জল অনেকটাই গড়িয়েছে। চার বছর আগে এই দেশ প্রথম প্রযুক্তিকেন্দ্রিক নির্বাচন দেখেছিল। ২০১৯ সালে ফের হতে চলেছে সোশ্যাল মিডিয়া ভিত্তিক নির্বাচনী মহাযজ্ঞ।
নির্বাচনে প্রযুক্তির বড় মাপের প্রথম প্রবেশ ২০০৮ সালে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বারাক ওবামা তাঁর প্রচারে অতিমাত্রায় প্রযুক্তির শরণাপন্ন হয়েছিলেন। লাগাতার প্রচার চালিয়েছিলেন ইউটিউব, এসএমএস, ইমেল-এ। অনলাইনে বিলি করেছিলেন নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি। বিশ্বজুড়ে ইউটিউবে তাঁর প্রচারের ভিডিয়ো দেখা হয়েছিল প্রায় এক কোটি ৪৫ লক্ষ ঘণ্টা। সেই নির্বাচনের হাত ধরে পৃথিবী জুড়ে সূচনা হয়েছিল প্রযুক্তিকেন্দ্রিক নির্বাচনের, যাকে বলে ‘টেকনোলেকশন’। বিপুল সংখ্যক নাগরিকের অনলাইন উপস্থিতির ফলে সেই বছর মার্কিন নির্বাচনের ফলাফলে সোশ্যাল মিডিয়া বেশ বড় নির্ণায়ক ভূমিকাও পালন করেছিল।
ভারতের নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় প্রযুক্তির অভিষেক ঘটল ২০১৪ সালে। ডিজিটাল ইলেকশনের মধ্যে দিয়ে ক্ষমতায় আসে নরেন্দ্র মোদীর সরকার। সেই বছর লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে বড় মাপের কৌশলগত পরিবর্তন চোখে পড়েছিল। ছিল সোশ্যাল মিডিয়া আর স্মার্টফোনের রমরমা ব্যবহার। এর সিংহভাগ ব্যবহারকারী যে যুবসমাজ, তারাই হয়ে উঠেছিল রাজনৈতিক দলগুলোর প্রচারের প্রধান লক্ষ্য। এই জন্যই ২০১৪-র নির্বাচনকে বলা হয় ‘ইন্ডিয়া’জ় ফার্স্ট সোশ্যাল মিডিয়া ইলেকশন’।
মুশকিল এই: ওয়েবপ্রযুক্তি যে কেবল ভোটদাতাদের সঙ্গে নির্বাচনের কারবারিদের যোগাযোগ করাতে পারে, তা নয়, চুপিসারে হাতিয়ে নেয় ভোটারদের যাবতীয় তথ্য, রটায় ভুয়ো খবর। এমনই হল ২০১৬-র মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে। বেসরকারি নির্বাচনী বিশ্লেষক সংস্থা কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রচারের দায়িত্বে ছিল। যে সব মার্কিন নাগরিক ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ, গুগল ব্যবহার করেন, সেখানে তাঁদের ফলাও করে জাহির করা পছন্দ, ক্ষোভ, মতামত, বঞ্চনাবোধের বিপুল পরিমাণ তথ্য হাতিয়ে এক এক জনের পছন্দ-অপছন্দ অনুসারে তৈরি করেছিল সাইকোমেট্রিক প্রোফাইল।
এর পর তথ্য বিশ্লেষণী প্রযুক্তি বিগ ডেটা কাজে লাগিয়ে সেই সব তথ্য বিশ্লেষণ করে তৈরি করেছিল প্রচারমূলক বিজ্ঞাপন। পাঠিয়ে দিত জনগণের সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টে। প্রভাবিত করেছিল ভোটদাতাদের প্রার্থী নির্বাচনে। হাসতে হাসতে জিতেছিলেন ট্রাম্প। জানা গিয়েছে, ওই নির্বাচনে জেতার জন্যে ট্রাম্পের রিপাবলিকান দল নির্বাচনী বাজেটের প্রায় ৫০ শতাংশ খরচ করেছিল ইন্টারনেটভিত্তিক সামাজিক মাধ্যমগুলোতে।
প্রচারের এই নয়া কৌশল প্রার্থীদেরকে রাস্তায় নেমে, গায়ে ধুলো মেখে, মানুষের দরজায় ঘোরা থেকে স্বস্তি দেবে, সন্দেহ নেই। সেই শ্রম ও সময় তাদের প্রচারবাহিনী ব্যয় করতে পারবে নির্বাচনী বিজ্ঞাপন তৈরিতে এবং জনগণের সোশ্যাল মিডিয়া ভরাতে। এই পদ্ধতিকে বলে ‘মাইক্রো টার্গেটিং’।
এখন প্রযুক্তি যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, অদূর ভবিষ্যতে দেখা যাবে রাজনৈতিক প্রার্থীদের (হবু প্রধানমন্ত্রীর বা মুখ্যমন্ত্রীর) ভার্চুয়াল অবতাররা আপনার স্মার্টফোনের স্ক্রিনে দপ করে ফুটে উঠে আপনার সঙ্গে একান্তে আলাপচারিতা সেরে, পছন্দ-অপছন্দ, সমস্যা জেনে, আপনার চাহিদা পূরণের স্বপ্ন দেখিয়ে কর্পূরের মতো উবে গেল।
স্বভাবতই এই সব প্রচারে মাইকের চড়া আওয়াজ নেই, সর্বজনীন বিষয়বস্তু নেই। শুধুমাত্র অন্দরমহলের নিভৃতিতে প্রার্থী ও ভোটদাতার মধ্যে চাওয়াপাওয়ার হিসেবনিকেশটুকু আছে। সমষ্টিকে বাদ দিয়ে ব্যক্তির যে রকম আর যতটুকু চাহিদা, প্রার্থীও তাঁকে ঠিক ততটুকুই আশান্বিত করবে।
স্বভাবতই, সোশ্যাল মিডিয়া-ভিত্তিক নির্বাচনী প্রচার নৈতিকতার প্রশ্ন উস্কে দিয়েছে। আর একটা মারাত্মক উদ্বেগজনক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে ইলেকশন হ্যাকিংয়ের সম্ভাবনা। ২০১৬-র মার্কিন নির্বাচনে নাকি রাশিয়া প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিলারি ক্লিনটনের ডেমোক্রেটিক ন্যাশনাল কমিটির তথ্যভাণ্ডার হ্যাক করে নির্বাচনী ফলাফলে নয়ছয় করে ট্রাম্পকে মসনদে বসিয়েছে বলে খবর রটেছে।
পৃথিবী জুড়ে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা যত বাড়বে, ততই এই ধরনের আঘাতে জর্জরিত হবে নির্বাচনী প্রক্রিয়া। সমীক্ষায় জানা গিয়েছে, ভারতে ২০১৯ সালে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৫২ কোটি ছাপিয়ে যাবে। সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীর সংখ্যা হবে ২৬ কোটি। স্মার্টফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে প্রায় ৪৮ শতাংশ। এই পরিস্থিতিতে এ দেশের নির্বাচন কমিশনেরও প্রয়োজন কড়া ডিজিটাল আচরণবিধি ও তথ্যপ্রচার সংক্রান্ত নিয়মনীতি প্রণয়ন করা। তথ্য সুরক্ষা, জাল খবর প্রচার, সাইবার হামলা, এগুলো এখন দেশের ভবিষ্যতের প্রশ্নের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে। ২০১৯ সালের জাতীয় নির্বাচন এই অর্থেও বিশেষ গুরুতর।