—প্রতীকী ছবি।
বাঘের পৃষ্ঠে চড়িলে নাকি নামিবার উপায় থাকে না। আদিত্যনাথরা টের পাইতেছেন, গরু বাঘেরও মা। গরুই এখন উত্তরপ্রদেশের বৃহত্তম সমস্যা। সংখ্যালঘুদের জন্য তো বটেই— তাঁহারা গরু হত্যা করিলে, এমনকী না করিলেও প্রাণ খোয়াইবার জন্য প্রস্তুত থাকেন বলিয়া শোনা যায়। গোহত্যার ঘটনায় তদন্ত হয়, বেশ কয়েক জন সংখ্যালঘু গ্রেফতার হন। সুবোধকুমার সিংহদের মৃত্যু ‘দুর্ঘটনা’র অধিক কিছু বলিয়া পরিগণিত হয় না। কিন্তু, উত্তরপ্রদেশে গরুর সমস্যায় শুধু সংখ্যালঘু বা শাসকদের পক্ষে বিপজ্জনক মামলার তদন্তকারী অফিসাররাই বিপন্ন নহেন। হিন্দুরাও ঘোর বিপাকে। গরু দুধ দেওয়া বন্ধ করিলে পূর্বে তাহাকে বেচিয়া দেওয়া যাইত। সেই গরুর ঠাঁই হইত কসাইখানায়। অধুনা সন্তানরা গোমাতা-হত্যা বন্ধ করিয়া দেওয়ায় দুগ্ধহীন গাভিও অবধ্য। কিন্তু, শুধু জয়ধ্বনিতে বাঁচিয়া থাকা মুশকিল। গরুর পক্ষেও। তাহাকে থাকিবার জায়গা দিতে হয়, খাদ্য দিতে হয়। কোনওটিই নিখরচায় হয় না। যে গরু দুধ দেয় না, তাহার জন্য আমৃত্যু এই খরচ বহন করিয়া চলা অধিকাংশ মালিকের পক্ষেই দু্ষ্কর। ফলে, অনাথ গরুর সংখ্যা দিনে দ্বিগুণ রাত্রিতে চতুর্গুণ বাড়িতেছে। মথুরার এক গ্রামের স্কুলে দেড়শত গরুকে আটকাইয়া রাখিয়াছিলেন দায়িত্ব পালনে অপারগ স্থানীয় চাষিরা। অনাহারে তাহার বেশ কয়েকটি মারা গিয়াছে। আলিগড়ে এক অসরকারি সংস্থার গোশালাতেও অনাথ গরুরা মরিতেছে। বস্তুত, গোটা উত্তরপ্রদেশের গ্রামাঞ্চলে ঠাঁইহারা, অভুক্ত গরুর সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। তাহাতে চাষিরও ক্ষতি— পূর্বে গরু বেচিয়া কিছু টাকা মিলিত, এখন গরুর অযত্ন করিয়া ধরা পড়িলে প্রহৃত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। গরুগুলিরও যে খুব লাভ হইতেছে, বলা মুশকিল— কসাইয়ের ছুরিতে মারা পড়িতে বেশি কষ্ট, না কি অনাহারে মৃত্যুর যন্ত্রণা বেশি, আদিত্যনাথরা ভাবিয়া দেখেন নাই।
ভাবেন নাই আরও অনেক কথাই। যেমন, ২০১৭ সালের মাঝামাঝি সময়েই জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিবিদ বিকাশ রাওয়াল হিসাব কষিয়া জানাইয়াছিলেন, গোহত্যা বন্ধ করিলে গরুর সংখ্যা যে পরিমাণে বাড়িবে, তাহার দেখভাল করিবার জন্য প্রতি বৎসর সাড়ে পাঁচ লক্ষ কোটি টাকা খরচ হইবে। কেন্দ্রীয় সরকারের সহিত সকল রাজ্যের সরকারের পশুকল্যাণ মন্ত্রকের মোট বাজেট যোগ করিলে যত টাকা হয়, তাহারও বহু গুণ খরচ। গরিব চাষি স্বভাবতই এই টাকার ব্যবস্থা করিতে পারিবেন না। সরকারের পক্ষেও এই বিপুল অঙ্কের জোগান দেওয়া এক প্রকার অসম্ভব। অর্থাৎ, গরু জবাই বন্ধ করিলে তাহাকে অনাহারে মরিতে দেওয়াই একমাত্র পথ। তাহাতে শুধু চাষির ক্ষতি নহে। গোমাংস রফতানিতে ভারত বিশ্বে অগ্রগণ্য ছিল। সেই ব্যবসার ক্ষতি মানিতে হইতেছে। চর্মজাত পণ্যের ব্যবসাও ক্ষতিগ্রস্ত। সমস্যাটি আদিত্যনাথরাও বুঝিতেছেন। কিন্তু, গরুর পৃষ্ঠে চড়িবার ইহাই বিপদ। এখন যদি তাঁহারা গোহত্যার উপর সরকারি ও বাহুবলী নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করিয়া লন, বিরোধীরা ছাঁকিয়া ধরিবেন। মাতার প্রতি সন্তানের এই বিশ্বাসঘাতকতার জন্য কতখানি রাজনৈতিক মূল্য চুকাইতে হইবে, আদিত্যনাথরা নিশ্চয় হিসাব কষিয়া লইয়াছেন। মন্দিরও হইল না, গোমাতাও গেল— লোকসভা ভোটের মুখে এমন দুই কুল খোয়াইবার ইচ্ছা তাঁহাদের নিশ্চিত ভাবেই নাই। বস্তুত, সমস্যা শুধু বিজেপিরই নহে। রাহুল গাঁধীর মতো নেতারা যে ভাবে উপবীত দেখাইতেছেন, মন্দিরে মন্দিরে ঘুরিতেছেন, তাহাতে স্পষ্ট, বিজেপি থাকুক আর না-ই থাকুক, হিন্দুত্ববাদ সহজে যাইতেছে না। সেই অবস্থায় কংগ্রেস বা অন্য কোনও দলও কি গোহত্যার নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করিবার দুঃসাহস দেখাইবে? অতএব, গরুর জন্য দুঃসংবাদ— আদিত্যনাথ যদি না-ও থাকেন, তাহাদের জন্য অচ্ছে দিন আসিতেছে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy