Advertisement
E-Paper

দলছুটদের রক্ষাকবচ

এ বার কোনটা ছোটখাটো বিষয় আর কোনটা নয়, তা কী ভাবে নির্ধারিত হবে? ছোট বলে ধরে নেওয়ার মধ্যে কোনও বড় ভুল থেকে যাবে না তো?

জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৬ অগস্ট ২০১৭ ০৬:০০

ডি মিনিমিস। একটি লাতিন শব্দ। প্রাচীন রোম সাম্রাজ্যে সেনাপ্রধান বা ম্যাজিস্ট্রেটকে ডাকা হত প্রায়েটর বলে। সেই সঙ্গে তখনকার আইনি লব্‌জ একটা কথা খুব বলা হত, প্রায়েটর কখনও ডি মিনিমিস বা ছোটখাটো ব্যাপারে মাথা গলান না। ‘ডি মিনিমিস নন কিউরাট প্রায়েটর’। আইনি পরিভাষায় আজও ছোটখাটো ত্রুটিবিচ্যুতি বোঝাতে কথাটা ব্যবহার করা হয়।

এ বার কোনটা ছোটখাটো বিষয় আর কোনটা নয়, তা কী ভাবে নির্ধারিত হবে? ছোট বলে ধরে নেওয়ার মধ্যে কোনও বড় ভুল থেকে যাবে না তো?

বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্টের যে রায়ে ব্যক্তিপরিসরের অধিকার মৌলিক সাংবিধানিক অধিকারের স্বীকৃতি পেয়েছে, তা নানা কারণেই ঐতিহাসিক। সেই অনেক কারণের মধ্যে একটা কারণ কিন্তু এই ছোটখাটো বলে দেগে দেওয়ার প্রবণতার মধ্যে অনেক সময় যে বিপদ লুকিয়ে থাকে, সেটা স্মরণ করিয়ে দেওয়া। যে র‌্যাশনাল বা যুক্তিকাঠামো বহু বিষয়কেই ক্ষুদ্র, তুচ্ছ, ছোট্ট ঘটনা বলে চালিয়ে দেয়, সুপ্রিম কোর্ট সরাসরি সেই ‘ডি মিনিমিস র‌্যাশনাল’কে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। এবং সেটা করেছে নিজেরই একটি পুরনো রায়ের বিরোধিতা করে।

এ দেশে এলজিবিটি সম্প্রদায় তাঁদের যৌন রুচিতে সমানাধিকার পাবেন কি না, সেটা নির্ভর করে আছে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারা রদ হবে কি না তার উপরে। কেননা ওই ধারায় সমকামী যৌন সংসর্গ অপরাধের আওতায় পড়ে। ২০১৩ সালে এই নিয়ে সুরেশ কৌশল বনাম নাজ ফাউন্ডেশন মামলায় সুপ্রিম কোর্ট হাইকোর্টের রায় খারিজ করে বলেছিল, ওই ধারা অসাংবিধানিক নয়।

ব্যক্তিপরিসরের অধিকার নিয়ে রায় দিতে গিয়ে এ বার কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট স্পষ্ট ভাষায় বলেছে, ওই রায়ে ত্রুটি আছে, আমাদের মত এ নয়। এই প্রসঙ্গে ফ্ল’ড এবং আনঅ্যাক্সেপ্টেবল— এই দুটো শব্দই ব্যবহার করেছে সুপ্রিম কোর্ট। প্রধান বিচারপতি জে এস খেহর, বিচারপতি আর কে অগ্রবাল, বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় এবং বিচারপতি এস আব্দুল নাজির লিখেছেন— ‘‘...কৌশল মামলায় ব্যক্তিপরিসরের প্রশ্নটি যে ভাবে দেখা হয়েছে, আমরা তার সঙ্গে একমত নই (উই ডিসএগ্রি)...।’’

তার মানে, এ দেশে এলজিবিটি সম্প্রদায়ের সমানাধিকারের দাবি এবং ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারা রদ করার আবেদনের ব্যাপারে, সুপ্রিম কোর্টের মনোভাব কী, এ নিয়ে এই মুহূর্তে অন্তত ধন্দের অবকাশ থাকছে না। যদিও ৩৭৭ নিয়ে পৃথক মামলাটি যেহেতু অন্য বেঞ্চে বিচারাধীন, ফলে এ নিয়ে নির্দিষ্ট রায় সেখানেই আসবে। কিন্তু নিজেরই চার বছর আগের রায় নিয়ে এমন দ্ব্যর্থহীন ভাষায় প্রশ্ন তুলে সুপ্রিম কোর্ট একটি নির্দিষ্ট বার্তা দিল।

সেটা কী? কৌশল মামলার রায়ের কথা বলতে গিয়েই তার অন্তর্নিহিত ‘ডি মিনিমিস র‌্যাশনাল’ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে শীর্ষ আদালত। ৩৭৭ ধারায় খুব অল্প লোকেই অভিযুক্ত হয়েছে এ যাবৎ, অতএব তাতেই প্রমাণ হচ্ছে যে সেটা ব্যক্তি অধিকার লঙ্ঘনের খুব বড় ঘটনা নয়— কৌশল মামলার রায়ের এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত হতে পারেননি বিচারপতিরা। তাঁরা সমস্বরে বলেছেন, যৌন সত্তা, যৌন রুচি ব্যক্তিসত্তার অচ্ছেদ্য অঙ্গ। সমতা, স্বাধীনতা আর বেঁচে থাকার অধিকারের সমান। সেখানে সেটা কত জন, কী বৃত্তান্ত সেটা ধর্তব্য নয়। অর্থাৎ মৌলিক অধিকারের লঙ্ঘনটাই বড় কথা। সেটা এক জনের হলেও তাই, একশো জনের হলেও তাই। সংখ্যা আর সত্তার দ্বন্দ্বে সুপ্রিম কোর্টের এই সুস্পষ্ট অবস্থানটির গুরুত্ব অসীম। আদালত শুধু যৌন রুচিকে ব্যক্তিপরিসরের অন্তর্ভুক্ত করে তাকে মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতিই দিল না, সংখ্যার নিরিখে সেই অধিকারে যেন তারতম্য করা না হয়, সেই নির্দেশও পরোক্ষে দিয়ে রাখল।

ভেবে দেখলে দেখা যাবে, চিন্তাভাবনায় ডি মিনিমিস-এর সংক্রমণের একটা বড় উৎস কিন্তু সংখ্যার জোর, গরিষ্ঠতার জোর। ঘটনা হল, যারা মাথা গুনতিতে কম, তাদের ভালমন্দের ব্যাপারটা ছোটখাটো বলে চালিয়ে দেওয়াটা খুব সোজা। এড়িয়ে যাওয়া, ভুলে যাওয়া, ঝুলিয়ে রাখা, হাসিমশকরা করে উড়িয়ে দেওয়াটা সেখানে জলভাত। দাবিদাওয়া আদায়ের লড়াইয়ে এ ঘটনা হরবখত আমাদের চোখে পড়ে। এবং রাষ্ট্র থেকে সমাজ, কোথাওই এর অন্যথা হয় না। সুপ্রিম কোর্টের নতুন রায় কিন্তু সেটাও কড়া ভাষায় বলেছে। এলজিবিটি অধিকারের প্রসঙ্গেই বলেছে।

বৃহস্পতিবারের রায়ে সুপ্রিম কোর্ট এক দিকে নিজের পুরনো অবস্থানকে নস্যাৎ করেছে। ব্যক্তিপরিসরে রাষ্ট্রের খবরদারি চলবে না বলে জানিয়েছে। কে কী পরবে, কী খাবে, কার সঙ্গে কোন সম্পর্কে লিপ্ত হবে, সেটা রাষ্ট্র ঠিক করে দিতে পারে না, এ কথা রায়ে গোটা গোটা করে বলা আছে। একই সঙ্গে বিচারপতিরা এ কথাও সমান জোর দিয়ে বলেছেন, যৌন রুচির সমানাধিকারের প্রশ্নে সমাজের গরিষ্ঠ জনতা এবং মূলস্রোত কী ভাবছে, কী পছন্দ করছে বা করছে না, সেটা অপ্রাসঙ্গিক। অর্থাৎ গরিষ্ঠের ভাবাবেগ বা ‘সনাতনী’ ঐতিহ্য, কোনও হাড়িকাঠেই ব্যক্তির মৌলিক অধিকারকে বলি দেওয়া চলবে না। ডি মিনিমিস র‌্যাশনাল-এর ব্যাধি রাষ্ট্রনেতা থেকে আম আদমি, এমনকী কখনও কখনও যে খোদ বিচারবিভাগকেও আচ্ছন্ন করে, সুপ্রিম কোর্টের নতুন রায় কিন্তু সে কথাই বলে দিল। নইলে ২০১৩-র রায়েও বলা ছিল, সরকার চাইলে আইন বদলাক! চার বছরে সে কাজ তো হয়নি! এলজিবিটি-র অধিকার নিয়ে আলাপ-আলোচনা কম হয় না! আম আদমির মন থেকে বিদ্বেষ ঘৃণা অসহিষ্ণুতা উদাসীনতা অজ্ঞানতা তো মুছে যায়নি! কেন? সেই ডি মিনিমিস! ছোটখাটো ব্যাপার! তাচ্ছিল্যের বিষয়! সেটা যৌন রুচির প্রশ্নে হতে পারে, উন্নয়নের নামে উচ্ছেদের প্রশ্নে হতে পারে, মানসিক-শারীরিক প্রতিবন্ধকতার ক্ষেত্রে হতে পারে, পুরুষবেষ্টিত কর্মক্ষেত্রে নারী কর্মীর হতে পারে... নেহাতই বন্ধুবর্গের মধ্যে একটু ভোলেভালা কাউকে নিয়ে অনবরত টিটকিরি করে যাওয়ার ব্যাপারও হতে পারে।

ব্যক্তিপরিসরের মৌলিক অধিকার ব্যক্তির জন্য বটে। কিন্তু ব্যক্তিসত্তার ধারণাটাই প্রতিনিয়ত যেখানে নির্মিত হতে থাকে মূলস্রোতের গর্ভে, সংখ্যাগুরুর দাদাগিরি যেখানে কার্যত ঠিক করে দেয় কে ব্যক্তিপদবাচ্য আর কে নয়, সেখানে দলছুটদের জন্য রক্ষাকবচ ছাড়া আর কীই বা পড়ে থাকে! একনায়কত্বের চেয়ে গরিষ্ঠের আধিপত্য নিশ্চয় ভাল। কিন্তু তা থেকে অহরহ অপরের প্রতি যে তাচ্ছিল্য ঠিকরে পড়ে, তার বিপদও বড় কম নয়। সুপ্রিম কোর্টের রায় সে কথা আরও এক বার মনে করিয়ে দিয়ে গেল।

domination dictatorship ব্যক্তিপরিসর
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy