে দেখানো জলঙ্গি নদীর অস্তিত্ব লক্ষ করি। হেজেস সাহেব লিখেছিলেন, তখনকার দিনে কোম্পানির সোরাবাহী তরণীগুলি ফুলিয়ায় থামত।

তাঁর ডায়েরি বলছে: “October 15;- being Sunday, we dined ashore at pulia, under a great shady tree near santapore, where all our saltpetre boats are ordered to stop.

October 16;- Early in the morning, we passed by a village called SINADGHUR and by 5 o'clock this afternoon, we got as far as Rewee, a small village belonging to woode ray, a jemadar that has all......”

হেজেস সাহেবের লেখা থেকে আমরা জানতে পারি, তিনি শান্তিপুরের কাছে ফুলিয়ায় রাতের খাবার খেয়ে, সেখানে রাত্রিবাস করে পরের দিন সকালে সিনাদগড় অর্থাৎ শান্তিপুরের সুরুগড় যাকে এখন সাড়াগড় বলে সেখান দিয়ে নৌকা করে রেউই পৌঁছেছিলেন। হেজেস ‘woode ray’ বলে যাঁকে উল্লেখ করেছেন তিনি যে রুদ্র রায় ছাড়া আর কেউ নন, সেই বিষয়ে সন্দেহ নেই। আর আমরা পূর্বেই বলেছি, নদিয়া বা নবদ্বীপ থেকে পূর্ব দিকে প্রবাহিত জলঙ্গির প্রবাহটি বাগআঁচড়ার কাছে মেশে। রুদ্র রায়ের আমলে বাগআঁচড়া একটি উন্নত জনবসতি-সম্পন্ন গ্রাম ছিল, কারণ তখন সেখানে থাকতেন রুদ্র রায়ের দেওয়ান সুপ্রসিদ্ধ চাঁদ রায় (কেউ বা তাঁকে বারো ভুঁইয়ার অন্যতম শ্রীপুরের চাঁদ রায় মনে করেন)। যিনি রুদ্র রায়ের একখানি আর্দশ ব্রাহ্মণপ্রধান স্থান স্থাপনের ইচ্ছাকে বাস্তব রূপ দেওয়ার জন্য তাঁর গ্রামের পাশে ব্রহ্মশাসনে এক শত আট ঘর নিষ্ঠাবান ও সুপণ্ডিত নিষ্কর ব্রাহ্মণের বসবাসের জায়গা করে দিয়েছিলেন। সেখানকার অধিবাসীরা তখনকার দিনে নবদ্বীপ ও রেউরে যেতে গেলে জলঙ্গির এই খাত দিয়ে যে যাতায়াত করত সেটা এক প্রকার নিশ্চিত। এখনও সেই বাগআঁচড়ার বিলের দক্ষিণ দিকে চাঁদ রায় কর্তৃক নির্মিত শিবমন্দিরের ধ্বংসাবশেষ সেই পুরনো ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে।

ব্রুকের মানচিত্রের জলগাছির তো প্রমাণ পাওয়া গেল। এখন প্রশ্ন হল, শান্তিপুরের তিন দিকে যে গঙ্গার প্রবাহ ছিল, তার সপক্ষে মজে যাওয়া খাত কিংবা বিল ছাড়া আর কি কোনও প্রামাণিক তথ্যপ্রমাণ আছে?

উত্তরে বলব— সেই নির্দেশ সূত্র আমরা পাই ১৭৭৪-৭৫ খ্রিস্টাব্দে জেনারেল হার্ট প্রকাশিত রেনেলের মানচিত্রে। যেখানে দেখা যাচ্ছে, বড় বড় করে যেখানে ‘শান্তিপুর’ লেখা তার কিছুটা পূর্ব দিকে কিছুটা নীচে, সেখান থেকে গঙ্গার দু’টি বাঁক ছিল।

ফলে, শান্তিপুর যে গঙ্গার দ্বারা পরিবৃত ছিল, সেই সন্দেহেরও নিরসন হল। অতএব, আলোচনাটি শেষ করব দীনেশচন্দ্র সেন সম্পাদিত এবং কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত ‘গোবিন্দদাসের কড়চা’র প্রথম পৃষ্ঠায় শান্তিপুরের কবি মোজাম্মেল হকের লিখিত একটি পাদটীকা দিয়ে।

এই পাদটীকায় কবি মোজাম্মেল হক জলঙ্গির এই প্রাচীন খাত সম্পর্কে যা লিখেছিলেন সেটি নিম্নরূপ— ‘‘বর্তমানে নবদ্বীপের অর্ধ মাইল পূর্বে গঙ্গানদীর পূর্বপারে এবং প্রাচীন নবদ্বীপের, অর্থাৎ মেয়াপুর ও বামনপুকুরিয়া পল্লীদ্বয়ের দেড় মাইল দক্ষিণে খড়িয়া বা জলঙ্গী-নদীর দক্ষিণ ধারে মহেশগঞ্জ গ্রাম আছে। মহেশগঞ্জের দক্ষিণ দিক হইতে আরম্ভ করিয়া একটি প্রাচীন জলপ্রবাহের খাত টেংরা, আমঘাটা, গঙ্গাবাস, উদিশপুর, ভালুকা, কুঁদপাড়া, শিংডাঙা, কুর্শী, টেরাবালি, গোয়ালপাড়া, কুলে, হিজুলি, বাঁকিপুরাদি গ্রামের পার্শ্ব দিয়া প্রায় ৫/৬ মাইল চলিয়া আসিয়া বাগাঁচড়া গ্রামে বাগ্দেবীর খালের সহিত মিলিত হইয়াছে। এই দীর্ঘ খাতটি স্থানে স্থানে কালের গতিতে মাটি ভরাট হইয়া গিয়াছে এবং ইহা স্থানে স্থানে ভিন্ন ভিন্ন নাম প্রাপ্ত হইয়াছে,--- যেমন অলকার বিল, গোপেয়ার বিল, বাগ্দেবীর খাল ইত্যাদি। বাগ্দেবীর খাল বাগাঁচড়া গ্রামের উত্তর দিয়া গঙ্গা নদী পর্যন্ত বিস্তৃত। বর্ষাকালে গঙ্গার জল এই খালের মধ্যে প্রবেশ করিয়া থাকে। প্রাচীনকালে ইহা যে বাগ্দেবী নদী নামে খ্যাত ছিলো তাহা নিঃসন্দেহ। এই বাগ্দেবী নদী নদীয়ার নিকট দিয়াই প্রবাহিত হইত। তখন নদীয়া গঙ্গানদীর পূর্ব-উত্তর তীরে এবং পদ্মার শাখা নদী জলঙ্গী বা খড়িয়ার পশ্চিম দিকে অবস্থিত ছিলো; তাহা হইলে বাগ্দেবী নদী গঙ্গা বা পদ্মা ইহার কোনোটি হইতে বর্হিগত হইয়াছিলো বলিতে হয়।"

(উদ্ধৃতির মধ্যে বানান অপরিবর্তিত)

শিক্ষক, শান্তিপুর হরিপুর উচ্চ বিদ্যালয়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Jalangi জলঙ্গি
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE