Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

কী রকম ভাবে বেঁচে আছেন

মুভিতে ওই ওদের কথা আছে, যে শ্রেণিতে আমি জন্মাইনি, বসবাসও করি না। নারীস্বাধীনতা বলতে আমি বুঝি আমার একার একখানা ঘর।

চৈতালী চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৪ অগস্ট ২০১৭ ০৬:০০
Share: Save:

লিপস্টিক আন্ডার মাই বুরখা দেখে বেরনোর সম‌য় ভাবছিলাম, এটা নিয়ে এত বিতর্ক কেন? ধর্ম? হতেই পারে। আমার কাছে ধর্ম কোনও ব্যাপার না হলেও যা দিনকাল, তাতে সিনেমার নাম ইত্যাদি ইত্যাদি আগুনে সে ইন্ধন দিতেই পারে! না কি, সেক্স! হ্যাঁ, সেটা একটা পয়েন্ট বটে! মেয়েদের কামনাবাসনা এত খোলাখুলি এই সিনেমাটায়, যে, সমাজ সংসারের বিব্রত লাগতেই পারে!

মুভিতে ওই ওদের কথা আছে, যে শ্রেণিতে আমি জন্মাইনি, বসবাসও করি না। নারীস্বাধীনতা বলতে আমি বুঝি আমার একার একখানা ঘর। বুঝি, ‘সেকেন্ড সেক্স’ থেকে উত্তরণের লড়াই। এই সিনেমায় মেয়েরা এই সব লম্বাচওড়া বিষয় খায় না মাথায় দেয় জানে না। অথচ কাচ-বসানো দেওয়ালের ওপর দিয়ে হেঁটে চলে। ক্রমাগত রক্তাক্ত হয়। এদের লড়াইটা সিস্টেমের বিরুদ্ধে, গা-গতর দিয়ে। ফলত,আমরা যারা সরাসরি ব্র্যান্ডেড, বিকট দামি লিপস্টিক মেখে, শ-তিনেক টাকার পপকর্ন চিবোতে চিবোতে এসি হলে এসে দামি টিকিট কেটে বসি, এই সব মেয়েদের চাওয়াপাওয়াগুলো অচেনা মনে হয়। দেখেশুনে গা গুলিয়ে উঠতে পারে কিংবা মনে হতে পারে— এরা কারা? সিনেমা যত এগোয়, ‘বুরখা’ সংকেত খোলে পরতে পরতে। না, এ কোনও ধর্মীয় পোশাক নয়, এ ক্ষেত্রে। সালোয়ার-কামিজ, ঘাগরা-চোলি, শাড়ি, বোরখা, সবই তো আবরণ, এক নারীজীবন যাপন। যার আড়ালে সেই আলোরং লিপস্টিক। মুক্তি। অর্থ, এক এক জনের কাছে এক এক রকম। অবহেলায়, কিংবা কেবল মাসি-পিসি হয়ে বেঁচে-থাকা মেয়েদের জন্য। পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে যাওয়া।

বোরখার আড়ালে শপলিফটিং করে যে-মেয়ে, সে আদৌ চোর নয়, মলিন একটা টেলারিং শপ চালানো বাবা মা তাকে অতিকষ্টে নামী কলেজে ভর্তি করিয়েছেন। খাঁচা-খোলা পাখি সে, কনজিউমারিজম-এর আলো তার কাছে স্বাধীনতার নামান্তর। তার রুটি জোটে কোনও মতে। বইপত্র জোটে না বললেই চলে। সে দেখে বড়লোকের মেয়েদের উল্লাস। সিগারেট-খাওয়া। মদ্যপান। সে দেখে, জিন্স পরতে দিতে হবে, তা নিয়ে প্রতিবাদ। মহল্লার দেশলাই বাক্সের মতো ছোট ঘরে আটকা সে-মেয়ে, রাত জেগে সেলাই মেশিন চালিয়ে বোরখা বানাতে হয় যাকে। তার বেসুর জীবনে কলেজ ফেস্ট-এ গান-গাওয়া, সিগারেট, মদ, জিন্স-কাতরতা, মস্ত আর খোলা আকাশের স্বাধীনতা নিয়ে আসে। আর এক মেয়ে বরকে লুকিয়ে চাকরিতে যায়। বর আসে, মেয়েটিকে নিরুপায় যন্ত্রণাকাতর সহবাস দেয়। বার বার সন্তানসম্ভবা হয় সে। শুধু নিজের আয়ু ও জীবনীশক্তি বাড়ানোর জন্য এই মেয়ে প্রাণান্তকর লজ্জা চেপে রেখে নিজেই দোকান থেকে কন্ডোম কিনে নিয়ে আসে। আর তার বর ছুড়ে ফেলে দেয় সেই বস্তুটিকে। সে পড়েনি, ‘নারী স্বনির্ভরতাই হল নারীস্বাধীনতার জরুরি পাঠ’, তবু পারিবারিক হিংসা ও স্বামীর যৌননিগ্রহের সমান্তরাল, সে চাকরি নিয়ে উড়ে বেড়াতে চায়, আবার নিজের অর্জিত আভেনে কেক বানিয়ে খাওয়াতে চায় নিজেরই পরিবারকে! এই প্যারাডক্সও তো অচেনা নয় আমাদের কাছে!

সেই মেয়েটির কথাও আছে। প্রতিদিন অন্যদের সামনে নগ্ন হয়ে বসে-থাকা মা, মেয়েকে সমাজে এক টুকরো প্রতিষ্ঠা দিতে চায়, আর মেয়ে চায় অন্য কিছু। হতে পারে, তা যৌনমুক্তি, হতে পারে, নিজের মতো বাঁচা। আর আছে এক সিন্ডারেলার গল্প। এই মহল্লার বাড়িউলি মাসিমা তিনি। সামাজিক জীবন তাঁকে ‘বয়সের ধর্ম’ শেখাতে চায় যত, তিনি তত স্বপ্নালু হয়ে ওঠেন। হেমন্তের চৌকাঠ-ছোঁয়া সে-মহিলা, জীবন তাঁকে রোমাঞ্চ দেয়নি বহু দিন, সারা দিনের তুচ্ছতা ও কলহ পার হয়ে রোজ রাতে চুপিচুপি স্নান করে ওঠেন মানস অভিসারে। হলুদরঙা বই পড়ে রাজপুত্রের ছোঁয়া পান। সুইমিং পুলে সুগঠিত শরীরের ছেলেকে দেখে তাঁর অবদমিত বাসনা উপচে ওঠে। কস্টিউম জোগাড় করেন। মন্দিরে যাওয়ার নাম করে জলে নেমে যান।

এই সব ভয়ংকর পাপাচারিণীদের শাস্তি তো হবেই। নারীবাদের সুন্দর প্রতিমা কোথায়, শুধু কঙ্কাল এদের চার পাশে! পরিবার ও সমাজ লাঞ্ছনা, অপমান দেয়। তার পর ওরা সবাই মিলে একটা ঘরে বাঁচে কিংবা বাঁচার অভিনয় করে যায়। সেই ঘরে এ ওর চোখের জল মুছিয়ে দিচ্ছে। এক জন ধরিয়ে দিচ্ছে অন্যজনার সিগারেটের আগুন।

এরই নাম স্বাধীনতা? না, নিশ্চয়ই। কিন্তু ওই যে শুরুতে বলেছিলাম, এক একটা অসহায় অথচ আলোমুখী পদক্ষেপ। চুরি-করা লিপস্টিক। বোরখার আড়াল।

আমরা যখন গ্লোরিয়া স্টাইনেম, অ্যালিস পল, কেট মিলেট-এর চিন্তন নাড়াচাড়া করি, তখন অল্প-মাপের স্বাধীনতা ও সম্মান-চাওয়া এই সিনেমার নারীচরিত্রদের, নিম্নবিত্ত, ঘোর নিম্নবিত্ত এই মেয়েদের এক এক রকম যাপন পাশাপাশি সাজিয়ে, জলছবির মতো, হয়তো কিছুটা অগোছালো নির্মাণ, একটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে, বাঁকিয়ে চুরিয়ে, একদম সরলরেখায় চোখ না পাঠিয়ে, দেখুন তো, সেলুলয়েডে আমরা কি নিজেদেরই প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছি না?

প্রশ্ন ওঠাল কেউ-কেউ, উত্তরণের কথা কোথায়? কোথায় পথনির্দেশ? আমার পাশেই বসে সিনেমাটা দেখলেন এক বোরখা-পরা জননী। কোলে, কাঁখে, হাতে চারটি সন্তান। দেখলেন, এক হলুদের দাগ-ধরা আঙুল নেড়ে টিকিট-কাটা রমণী। উত্তরণ তো কোনও গাছ থেকে টুপ্ করে খসে-পড়া পাকা ফল নয়। আমার ওই সহদর্শক মেয়েরা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন আমায়— শিল্প এইটুকু পারে। আর তার পর ধীরে-ধীরে মন জেগে ওঠে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Konkona Sen Sharma Society Lipstick Under My Burkha
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE