Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

স্বচ্ছতা ও স্বরাজ

একবিংশের ভারতে উচ্চবর্ণ, উচ্চশ্রেণির সমান মর্যাদা লাভ দূরে থাকুক, মানুষের মতো বাঁচিবার সুযোগটুকুও সাফাইকর্মীরা পান নাই। চলতি বৎসরেই সেপ্টেম্বর মাসে রাজধানী দিল্লিতে ছয় সাফাইকর্মীর মৃত্যু হইয়াছে।

শেষ আপডেট: ১৭ অক্টোবর ২০১৮ ০১:১১
Share: Save:

স্বরাজ বলিতে কী বোঝায়? এক সাংবাদিকের এই প্রশ্নের উত্তরে মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী বলিয়াছিলেন, স্বরাজ আসিলে ভারতে মেথরের সহিত মহারাজার, অথবা ব্রাহ্মণের, পার্থক্য থাকিবে না। তাহার পর আট দশক অতিক্রান্ত হইয়াছে, তাঁহার জন্মদিবস ‘স্বচ্ছ ভারত’ দিবস ঘোষণা করিয়াছে সরকার। কিন্তু গাঁধীজির স্বপ্নের স্বরাজ আসে নাই। একবিংশের ভারতে উচ্চবর্ণ, উচ্চশ্রেণির সমান মর্যাদা লাভ দূরে থাকুক, মানুষের মতো বাঁচিবার সুযোগটুকুও সাফাইকর্মীরা পান নাই। চলতি বৎসরেই সেপ্টেম্বর মাসে রাজধানী দিল্লিতে ছয় সাফাইকর্মীর মৃত্যু হইয়াছে। একটি ঘটনায় শৌচনিকাশির কূপে দম বন্ধ হইয়া এক সঙ্গে পাঁচ কর্মীর মৃত্যুর সংবাদ দেশবাসীকে অস্থির করিয়াছে। এমন দুর্ঘটনা ব্যতিক্রম নহে। কখনও শৌচের নালা, কখনও সেপটিক ট্যাঙ্ক পরিষ্কার করিতে নামিয়া দূষিত বাষ্পে শ্বাসরোধ বা অচেতন হইয়া সাফাইকর্মীদের মৃত্যুর ঘটনা নিয়মিত ঘটিতেছে। ভারতবাসী তাহার সহ-নাগরিকের প্রতি এত নিষ্করুণ কেন? কারণ জাতপাত ঘিরিয়া অমানবিক কুসংস্কার। তাহা বুঝিয়াছিলেন বলিয়াই গাঁধী বিড়লার ভবন ছাড়িয়া ভাঙ্গি কলোনিতে বাস করিতেন। সেই দৃষ্টান্ত কি বৃথা হইল? নিম্নবর্ণের মানুষকে বিষ্ঠাবাহী করিয়া রাখা হইবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম, স্বচ্ছ সমাজের এই কি রূপ?

সরকার শৌচাগারের চমকপ্রদ সংখ্যা দিয়া স্বচ্ছতা প্রমাণ করিতে চাহে। কোটি কোটি টাকা দিয়া লক্ষ লক্ষ শৌচাগার গড়িবার দাবি ম্লান হইয়া যায় একটি প্রশ্নে, সেগুলি সাফ করিতেছে কে? ১৯৯৩ সালে মানুষের দ্বারা বিষ্ঠা উত্তোলন নিষিদ্ধ হইয়াছে, দুই দশক পর ফের সেই আইনকে বলবৎ করিয়া বিষ্ঠাবাহকদের পুনর্বাসনের নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে। তাহাতে কাজ হইয়াছে কতটুকু? পুরসভা এবং বিভিন্ন সরকারি দফতরই নিম্নবর্ণদের বিষ্ঠাবহনের কাজে নিযুক্ত করে। আইন এড়াইতে ঠিকাদারের অধীনে দিনমজুর হিসাবে, অথবা রেলের ‘ঝাড়ুদার’ বলিয়া তাহাদের নিয়োগ হয়, কিন্তু কাজ হয় পূতিগন্ধময় আবর্জনা নিষ্কাশন। ভারতীয় রেল এখনও এক লক্ষ কিলোমিটার রেললাইন বিষ্ঠামুক্ত করিতে মানুষ নিয়োগ করিয়া থাকে। গ্যাসরোধী মুখোশ, দস্তানা বা জুতা, সুরক্ষার কোনও সরঞ্জামের ব্যবস্থা নাই। সাফাইকর্মীদের অপমৃত্যুকে ‘হত্যা’ বলিয়া দাবি করিয়াছে সাফাইকর্মী সংগঠন। এই ক্ষোভ অসঙ্গত নহে। নিরাপত্তায় অবহেলার জন্য কর্মীর মৃত্যু হইলে নিয়োগকর্তা দায় এড়াইতে পারেন কি? চাঁদে মানুষ পাঠাইবার অঙ্গীকার করিয়াছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। কিন্তু অন্ধকূপ হইতে কয়েক লক্ষ মানুষকে উদ্ধার করিবার যে অঙ্গীকার দেশ বহু পূর্বে করিয়াছে, তাহা রাখিতে পারেন নাই। ভারত মহাকাশযান গড়িতে পারে, শৌচনালা সাফ করিবার যন্ত্র গড়িতে পারে না। যে প্রযুক্তি সমাজের সর্বশেষ প্রান্তে থাকা মানুষের উন্নয়নে সহায় হইতে পারে না, তাহা গর্বের নহে, লজ্জার।

গাঁধীমূর্তিতে মাল্যদান সহজ। গাঁধীকথিত ‘স্বরাজ’ আনিয়া ভাঙ্গিকে মন্ত্রীর সমান মর্যাদা দিবার কাজটি কিঞ্চিৎ কঠিন। প্রধানমন্ত্রী নূতন প্রকল্প ঘোষণার আড়ম্বরটি পছন্দ করেন। ‘স্বচ্ছ ভারত’ ঘোষণার চার বৎসর পরে তিনি ‘স্বচ্ছতাই সেবা’ প্রকল্প ঘোষণা করিলেন গত ১৫ সেপ্টেম্বর। তাঁহার ভাবনায় ত্রুটি নাই। বাস্তবিকই নিকাশি ও শৌচনালা যাঁহারা সাফ করিতেছেন, তাঁহারা দেশের সর্বোত্তম সেবক। তাঁহাদের জন্য জনস্বাস্থ্যের বহু সঙ্কট এড়াইয়া সুস্থ থাকেন দেশবাসী। প্রশ্ন রহিল, সেই সেবার সম্মান কি সরকার করিবে? সাফাইকর্মীর হাতে প্রযুক্তি তুলিয়া দিয়া, সম্মানজনক শর্তে নিয়োগ করিয়া, সামাজিক সুরক্ষা দিয়া তাঁহার মর্যাদা রক্ষার কাজটি সরকারকেই করিতে হইবে। সাফাইকর্মীর মর্যাদা স্বচ্ছতার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE