Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের একশো বছর
Jallianwala Bagh Massacre

স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের আয়োজন নিজেদের লজ্জাকেই স্থায়ী করার বন্দোবস্ত

জাতীয় কংগ্রেসের নেতারা কেন তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ আন্দোলনে অগ্রসর হননি, তার অবশ্য এক রাজনৈতিক কারণ ছিল। গাঁধীজি সেই মুহূর্তে পঞ্জাবে গেলে পঞ্জাব সঙ্কট আরও ভয়াবহ হয়ে উঠবে বলে মনে করেছিলেন।

অলংকরণ: তিয়াসা দাস।

অলংকরণ: তিয়াসা দাস।

অভ্র ঘোষ
শেষ আপডেট: ১৩ এপ্রিল ২০১৯ ০১:৪৯
Share: Save:

জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংস হত্যাকাণ্ডটি ঘটেছিল ১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল। ১৯২০ সালে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস হত্যালীলার বাগানে একখণ্ড জমি কিনে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ এই স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের বিষয়টি সমর্থন করতে পারেননি। শান্তিনিকেতন পত্রিকায় লিখেছিলেন, ‘...কোনও চিহ্নের দ্বারা পঞ্জাবের এই ঘটনা চিরস্মরণীয় করা আমাদের পক্ষে গৌরবের নহে। বীরত্বই স্মরণের বিষয়, কাপুরুষতা নৈব নৈব চ। নিরস্ত্র নিঃসহায়ের প্রতি অত্যাচার কাপুরুষতা, সেই অত্যাচার দীনভাবে বহন করাও কাপুরুষতা, কেন না কর্তব্যের গৌরবকে বুক পাতিয়া অস্ত্রগ্রহণ করায়, মাথা তুলিয়া দুঃখ স্বীকার করায় পরাভব নাই। যেখানে পীড়নকারী ও পীড়িত কোনও পক্ষেই বীর্য্যের কোনও লক্ষণ দেখা গেল না সেখানে কোন্ কথাটা সমারোহপূর্ব্বক স্মরণ করিয়া রাখিব? আমাদের রাজপুরুষেরা কানপুরে ও কলিকাতায় দুষ্কৃতির স্মৃতিচিহ্ন স্থাপন করিয়াছেন। আমরা কি তাঁহাদেরই অনুকরণ করিব? এই অনুকরণ চেষ্টাতেই কি আমাদের যথার্থ পরাভব নহে?’

ঠিক প্রশ্নই তুলেছিলেন কবি। সিপাহি বিদ্রোহের স্মারক-স্তম্ভ নির্মাণের যৌক্তিকতা আছে। তাতে বীর্যের ও ত্যাগের স্মৃতি আছে। কিন্তু জালিয়ানওয়ালাবাগে নিরীহ নিরস্ত্র মানুষের ওপর জেনারেল ডায়ারের গুলিবর্ষণ তো চরম এক কলঙ্কের ইতিহাস, আত্মরক্ষার্থের কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়নি সেখানে। এমনকি, কংগ্রেসের জাতীয় নেতারা ঘটনার অব্যবহিত পরেও কোনও প্রতিবাদ জানাতে সাহস করেননি, একমাত্র ব্যক্তিগত ভাবে রবীন্দ্রনাথের নাইটহুড প্রত্যর্পণ ছাড়া— স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের আয়োজন সে ক্ষেত্রে নিজেদের লজ্জাকেই স্থায়ী করার বন্দোবস্ত।

জাতীয় কংগ্রেসের নেতারা কেন তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ আন্দোলনে অগ্রসর হননি, তার অবশ্য এক রাজনৈতিক কারণ ছিল। গাঁধীজি সেই মুহূর্তে পঞ্জাবে গেলে পঞ্জাব সঙ্কট আরও ভয়াবহ হয়ে উঠবে বলে মনে করেছিলেন। অহিংস আন্দোলনের প্রতি বিশ্বস্ত গাঁধী ঝুঁকি নিতে চাননি। রবীন্দ্রনাথের অবশ্য ভিন্ন ব্যাখ্যা ছিল। ‘মংপুতে রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থে আছে— কবি বলছেন, ‘গান্ধীজিকে বললুম যে, এ ব্যাপার নিয়ে আপনি একা দেশব্যাপী আন্দোলন এখনই শুরু করুন। কিন্তু তিনি তখন রাজী হলেন না। তখন তাঁর বড়লাটের সঙ্গে কোনো একটা সুবিধের পরামর্শ চলছিল। সেটা নষ্ট করতে চাইলেন না, পরে অবশ্য এই ব্যাপারকেই প্রধান প্ল্যাটফর্ম করে অনেক বক্তৃতা দিয়েছিলেন। আমার কী যে আশ্চর্য লেগেছিল বলতে পারিনে।’

অলংকরণ: তিয়াসা দাস।

রবীন্দ্রনাথের এই ধারণা কতটা সত্য বলা মুশকিল। কারণ জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ড যে রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ঘটেছিল, তাতে ব্যক্তিগত ভাবে গাঁধীজি বা চিত্তরঞ্জন দাশদের ভয় পাওয়ার কোনও কারণ ছিল না। কারণ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ সরকার জাতীয় কংগ্রেসকে নানা ভাবে ঠকিয়েছিল। ভারতবর্ষ যুদ্ধের সময় অর্থ ও সৈন্য দিয়ে সরকারকে সাহায্য করেছিল এই শর্তে যে, যুদ্ধ শেষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে ভারতে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু যুদ্ধ বন্ধ হলে এবং মিত্রশক্তির বিজয়ের পর ইংরেজ শাসকেরা সে সব প্রতিশ্রুতির কথা ভুলে গেলেন। মন্টেগু-চেমসফোর্ড যে রিপোর্ট প্রকাশ করলেন, তাতে যে সব শাসন সংস্কারের কথা বলা হল জাতীয় কংগ্রেসের কাছে তা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ মনে হল না। উপরন্তু ভারতীয় উপনিবেশের প্রজারা ক্রমশ আন্দোলনমুখী হয়ে উঠছে এমন আঁচ করে, বিশেষত সরকারের শাসন সংস্কার বিষয়ে কংগ্রেসে তীব্র বিতর্ক শুরু হলে নেমে এল এক প্রচন্ড খাঁড়ার ঘা— কুখ্যাত রাওলাট অ্যাক্ট।

কিংস বেঞ্চের জজ স্যর সিডনি রাওলাটের সভাপতিত্বে যুদ্ধোত্তর ভারতীয় সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন দমনের নামে তৈরি হল ওই কালা কানুন। বলা হল, জুরি ব্যতিরেকে রুদ্ধদ্বার আদালতে বন্দির বিচার হবে। সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের জামানত আদায় করা হবে। বিনা বিচারে সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের আটক করে রাখা চলবে, ইত্যাদি ইত্যাদি। পঞ্জাবে এই আইনের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিয়ে বলা হল, ‘না উকিল, না আপিল, না দলিল’। এই শয়তানি আইনের বিরুদ্ধে গাঁধী, মালব্য, চিত্তরঞ্জন, সাপ্রু-সহ কংগ্রেসি জননেতারা প্রবল প্রতিবাদ করলেন। ১৯১৯ সালের ৩০ মার্চ সমগ্র ভারতব্যাপী সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু হবে বলে স্থির করা হল। পরে অবশ্য ৩০ মার্চের পরিবর্তে ৬ এপ্রিল আন্দোলন শুরু হল। এই আইন অমান্যের বিরুদ্ধে জাতীয় কংগ্রেসের নরমপন্থী কিছু নেতা, যেমন, অ্যানি বেসান্ত, খাপার্ডে, ওয়াচা, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়রা আপত্তি জানিয়েছিলেন। কিন্তু আন্দোলন শুরু হল। দিল্লিতে গুলি চলল এবং দিল্লি আসার পথে গাঁধীজিকে ৯ এপ্রিল ট্রেনের মধ্যে গ্রেফতার করা হল। অমৃতসরে ডঃ কিচলু ও ডঃ সত্যপালকে পুলিশ গ্রেফতার করায় তুমুল বিক্ষোভ শুরু হয়। এরই পরিণতি বিনা প্ররোচনায় জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংস হত্যাকাণ্ড। পাঁচিলঘেরা এক ছোট্ট বাগিচায় জড়ো হওয়া এক জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য জেনারেল ডায়ার গুলি চালানোর হুকুম দেয় এবং অন্তত এক হাজার মানুষ নিহত হন। আহতের সংখ্যা অগণিত। জনতার অপরাধ, তারা ১৮৮ ধারা ভেঙে বেআইনি সমাবেশ ঘটিয়েছে— সে সমাবেশ রাজনৈতিক হোক বা না হোক।

অলংকরণ: তিয়াসা দাস।

অনেক ঐতিহাসিকের মতে, রাওলাট অ্যাক্ট বিরোধী আন্দোলন ভারতবর্ষের সর্বত্র সফল হয়নি। আন্দোলন তীব্র পর্যায়ে পৌঁছেছিল গুজরাত, পঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশ ও মহারাষ্ট্রের কিছু কিছু অঞ্চলে। এবং এই আন্দোলনের পিছনে রাজনৈতিক কালা কানুন ছাড়া অর্থনৈতিক দাবিদাওয়ার কারণও ছিল। খাদ্য-বস্ত্র কেরোসিনের ভয়াবহ দামবৃদ্ধি মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত মানুষের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ সঞ্চার করেছিল। মুম্বইয়ের সূতাকল শ্রমিকদের মধ্যে জাতপাত-নির্বিশেষে ঐক্যচেতনা বিশেষ ভাবে দেখা গিয়েছিল। উত্তরপ্রদেশের মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে খিলাফত্ প্রশ্নটিও জোরদার হয়ে উঠেছিল। আর পঞ্জাবের আন্দোলনের পিছনে ছিল দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ছাড়া যুদ্ধকালীন কর, ঋণের চাপ ও ব্যাঙ্কশিল্পের মহাসঙ্কট। গদর আন্দোলনের প্রভাব ও কোমাগাতামারু জাহাজে শিখদের উপর সৈন্য ও পুলিশের গুলিবর্ষণের ঘটনাও স্মৃতিতে ছিল। লাহৌরের আন্দোলনের ক্ষেত্রেও ছোট ব্যবসায়ীদের দুর্দশা ও মুসলিম কারিগরদের বিপন্নতা বিশেষ কারণ ছিল।

জালিয়ানওয়ালাবাগের ঘটনার পর পঞ্জাবের সর্বত্র প্রবল বিক্ষোভ শুরু হয়। লাহৌর, অমৃতসর, গুজরানওয়ালা, কাসপর প্রভৃতি স্থানে হিংসাত্মক কাণ্ডকারখানা শুরু হয়। টেলিগ্রাফের তার, ট্রেন ও সরকারি গাড়ি আক্রান্ত হয়। আগুন লাগানোর ঘটনাও ঘটতে থাকে। সরকার পঞ্জাবের সর্বত্র সামরিক আইন বা মার্শাল ল জারি করে। সংবাদপত্রের উপর নিষেধাজ্ঞা বলবত্ করে সংবাদ বাইরে বেরোতে দেয় না। অসামরিক মানুষের পঞ্জাবে ঢোকা বা বেরনোর উপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়।

ফলে অমৃতসরের ঘটনার কথা সমগ্র দেশে পৌঁছতে সময় লেগেছিল। রবীন্দ্রনাথও তাঁর বন্ধু আশুতোষ চৌধুরীর কাছে খবরটা পেয়েছিলেন মে মাসের শেষের দিকে এবং ২৯ মে ১৯১৯, অর্থাত্ ঘটনা ঘটার প্রায় দেড় মাস পর তিনি নাইটহুড ত্যাগের চিঠি লেখেন। গাঁধীজি, চিত্তরঞ্জন দাশ এবং জাতীয় গণ্যমান্য নেতারা তখনও চুপচাপ। নাইটহুড প্রত্যাখ্যানের খবর জানার পর গাঁধীজি শ্রীনিবাস শাস্ত্রীকে এক চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘The Punjab horrors have produced a burning letter from the poet, I personally think it is premature.’ আর কবির নাইটহুড ত্যাগের প্রায় দু’মাস পর, ১৯১৯-এর ১৯ জুলাই স্যর শঙ্করণ নায়ার ভাইসরয়ের এগজিকিউটিভ কাউন্সিল থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। পঞ্জাবে দীর্ঘকাল ধরে সামরিক শাসনের প্রতিবাদে ছিল নায়ারসাহেবের পদত্যাগ। এর পর বছরের শেষে জাতীয় কংগ্রেসের বাত্সরিক সম্মেলনে শঙ্করণ নায়ারকে অভিনন্দন জানিয়ে অভিনন্দনজ্ঞাপক রেজলিউশন গ্রহণ করা হয়েছিল, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের কথা উচ্চারিতই হল না।

জালিয়ানওয়ালাবাগের ঘটনার একশো বছর পর এই তথ্যগুলিই মনে এল। মনে এল এই তথ্যও যে, পঞ্জাব-কাণ্ডের তদন্তের জন্য হান্টার কমিশন রিপোর্ট দাখিল করার পর ইংল্যান্ডের লর্ড সভা জেনারেল ডায়ারকে জালিয়ানওয়ালা হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ থেকে অব্যাহতিই শুধু দিল না, তাঁকে অভিনন্দন জানাল। মনে পড়ে ওই ঘটনাও যে, ১৯৪০ সালে লন্ডনের ব্যাক্সটন হলে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় জালিয়ানওয়ালার হত্যাকাণ্ডের জন্য কুখ্যাত পঞ্জাব গভর্নর স্যর মাইকেল ওডায়ারকে গুলি করে হত্যা করেছিলেন পঞ্জাবের উধম সিংহ। তিনি তখন লন্ডনে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র। ১৯৪০ সালেই তাঁর ফাঁসি হয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE