পশ্চিমবঙ্গ তথা কলিকাতা মঙ্গলবার কোভিড-১৯’এর মানচিত্রে নাম তুলিল। এবং রচিত হইল এক নূতন দায়িত্বজ্ঞানহীনতার ইতিহাস। তৈয়ারি হইল নূতন উদ্বেগ। বিলাত-ফেরত যে তরুণ রাজ্যের প্রথম নোভেল করোনাভাইরাস আক্রান্ত হিসাবে চিহ্নিত হইলেন, তিনি এবং তাঁহার স্বজনবান্ধবরা ইতিমধ্যে কত জনকে সংক্রমিত করিয়াছেন, তাহা একটি গুরুতর প্রশ্ন হিসাবে দেখা দিয়াছে। এই প্রশ্ন এতটা উঠিত না, যদি তাঁহার সংক্রমণের সম্ভাবনাকে ওই তরুণ ও তাঁহার পরিবারের সংশ্লিষ্ট সদস্যরা যথেষ্ট গুরুত্ব দিতেন এবং প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বন করিতেন। তাঁহারা তাহা করেন নাই। এমনকি রাজ্য সরকারের সচিব পদে আসীন তাঁহার জননীও, প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী, অকল্পনীয় ও অমার্জনীয় দায়িত্ববোধহীনতার পরিচয় দিয়াছেন। এই ঘটনা এক অর্থে এক বিপুল বিপদের সঙ্কেত বহন করিতেছে। কোভিড-১৯’এর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সংগ্রামে প্রশাসনের দায়িত্ব প্রচুর। চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীদেরও। কিন্তু এই দুর্বিপাক রোধ করিতে তাঁহাদের প্রাণপাত চেষ্টাও বিফল হইতে পারে, যদি না নাগরিকেরা নিজেদের দায়িত্ব যথাযথ পালন করেন।
দুর্ভাগ্য, ভারতে নাগরিকদের মধ্যে সেই সচেতনতার অভাব প্রকট। এমনকি বিপর্যয়ের এই মধ্য-দ্বিপ্রহরেও। প্রতি দিনই সংবাদ মিলিতেছে, কেহ কোয়রান্টিন এড়াইয়া পলাইয়া যাইতেছেন, সংক্রমিত অবস্থায় কেহ গণপরিবহণ ব্যবহার করিতেছেন, কেহ আবার স্বাস্থ্য পরীক্ষাতেই নারাজ। যাঁহারা এ-হেন দায়িত্বজ্ঞানহীনতার প্রমাণ দিতেছেন, তাঁহাদের বেশির ভাগই প্রথাগত অর্থে উচ্চশিক্ষিত, অনেকেই সমাজের উচ্চকোটির বাসিন্দা। তাঁহাদের শুধু এই বোধটুকু নাই যে সংক্রমিত অবস্থায় তাঁহারা যদি স্বাস্থ্যবিধি না মানেন, তবে আরও অজস্র মানুষকে তাঁহারা বিপদের দিকে ঠেলিয়া দিতেছেন। অনেকেই বলিতেছেন, ইহা স্বার্থপরতা। কথাটি অর্ধসত্যমাত্র। নিতান্ত কাণ্ডজ্ঞানহীন না হইলে অতি বড় স্বার্থপর মানুষও জানেন যে, স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর আয়তন সীমিত, একটি নির্দিষ্ট সীমার অধিক চাপ বহনে সেই পরিকাঠামো অক্ষম। নিজে সংক্রমিত অবস্থায় অনেকের সংস্পর্শে আসিলে তাঁহাদের সংক্রমণের সম্ভাবনাও বাড়িবে, সীমিত স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর উপর চাপ বাড়িবে। ফলে, ওই স্বার্থপর মানুষের নিজের যথাযথ স্বাস্থ্য পরিষেবা পাইবার সম্ভাবনা কমিবে। অতএব সংক্রমিত হইলে স্বার্থবোধসর্বস্ব মানুষেরও চেষ্টা করা উচিত, যাহাতে অন্যদের মধ্যে সংক্রমণ না ছড়ায়।
স্বার্থবোধের ধারণাটি প্রকৃতপক্ষে সামাজিক মূল্যবোধ ও অভ্যাস হইতেই জন্মায় এবং তাহার দ্বারাই লালিত হয়। সঙ্কীর্ণ স্বার্থ হইতে বৃহত্তর স্বার্থে উত্তরণের জন্য যথাযথ সামাজিক আদর্শ ও নীতিবোধের অনুশীলন আবশ্যক। দুর্ভাগ্যের কথা, ভারতে সেই অনুশীলনের ঘোর অনটন। দুর্ভাগ্যের কথা, সমাজ এবং রাষ্ট্র এই দেশে নাগরিককে ‘নাবালক’ হিসাবে দেখিতে অভ্যস্ত। সেই নাগরিকের নিকট রাষ্ট্র যখন কিছু প্রত্যাশা করে, তখনও নাগরিকের বোধের ওপর নির্ভর না করিয়া অক্ষরে অক্ষরে বলিয়া দেয়— কী চাই। স্বভাবতই, ভারতীয়দের একটি বড় অংশ সমষ্টির প্রতি দায়বদ্ধতা শিখিয়া উঠিতে পারে নাই। ফলে, বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়াইয়াও নাগরিক জানে না তাহার কর্তব্য কী। এইটুকুও বোঝে না যে এই কঠিন সময়ে প্রতিটি নিয়ম অক্ষরে অক্ষরে মানিয়া চলিতেই হইবে। কোয়রান্টিন থাকিতে যদি অসুবিধা হয়, তাহা মানিয়া লওয়াই একমাত্র কাজ। নাগরিকের মধ্যে এই প্রাথমিক দায়িত্ববোধটুকু গড়িয়া না উঠা রাষ্ট্র হিসাবে ভারতের ব্যর্থতা। আজ না হউক পরশুর পরের দিন করোনাভাইরাসের প্রকোপ কমিবে। নাগরিকের দায়িত্ববোধ জাগ্রত হইবে, সেই আশা ক্ষীণতর।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy