Advertisement
১১ মে ২০২৪

স্বাধীনতা সংগ্রামে উজ্জ্বল কালনা

শিষ্যার আগ্রহে কালনার সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি হয় উপেন্দ্রনাথ বা নিত্য গৌরবানন্দের। বদলে যায় তাঁর জীবন। বদলায় কালনার রাজনৈতিক আন্দোলনের রূপরেখাও। তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে কালনায় এসেছিলেন স্বয়ং সুভাষচন্দ্র বসু। লিখছেন সোমনাথ ভট্টাচার্য শিষ্যার আগ্রহে কালনার সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি হয় উপেন্দ্রনাথ বা নিত্য গৌরবানন্দের। বদলে যায় তাঁর জীবন। বদলায় কালনার রাজনৈতিক আন্দোলনের রূপরেখাও। তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে কালনায় এসেছিলেন স্বয়ং সুভাষচন্দ্র বসু। লিখছেন সোমনাথ ভট্টাচার্য

কালনার জ্ঞানানন্দ ব্রহ্মচর্য আশ্রম। ছবি: জাভেদ আরফিন মণ্ডল

কালনার জ্ঞানানন্দ ব্রহ্মচর্য আশ্রম। ছবি: জাভেদ আরফিন মণ্ডল

শেষ আপডেট: ২২ জানুয়ারি ২০১৯ ০৩:০৭
Share: Save:

কালনা কি শুধুই মন্দির, মসজিদ আর স্থাপত্যের শহর? এটা ঠিক যে, কালনার মন্দির, মসজিদ বা পুরনো স্থাপত্য নিয়ে যতটা চর্চা হয়েছে, এখানকার রাজনীতি, সমাজ, অর্থনীতি নিয়ে ততটা চর্চা হয়নি। অথচ, ভারতের জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা, ব্রাহ্মসমাজের মতো নানা সামাজিক ঘটনার ঢেউ স্পর্শ করেছিল ভাগীরথীর তীরের এই প্রাচীন জনপদটিকেও। এই কালনার বুকে ছড়িয়ে থাকা ভগবান দাস বাবাজির আশ্রম, ভবা পাগলার আশ্রম, নিগমানন্দের আশ্রমের মতো কেন্দ্র, এক দিকে, যেমন ধর্ম নিয়ে চর্চায় প্রভাব ফেলেছিল, তেমনই, জ্ঞানানন্দ মঠের মতো প্রতিষ্ঠানের হাত ধরে স্বাধীনতা আন্দোলনও কালনাকে স্পর্শ করেছিল। এই আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে কালনার স্বাধীনতা সংগ্রামী নিত্য গৌরবানন্দ অবধূতের নাম। শোনা যায়, তাঁর কারণেই কালনায় এসেছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু।

জানা যায়, স্বামী নিত্য গৌরবানন্দ অবধূতের পিতৃদত্ত নাম ছিল উপেন্দ্রনাথ পাল। ১৮৮৯ সালে বাংলাদেশের বরিশালের কুশাঙ্গুল গ্রামে তাঁর জন্ম। ছেলেবেলা থেকেই সমকালীন রাজনীতির প্রতি আগ্রহ ছিল তাঁর। উপেন্দ্রনাথের রাজনৈতিক গুরু ছিলেন তাঁর শিক্ষক জগদীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। বরিশালে স্কুলের পাঠ শেষ করে, তিনি ভর্তি হন কলকাতার একটি কলেজে। কলকাতা আসার সঙ্গে সঙ্গেই সমকালীন রাজনীতি তাঁর উপরে গভীর ভাবে প্রভাব বিস্তার করে। কলকাতায় থাকার সময়ে, তিনি বেশ কিছু রাজনৈতিক সভায় যোগ দিয়েছিলেন বলেও শোনা যায়। কলকাতায় থাকায় সময়ে উপেন্দ্রনাথের সঙ্গে বিপ্লবী চিন্তাহরণ মুখোপাধ্যায়, বরিশালের বিপ্লবী সংগঠনের সদস্য শরৎ পালের ঘনিষ্ঠ যোগ ছিল। তাঁদের হাত ধরেই তিনি এক দিন গিয়েছিলেন হুগলির চক বাজারে অবস্থিত নিত্যানন্দ মঠে।

কিন্তু যে উপেন্দ্রনাথ মঠে গিয়েছিলেন, আর যে উপেন্দ্রনাথ সেখান থেকে ফিরলেন— তাঁরা দু’জন এক মানুষ ছিলেন না। কারণ, স্বামী নিত্যগোপাল মহারাজ। তাঁর সান্নিধ্যে এসে সন্ন্যাস গ্রহণ করে উপেন্দ্রনাথ হয়ে উঠলেন স্বামী নিত্যানন্দ অবধূত। এই সময় থেকে তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামের থেকে ধর্মীয় আন্দোলনের সঙ্গে বেশি জড়িয়ে পড়েছিলেন। তবে শুধু উপেন্দ্রনাথ একা নন, সেই সময়ে নিত্যগোপাল দেবের কাছে নরেশচন্দ্র চক্রবর্তী, নিমাই রায়ের মতো বিপ্লবীরাও দীক্ষা নিয়েছিলেন। সন্ন্যাস গ্রহণের পরে কলকাতার মহানির্বাণ মঠে এসে ওঠেন উপেন্দ্রনাথ। সেখানেই চলতে থাকে তাঁর ধর্ম নিয়ে লেখালেখি।

নিত্য গৌরবানন্দ অবধূত।

কিন্তু এর পরে, নিত্য গৌরবানন্দের সঙ্গে কালনার যোগাযোগ স্থাপিত। এবং সেই যোগাযোগের হাত ধরে বদলে যায় তাঁর জীবন। বদলায় কালনার রাজনৈতিক আন্দোলনের রূপরেখাও। কালনার হরিপদ মোদকের স্ত্রী সুশীলাদেবী ছিলেন নিত্য গৌরবানন্দের অন্যতম প্রিয় শিষ্যা। তাঁর অনুরোধে, এক দিন কালনায় আসেন নিত্য গৌরবানন্দ। কালনা হাসপাতালের কাছে নির্জন জায়গাটি তাঁর পছন্দ হয়। জায়গাটির মালিক ছিলেন সুশীলাদেবীই। গুরুকে আশ্রম প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি জায়গাটি দান করেন। ১৯২৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘জ্ঞানানন্দ ব্রহ্মচর্য আশ্রম’।

কালনায় নিত্য গৌরবানন্দ আসার সঙ্গে সঙ্গেই বিপ্লবী আন্দোলন নতুন করে গতি পায়। সন্ন্যাস নেওয়ার পরে স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে কিছু দিন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লেও নিত্য গৌরবানন্দ ১৯২৩ সালের পরে ফের সেই আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। কারণ, তত দিনে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে বড়সড় পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে। স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রধান মুখ হয়ে উঠেছেন মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী। উঠে এসেছেন সুভাষচন্দ্র বসু-সহ একাধিক তরুণ নেতা। কলকাতায় থাকার সময়েই সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল নিত্য গৌরবানন্দের। পরে সে আলাপ গড়ায় সখ্যতায়। তবে প্রথম দিকে কংগ্রেস নয়, এই আশ্রম সশস্ত্র বিপ্লবীদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিল। এই আশ্রম হয়ে উঠেছিল বিপ্লবীদের গুপ্ত আস্তানা। এই আশ্রম হয়ে ওঠে রাজু সান্যাল, বিক্রম সেন, উৎপল মণ্ডল, সূর্যনারায়ণ পালের মতো বিপ্লবীদের আত্মগোপনের অন্যতম কেন্দ্র।

বিপ্লবীদের সমর্থন করলেও, নিত্য গৌরবানন্দ ছিলেন একনিষ্ঠ কংগ্রেস কর্মী। কালনা কংগ্রেসের সক্রিয় কর্মী হিসেবে তিনি সেই সময় জনপ্রিয় ছিলেন। কংগ্রেসে যোগ দেওয়ার কিছু দিনের মধ্যেই তিনি কালনা কংগ্রেসের সভাপতি নিযুক্ত হন। কিন্তু কংগ্রেস করলেও তাঁর আশ্রম যে দিনে দিনে বিপ্লবীদের গোপন আস্তানা হয়ে উঠছে তা বুঝতে বাকি ছিল না ব্রিটিশ শাসকের। তাই সরকার বিরোধী কাজের জন্য ইংরেজ পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে। তবে জেলায় না রেখে, তাঁকে দমদম জেলে স্থানান্তরিত করা হয়।

তবে তাঁর কারাবাস সম্পর্কে কোনও নির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না। তিনি কত দিন জেলে বন্দি ছিলেন, সে কথা আজ আর জানার কোনও উপায় নেই। কারণ, গবেষকদের হাতে প্রয়োজনীয় নথি নেই। তবে কালনার ইতিহাসে স্বামী নিত্য গৌরবানন্দ স্মরণীয় হয়ে আছেন সুভাষচন্দ্র বসুকে এই আশ্রমে নিয়ে আসার জন্য। সুভাষচন্দ্র তখন কংগ্রেসের জনপ্রিয় নেতা। তিনি ১৯৩৩-’৩৪ সাল নাগাদ এই আশ্রমে এসেছিলেন বলে দাবি করেন আশ্রম কর্তৃপক্ষ। সেখানে একটি ঘরে দু’রাত ছিলেন সুভাষ। তবে দু’জনের মধ্যে কি বিষয়ে কথা হয়েছিল, তা আজও গবেষকদের কাছে অজানাই থেকে গিয়েছে। এ বিষয় তিনি নিত্য গৌরবানন্দ বা তাঁর শিষ্য বা ভক্তদের কাছ থেকে কোনও তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে এই আশ্রমে আজও সুভাষচন্দ্রের ব্যবহার করা চেয়ার এবং যে ঘরে তিনি ছিলেন তা সংরক্ষণ করা রয়েছে। ১৯৪২ সালে নিত্য গৌরবানন্দ এই আশ্রমেই দেহত্যাগ করেন।

সময়ের সঙ্গে বদলে গিয়েছে আশ্রমের পরিবেশও। সে দিনের সেই আশ্রমটি আজ কোনওক্রমে নিজের অস্তিত্ব বজায় রেখাছে। অযত্নে পড়ে রয়েছে সুভাষচন্দ্রের ব্যবহার করা জিনিসপত্র। কালনার স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ এই আশ্রমটিকে রক্ষা করতে এ বার বোধহয় সত্যি ভাবার সময় এসেছে।

কালনার ইতিহাস গবেষক ও সংস্কৃতি কর্মী

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE