এ বঙ্গে বিস্ময়ের শেষ নাই। সম্প্রতি ব্যারাকপুরে একটি পাড়ার ক্লাবের নির্বাচনে র্যাফ নামাইতে হইল। সাদা পোশাকের পুলিশ, বেসরকারি নিরাপত্তা রক্ষী, কিছুই বাদ যায় নাই। সেই দিনই কলকাতার একটি ক্লাবের কর্তাদের নিকট শাসক দলকে জিতাইবার আর্জি করিলেন সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। ক্লাবগুলিতে রাজনীতির অনুপ্রবেশ কোথায় পৌঁছাইয়াছে, এই দুই ঘটনা তাহা চোখে আঙুল দিয়া দেখাইয়া দিল। অতঃপর প্রশ্ন, এগুলি যদি রাজনীতির আখড়া হইবে, তাহা হইলে ক্লাব কোথায়? আর এগুলি যদি ক্লাব হইবে, তাহা হইলে দলীয় রাজনীতি ঠাঁই পাইবে কেন? কাহারও কাহারও হয়তো মনে হইবে, এই প্রশ্ন তোলাই বাতুলতা। এ বঙ্গে রাজনীতিশূন্য কোন স্থানই বা রহিয়াছে? ক্লাবগুলি বাম আমলেই রাজনৈতিক দলের স্থানীয় মুখপাত্র হইয়া উঠিয়াছিল। স্থানীয় বাসিন্দা অপেক্ষা নেতা ও দুষ্কৃতীদের দাপট বাড়িয়াছিল। তৃণমূল সেই প্রক্রিয়াকে আগাইয়া লইয়া গিয়াছে, এইমাত্র। আক্ষেপ করিয়া হইবে কী?
কথাটি ভুল নহে। কিন্তু আগাম ইঙ্গিত পাইবার অর্থ এই নয় যে, বিপদ আসিলে মুখ ঘুরাইয়া থাকা যায়। যে বিপদ আকস্মিক নহে, তাহার অভিঘাত কম হইতে পারে, কিন্তু তাহা কম বিধ্বংসী নহে। ক্লাবের ন্যায় সামাজিক সংগঠনকে দলীয় রাজনীতি গ্রাস করিলে তাহা সামান্য ক্ষতি নহে, গণতন্ত্রের পক্ষে মারাত্মক। রাজনৈতিক বিরোধিতা ও জনসমর্থনের জন্য লড়াই গণতন্ত্রে যত প্রয়োজনীয়, ততটাই জরুরি অরাজনৈতিক মঞ্চে নাগরিকদের যোগদান। নির্বাচনে নানা স্বার্থের সংঘাতের পাশাপাশি, সমাজে বিভিন্ন গোষ্ঠীর উদ্যোগের সহাবস্থান ব্যতীত গণতান্ত্রিক সমাজ গড়িয়া তোলা দুষ্কর। বস্তুত ক্লাবের ন্যায় সংগঠনের একটি প্রধান কাজ, দলমতনির্বিশেষে এলাকার বাসিন্দাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক চাহিদাগুলি তুলিয়া ধরা। পারস্পরিক বোঝাপড়ায় স্থানীয় সমস্যা সমাধানের চেষ্টা। খেলাধূলা, সংস্কৃতি বা ধর্মীয় নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নিজেদের প্রকাশ করিবার প্রযত্ন। ইহার মধ্যে প্রাণের যে স্বাভাবিক স্ফূর্তি, পরস্পরের প্রতি যে আস্থা, মিলিত কাজের যে আনন্দ, তাহা সমাজ তথা রাষ্ট্রের ভিতকে শক্ত করে। সমাজতাত্ত্বিকদের একাংশের মতে, এই আস্থা বস্তুত ‘সামাজিক পুঁজি’, যাহা সহযোগিতা বৃদ্ধির পথে সার্বিক সমৃদ্ধি বাড়াইয়া থাকে। ইহা উন্নয়নের একটি শর্ত, এমনও দাবি করা হইয়াছে।
কিছু বাড়তি ভোটের জন্য ক্লাবের ন্যায় অরাজনৈতিক, সামাজিক সংগঠনগুলিকে গ্রাস করিয়া রাজনৈতিক দলগুলি কার্যত গণতন্ত্রের সেই শক্তিকে দুর্বল করিতেছে। শাসক দল ক্লাবগুলিকে অকাতরে অর্থ বিতরণ করিয়াছে। রাজকোষের সেই অর্থের কোনও হিসাবও কখনও দাবি করে নাই। আসল হিসাব যে অন্যত্র, ভোটের পূর্বে সাংসদের কথায় তাহা স্পষ্ট হইয়া গেল। টাকা দিয়াছি, ভোট জোগাড় করিয়া দাও, এই দেনাপাওনার ছকে পড়িয়া পাড়ার ক্লাবগুলি তাহাদের স্বাতন্ত্র্য ও মর্যাদা হারাইল, রাজনৈতিক দলের শাখা অফিসে পরিণত হইল। ক্লাবকে কাজে লাগাইয়া এলাকার নানাবিধ সম্পদের উপর দখলদারি করিতেছেন নানা মাপের নেতা। তাহার ভাগ লইয়া নেতাদের পরস্পর সংঘাত প্রবেশ করিয়াছে ক্লাবেও। তাই পাড়ার ক্লাবের ভোটে পুলিশ নামাইতে হইতেছে। সংবাদে প্রকাশ, ব্যারাকপুরের ওই ক্লাবে ভোটার কার্ড দেখাইয়া ক্লাব-সদস্যরা ভোট দিয়াছেন। ইহাতে ওই ব্যক্তিদের পরিচয় সম্পর্কে হয়তো নিশ্চিত হওয়া গেল। কিন্তু হারাইয়া গেল ক্লাবের পরিচিতি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy