ভারতের সর্বোচ্চ আদালতের উপর বিরাট পরিমাণ চাপ থাকা সত্ত্বেও যে বহু ধরনের বিষয়ে গভীর, প্রায় বৈপ্লবিক, পরিবর্তনের ভাবনা মাননীয় বিচারপতিরা করিতে পারেন, ইহা এক বিরাট কৃতিত্বের কথা। সম্প্রতি এমনই একটি উল্লেখযোগ্য কৃতিত্বের বিষয়, জনস্থানে প্রকাশ্য ধর্মাচরণ বিষয়ে নূতন করিয়া ভাবিবার জন্য সুপ্রিম কোর্টের প্রণোদনা। দিল্লির জ্যোতি জাগরণ মঞ্চের মামলা বিচার করিতে বসিয়া বিচারকদের বেঞ্চ এ বিষয়ে কনস্টিটিউশন বেঞ্চের পরামর্শ আহ্বান করিয়াছে। ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইবুনাল বা এনজিটি-র বিরুদ্ধে জাগরণ মঞ্চের মামলাটির মূল প্রশ্ন অতিপরিচিত হইলেও অতীব গুরুতর। রাজধানীর একটি পার্কে মাতা দুর্গার আরাধনা উপলক্ষে ‘জাগরণ’ উৎসব ঘটিতে পারে কি না, এনজিটি সে বিষয়ে জাগরণ মঞ্চের বিরুদ্ধে আপত্তি তুলিয়াছিল। বিচারকরা এই আপত্তি লইয়া ভাবিতে গিয়া সঙ্গত ভাবেই একটি ধাঁধার মধ্যে পড়িয়াছেন। সাধারণ বোধ বলে, একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশে ধর্মাচরণ কোনও ভাবে প্রকাশ্য জনস্থানের বিষয় হইতে পারে না। কিন্তু ভারতীয় সংবিধান যে ভাবে ধর্মনিরপেক্ষতাকে ব্যাখ্যা করিয়াছে, তাহাতে সব ধর্মকে সমান গুরুত্ব দিবার কথা বলিতে গিয়া বস্তুত এমন ধর্মাচরণকে স্বীকৃতি দেওয়া হইয়াছে। ফলত ‘পাবলিক স্ফিয়ার’ বিবিধ রকমের ধর্মীয় উৎসব-অনুষ্ঠান-আচারে প্লাবিত হইয়া গিয়াছে। ধর্মাচরণের এই অতিরিক্ত প্রকাশ্যতায় দেশের ধর্মনিরপেক্ষতার পরিচিতিটিই মাঝখান হইতে ডুবিতে বসিয়াছে। এই সঙ্কটের সুরাহার জন্যই সংবিধান-বেঞ্চের দ্বারস্থ হইলেন মাননীয় বিচারপতিগণ।
এ দেশের সংবিধানে যে কয়েকটি বিষয়ে বিশেষ দ্বিধা ও সংশয়ের অবকাশ থাকিয়া গিয়াছে, তাহার মধ্যে সম্ভবত প্রধান স্থানটি লইবে, ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি। যে ঐতিহাসিক পরিস্থিতিতে ভারত স্বাধীন হইয়া নূতন সার্বভৌম দেশ হিসাবে যাত্রা শুরু করিয়াছিল, তাহার মধ্যেই এই দ্বিধাময়তার সূত্রটি লুক্কায়িত। ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলিতে গিয়া ধর্ম বস্তুটিকে পিছনে রাখিবার দুঃসাহস জাতির নির্মাতারা দেখাইতে পারেন নাই। কিন্তু একই সঙ্গে ভাবিতে হইবে, ভারতে ‘পাবলিক স্ফিয়ার’ বা জনস্থান বস্তুটির ক্রমবিকাশের ইতিহাস বিষয়ে। ঔপনিবেশিক সমাজে জনস্থান কোনও কালেই ইউরোপ বা পশ্চিম বিশ্বের মতো একটি ধর্ম-বিযুক্ত স্থান হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে নাই। সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা ও জাতীয়তাবাদের আবাহন করিতে গিয়া বারংবার উপনিবেশকে নিজ ঐতিহ্য, এবং সেই সূত্রে নিজ ধর্মীয় ঐতিহ্যকে প্রকাশ্যে টানিয়া আনিতে হইয়াছে। এখন, পার্কে যদি অতীতে গণপতি উৎসব কিংবা খিলাফত মিছিল ঘটিতে পারে, তাহা হইলে বর্তমানে দুর্গার জাগরণ উৎসবই বা কেন ঘটিবে না, প্রশ্ন তুলিতে পারেন ঐতিহ্যবাদীরা।
অবশ্যই প্রশ্ন তুলিতে গিয়া ঐতিহ্যবাদীরা মাথায় রাখিবেন না যে, পরাধীন ও স্বাধীন দেশের সমাজ-চর্চার মধ্যে ক্রমে কিছু পরিবর্তনও ঘটা উচিত। ঘটা জরুরি। স্বাধীন দেশ বিবিধ ধর্মকে সমান অধিকার দিবার কথা ভাবিলেই যে প্রকাশ্য জনস্থানে বিবিধ ধর্মের আচার পালন করিতে দিতে বাধ্য হইতে হইবে, এমন কথা বলা চলে কি? সরকারের অধীন ভূসম্পত্তির উপর তো সকল নাগরিকের সমান অধিকার থাকিবার কথা। একটি পার্কের সর্বত্র সেই অঞ্চলের বাসিন্দাদের অধিকার থাকিবার কথা। ধর্মের ভিত্তিতে সেই অধিকার কমানো-বাড়ানো কি সঙ্গত কাজ? ধর্মকে স্থান দিতে গিয়া কি পরোক্ষে সরকার, তথা রাষ্ট্রের, ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রটিই তাতে কলুষিত হয় না? এই প্রশ্ন কেবল গুরুত্বপূর্ণ নহে, সাম্প্রতিক সংখ্যাগুরুবাদের দ্রুতবৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে অতি সংবেদনশীলও বটে। আদালতের চূড়ান্ত বিবেচনা কী দাঁড়ায়, দেখিতে উৎসুক বর্তমান নাগরিক সমাজ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy