Advertisement
১৭ মে ২০২৪

বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুরা এবং শিক্ষার অধিকার

স্বাধীনতার এত বছর পরেও আমাদের রাজ্যে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জন্য স্কুলের সংখ্যা মাত্র ৭৪। বাঁকুড়া জেলায় মাত্র স্কুল রয়েছে তিনটি। আজও পাড়ায় পাড়ায় স্কুল, অথচ, ব্লকপিছু একটি করে বিশেষ স্কুল তৈরি হল না। লিখছেন সোমা মুখোপাধ্যায়এই গল্প থেকে সিদ্ধান্তে আসা যায়, কোনও মানুষকে মানসিক, শারীরিক ভাবে সক্ষম না করে যুদ্ধক্ষেত্রে ঠেলে দিলে হিতে বিপরীত হয়। সাফল্য তো মেলেই না, বরং ভয়, অক্ষমতা তাঁকে আকড়ে ধরে। আত্মগ্লানিতে ভেঙে যায় ব্যক্তির সীমিত ক্ষমতায় গড়া স্বপ্ন।

বিশেষ শিশুদের জন্য দরকার বিশেষ স্কুলও। নিজস্ব চিত্র

বিশেষ শিশুদের জন্য দরকার বিশেষ স্কুলও। নিজস্ব চিত্র

শেষ আপডেট: ২৪ জানুয়ারি ২০১৯ ০৩:৩৯
Share: Save:

‘রাকস্যাক’, ‘ক্র্যাম্পন’, ‘রোপ’, ‘আইস অ্যাক্স’, ‘আইস স্ক্রু’— সব দেওয়া হল এক দল তরুণকে। উদ্দেশ্য, শৃঙ্গজয়। তা-ও আবার যেমন তেমন শৃঙ্গ নয়, একেবারে এভারেস্ট। তরুণেরা হতবাক। তাঁদের কেউ কোনও দিন পাহাড়ে চড়েননি। না রয়েছে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ, মানসিক প্রস্তুতি, না তাঁদের শরীর তৈরি পর্বতারোহণের ধকল নিতে। ফলে, কেউ দৌড়লেন পিছন দিকে, কেউ বসে পড়লেন। কেউ বা উত্তেজনায় অসুস্থ হয়ে পড়লেন।

এই গল্প থেকে সিদ্ধান্তে আসা যায়, কোনও মানুষকে মানসিক, শারীরিক ভাবে সক্ষম না করে যুদ্ধক্ষেত্রে ঠেলে দিলে হিতে বিপরীত হয়। সাফল্য তো মেলেই না, বরং ভয়, অক্ষমতা তাঁকে আকড়ে ধরে। আত্মগ্লানিতে ভেঙে যায় ব্যক্তির সীমিত ক্ষমতায় গড়া স্বপ্ন।

আজ বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু-কিশোরেরা সমন্বয়করণ শিক্ষাব্যবস্থায় সরকারি প্রাথমিক, উচ্চ প্রাথমিক, মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষালাভের অধিকারী হয়েছে। আমরা গর্বিত, শিক্ষার অধিকার আইন ফলপ্রসূ হয়েছে। সাধারণ বুদ্ধাঙ্কযুক্ত, শারীরিক ভাবে সক্ষম শিশুদের সঙ্গে কম বুদ্ধাঙ্কের ও শারীরিক ভাবে তুলনায় দুর্বল শিশুদের শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করতে রাষ্ট্র সক্ষম হয়েছে।

কিন্তু বাস্তব বড় কঠিন। শিক্ষার অধিকার আইন বলছে, ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত প্রতিটি শিশুর শিক্ষার অধিকার সুনিশ্চিত করতে হবে। তাই আর পাঁচটা সাধারণ শিশুর মতো বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদেরও ভর্তি হতে হচ্ছে সরকারি সাধারণ স্কুলে। আমরা কি এক বারও ভেবেছি, যে শিশুটির এক জায়গায় বসে থাকার ক্ষমতা খুব বেশি হলে এক থেকে দু’মিনিট, যার শিক্ষকের কথা শোনার ক্ষমতা নেই, পেনসিল ধরার জন্য যার আঙুলগুলি প্রস্তুত নয়, যার শৌচে নিয়ন্ত্রণ নেই, সে কী করে এই শিক্ষাব্যবস্থার অঙ্গ হবে? যে শিশুটির মুখ দিয়ে অবিরাম লালা ঝরছে, শিক্ষক অনর্গল বকে গেলেও যার তা বোঝার বিশেষ ক্ষমতা নেই, এমন কাউকে এক দল সাধারণ বুদ্ধাঙ্ক, অতি বুদ্ধাঙ্ক বা অসাধারণ বুদ্ধাঙ্কের শিশুদের সঙ্গে, উপযুক্ত প্রশিক্ষণহীন শিক্ষকদের সঙ্গে, অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে তৈরি বেঞ্চ, সিঁড়ি এবং সর্বোপরি পাঠ্যক্রমের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হল— এ কোন আইন! এর ফলে, এই সব শিশু-কিশোরদের একটা বড় অংশ লজ্জা, ভয়, মানসিক গ্লানির শিকার হয়ে এগিয়ে চলার মানসিকতা হারিয়ে ফেলছে। আর তাদের বাবা-মায়েরা সন্তানের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে চোখের জল ফেলছেন।

কম প্রতিবন্ধকতাসম্পন্ন শিশুদের সমন্বয়করণ শিক্ষার আওতায় আনা গেলেও এক বিরাট অংশের বেশি প্রতিবন্ধকতাসম্পন্ন শিশুদের জন্য সাধারণ স্কুলের সমন্বয়করণ পদ্ধতি একেবারেই অনুপযুক্ত। তবে কি এমন শিশুরা শিক্ষিত হবে না? অবশ্যই হবে। আর সেটা সম্ভব বিশেষ রীতি মেনে, বিশেষ পরিকাঠামোয়, বিশেষ শিক্ষক-শিক্ষিকার সহায়তায় বিশেষ পদ্ধতিতে, বিশেষ স্কুলে শিক্ষাদানের মাধ্যমে। এমন বিশেষ স্কুলগুলিকে পোষিত করত জনশিক্ষা প্রসার ও পাঠাগার পরিষেবা বিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার। এই দফতরের অনুমোদনে, পোষিতকরণে তৈরি হয়েছে ৭৪টি বিশেষ স্কুল, যেখানে এমন শিশুরা সুরক্ষিত। সুরক্ষিত তাদের অধিকার।

২০১০ সালের ২৭ অক্টোবর। তৎকালীন স্কুলশিক্ষামন্ত্রী মাননীয় পার্থ দে এবং বিভাগীয় মন্ত্রী তপন রায় ক্যাবিনেটে সিদ্ধান্ত নেন, এই বিভাগ আর কোনও স্কুলকে পোষণের ভার নেবে না। শিক্ষার অধিকার আইন অনুযায়ী, সব শিশু সাধারণ স্কুলে পড়াশোনা করবে। সেই মোতাবেক আইন বলবৎ হয় (আদেশনামা-1104/MEE/Sect dated 24.11.2010)। এতে রাজ্যের বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু-কিশোরেরা শিক্ষার সুযোগ হারাল। এই সব শিশুর অব্যক্ত যন্ত্রণা, বাবা-মায়ের অসহায় আবেদনে সে দিন কেউ পাশে এসে দাঁড়াননি। স্বাধীনতার এত বছর পরেও আমাদের রাজ্যে এমন বিশেষ স্কুলের সংখ্যা ৭৪ এবং বাঁকুড়া জেলায় মাত্র তিনটি, যেগুলি এই বিভাগের অনুমোদন প্রাপ্ত। আজ পাড়ায় পাড়ায় স্কুল, অথচ, ব্লকপিছু এক়টি করে বিশেষ স্কুল তৈরি হল না।

২০১০ সালের শিশুটি আজ কৈশোর পার করেছে, কিশোর যুবক হয়েছে, যুবক প্রৌঢ়ত্বের দিকে এগিয়ে চলেছে। কিন্তু শৈশব তাদের পিছু ছাড়েনি। কারণ, বিশেষ স্কুলের অভাবে তাদের শিক্ষার সুযোগ আজ হাতছাড়া। কিছু বেসরকারি বিশেষ স্কুল যদিও এই শিশুদের জন্য লড়াই জারি রেখেছে। তবে এমন শিশুদের সংখ্যা সাধারণ শিশুদের তুলনায় কম এবং জোটবদ্ধ হওয়ার মতো উপযুক্ত ছাতার অভাব থাকায়, তাদের বাবা-মায়ের যতই আওয়াজ তুলুন না কেন, তা একটি নির্দিষ্ট গণ্ডীর মধ্যেই আটকে যাচ্ছে। লড়াই চালাচ্ছেন এই শিশুদের নিয়ে কাজ করা শিক্ষক-শিক্ষিকা, শিক্ষাকর্মীরাও। তাঁরাও উপযুক্ত ডিগ্রিপ্রাপ্ত। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন এই সব শিশুদের সমাজের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনার স্বপ্ন দেখেছেন এঁরা। সরকার পোষিত বিশেষ স্কুল স্থাপন বন্ধ হওয়ায় তাঁদের জীবনও প্রতিবন্ধকতাপূর্ণ।

রাজ্য সরকার বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে যে ভাবে ছাত্রছাত্রীদের পাশে দাঁড়িয়েছে, অতি নিন্দুকও তার প্রশংসা না করে পারছেন না। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুরা এই সব সরকারি স্কুলের অন্তর্ভুক্ত হলে সুবিধাগুলি পাচ্ছে। কিন্তু শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতার অভাব, সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার অভাব ও সর্বোপরি সাধারণ শিশুর জন্য তৈরি পাঠ্যক্রমের সঙ্গে এই সব শিশুরা সখ্য গড়ে তুলতে পারছে না। দিশেহারা হয়ে তারা স্কুল ছাড়ছে। কোনও কোনও স্কুলের দয়া-দাক্ষিণ্যে তাদের নামটুকু স্কুলের খাতায় জ্বলজ্বল করে। কিন্তু যে উদ্দেশ্যে শিশুকে শিক্ষাঙ্গনে নিয়ে আসা, তা পূরণ হয় না।

এ তো গেল শিশুটির অসহায়তার কথা। এক বার ভাবুন তার বাবা-মায়ের কথা। যাঁরা মৃত্যুর সময়েও এক অব্যক্ত যন্ত্রণায় সন্তানকে ছেড়ে যেতে বাধ্য হন এই অবিবেচক সমাজে যেখানে তাঁদের সন্তানের শিক্ষা নেই, সুরক্ষা নেই, পূর্ণ যোগদান নেই, নেই সমান অধিকার।

তবে যে ‘পিডব্লিউ়ডি অ্যাক্ট, ১৯৯৫’-তে ঘোষণা করা হল— প্রতিটি বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু সমান সুযোগ, সমানাধিকার ও পূর্ণ যোগদানের মর্যাদা পাবে! ২১ বছর পরে তা পরিমার্জনা করে ‘রাইটস অব পারসনস্ উইথ ডিজ়েবিলিটিজ় বিল, ২০১৬’ পাশ হল। ২১ ধরনের প্রতিবন্ধকতাকে স্বীকৃতি দেওয়া হল। চাকরির ক্ষেত্রে সংরক্ষণ তিন থেকে চার শতাংশ হল। কিন্তু যে শিশুরা শিক্ষা থেকেই বঞ্চিত, তাদের আবার চাকরি! যত দিন না নীতি প্রণয়নকারীরা মাঠে নেমে বাস্তব সমস্যা বুঝতে পারবেন, তত দিন এই সব নীতি হাততালি দেওয়া নীতিতেই উল্লসিত হবে।

রাজ্য সরকারের ‘মানবিক প্রকল্পে’ আজ প্রতিবন্ধী মানুষেরা মাসিক ভাতা পাচ্ছেন। কিন্তু ২০১০ সালের ওই আইনের কারণে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু-কিশোরেরা শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। ওই আইন পরিবর্তন করে বিশেষ স্কুলগুলি আবার সরকারি পোষণ লাভ করবে ও নতুন এমন স্কুল তৈরির মাধ্যমে এই সব শিশুরা আরও বেশি করে শিক্ষার আলোকে আলোকিত হবে, এটাই আশা।

লেখক বাঁকুড়ার সমাজকর্মী

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Education Rights Specially Able Children
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE