Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
United Nations

নারীর জন্য বিনি সুতোর মালা

সংক্রমণ-উত্তর সময়ে বাল্যবিবাহ, কুমারীমাতৃত্ব তথা নারী অপুষ্টির মতো বিষয়গুলি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। 

প্রহেলী ধর চৌধুরী
শেষ আপডেট: ১৭ জুলাই ২০২০ ০০:০১
Share: Save:

রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিব আন্তোনিয়ো গুতেরস বলেছেন, করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলার পরিকল্পনার কেন্দ্রে রাখতেই হবে কন্যাশিশু ও মহিলাদের কথা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, বিশ্ব ব্যাঙ্কের মতো সংস্থাগুলিও কার্যত একই কথা বলছে বারে বারে। এই উদ্বেগ কেন? অতিমারির মতো আর্থসামাজিক অনিশ্চয়তার আবহ বিশ্ব জুড়েই মহিলা ও কন্যাশিশুদের ওপর অনেক গুরুতর ও সুদূরপ্রসারী আঘাত হানে, সমাজ সংসারে লিঙ্গবৈষম্য বাড়িয়ে তোলে এক লাফে অনেক গুণ।

২০১৪ সালে ইবোলা সংক্রমণ, ২০১৫-১৬’র জ়িকা ভাইরাসের আক্রমণ, বা সাম্প্রতিক সার্স ভাইরাস, সোয়াইন ফ্লু বা বার্ড ফ্লু-তে আক্রান্ত অঞ্চলগুলিতে দেখা গিয়েছিল, মহামারির ধাক্কায় প্রাথমিক ভাবে সবার আর্থিক অবনতি হলেও, পুরুষদের তুলনায় মেয়েদের আয় স্বাভাবিক স্থিতিশীল অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে সময় লেগে যায় ঢের বেশি। মহিলাদের গর্ভকালীন জটিলতাজনিত বা অন্যান্য সংক্রামক ব্যাধিজনিত মৃত্যুহার যেমন সাধারণ অবস্থার থেকে অনেক গুণ বেড়ে যায়, বাড়ে গার্হস্থ্য হিংসার ঘটনাও। মহিলাদের গার্হস্থ্য শ্রমের পরিমাণও অনেক গুণ বাড়ে। আবার সংক্রমণ-উত্তর সময়ে বাল্যবিবাহ, কুমারীমাতৃত্ব তথা নারী অপুষ্টির মতো বিষয়গুলি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।

ইনস্টিটিউট ফর উইমেন’স পলিসি রিসার্চ-এর গবেষণা অনুযায়ী, এ বছর এপ্রিলে মহিলারা কাজ হারিয়েছেন পুরুষদের তুলনায় তিন গুণ। মেয়েদের প্রাধান্য আছে এমন কিছু ব্যবসাবাণিজ্য, যেমন ভ্রমণ, বা অতিথি-পরিষেবামূলক ব্যবসাগুলি বিপুল ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায়; এবং বিভিন্ন অসংগঠিত মহিলাপ্রধান ক্ষেত্রে যেমন কৃষিকাজ, গেরস্থালির ঠিকে কাজ, ঘরোয়া আয়ার কাজ ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিপুল কর্মহ্রাসের ফলে বহু মহিলা উপার্জনের সুযোগ হারিয়েছেন। ইউনেস্কোর পূর্বাভাস বলছে, লকডাউনের জেরে স্কুল কলেজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলির প্রায় ১১ কোটি ছাত্রীর পড়াশুনা সম্পূর্ণ ভাবে বন্ধ হতে চলেছে। জাতীয় মহিলা কমিশন জানাচ্ছে, লকডাউনের সূচনাকাল থেকে এপ্রিলের মাঝামাঝি অবধি এ দেশে গার্হস্থ্য হিংসার ঘটনা ১০০% বৃদ্ধি পেয়েছে। ইনস্টিটিউট ফর সোশ্যাল স্টাডিজ় ট্রাস্টের গবেষণা অনুযায়ী, মহিলাদের গার্হস্থ্য শ্রমের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে ৬৬%।

যে কোনও অর্থনৈতিক অ-স্থিতাবস্থাই মহিলাদের ওপর প্রথম আঘাত হানে। মহামারি বা অতিমারির দিনে এই অর্থনৈতিক অ-স্থিতাবস্থার সঙ্গে মৃত্যুভয়, সামাজিক অস্থিরতা ও রাজনৈতিক উত্তেজনার মতো আরও কয়েকটি বিষয় যুক্ত হয়ে পরিস্থিতি জটিলতর হয়। তুলনামূলক ভাবে পিছিয়ে পড়া বা উন্নয়নশীল দেশগুলিতে সংস্থান সর্বদাই অপ্রতুল। সেখানে প্রথমেই আঘাত আসে অপেক্ষাকৃত ভাবে দুর্বল ও পিছিয়ে থাকা অংশের ওপর।

২০০৩ সালে দিল্লির একটি অর্থনৈতিক ভাবে অনগ্রসর অঞ্চলে এক সমীক্ষায় দেখা যায়, ডায়ারিয়ায় ওই অঞ্চলের বাচ্চা মেয়েদের মৃত্যুহার বাচ্চা ছেলেদের মৃত্যুহারের প্রায় দ্বিগুণ। অন্য এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, ভারতে খরাজনিত দুর্ভিক্ষের সময় মহিলাদের মৃত্যুহার পুরুষদের তুলনায় অনেক বেশি; অর্থনৈতিক সঙ্কটের সময় ডাইনি সন্দেহে সমাজের বয়স্ক মহিলাদের খুনের ঘটনাও সাধারণ অবস্থার তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ।

ভারতে সাধারণ সময়েই মেয়েদের সামগ্রিক অবস্থা করুণ। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের আন্তর্জাতিক লিঙ্গবৈষম্য নির্ধারক সূচক অনুসারে, ২০২০ সালে ১৫৩টি দেশের মধ্যে ভারত ১১২তম স্থানে। মহিলাদের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং রাজনৈতিক অংশগ্রহণ— সূচকের এই চারটি মাপকাঠির মধ্যে প্রথম তিনটিতে ভারতের মহিলারা যথাক্রমে ১৪৯, ১১২ এবং ১৫০তম স্থানে।

বিশ্বের সব দেশকেই যদি আজ এই অতিমারি পরিস্থিতির মোকাবিলায় কন্যাশিশু ও নারীকেন্দ্রিক নীতি গ্রহণ করতে হয়, ভারতকে করতে হবে তার চেয়ে অনেক বেশি। ভারতে মহিলা ও শিশুকন্যারা আবহমান কাল থেকে যে বৈষম্য ও নিপীড়নের শিকার, কোভিড-১৯ সেগুলোকেই তীব্রতর করেছে। তাই, সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজতে হবে নারীবিষয়ক চিরাচরিত সমস্যাগুলিকে গভীর ভাবে অনুধাবনের মাধ্যমেই।

নারী উন্নয়নমূলক এ যাবৎ কালের গবেষণা ও তত্ত্ব থেকে সমসাময়িক কালের নিরিখে নারী মুক্তি ও উন্নয়নের প্রাথমিক যে উপাদানগুলিকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়, সেগুলি হল নারী শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও স্বতন্ত্র সিদ্ধান্তগ্রহণের ক্ষমতা। উন্নয়নের এই উপাদানগুলিকে চক্রাকারে উপস্থাপন করা সম্ভব। কী রকম? শিক্ষার ফলে পেশাগত যোগ্যতা তথা চাকরির সম্ভাবনা বাড়ে; অর্থাৎ অর্থনৈতিক স্বাধীনতার পথ উন্মোচিত হয়। আবার অর্থনৈতিক স্বাধীনতা যে হেতু মতপ্রকাশের স্বাধীনতা তথা স্বতন্ত্র সিদ্ধান্ত প্রকাশের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে, তাই স্বাস্থ্য, শিক্ষা-সহ অন্যান্য প্রেক্ষিতে নারীর উন্নয়নের আশাও দেখা দেয়। এই বিনি সুতোর মালার প্রাণকেন্দ্রে যদিও আছে আরও বেশ কিছু আঙ্গিক— সামাজিক ব্যবস্থা, লৌকিক বিশ্বাস, পরম্পরা ও নারী-পুরুষের কর্মবণ্টনের অসম ধারাবাহিক রীতি। অতএব আজ করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় আন্তোনিয়ো গুতেরসের তত্ত্ব অনুযায়ী কন্যাশিশু ও মহিলাদের সার্বিক উন্নতিকে পাখির চোখ করতে গেলে যে রণনীতি আয়ত্ত করতে হবে, তাতে প্রাথমিক ভাবে বিশেষ জোর দিতে হবে উল্লিখিত বিষয়গুলির ওপর।

মুশকিল হল, জনধন অ্যাকাউন্টে ৫০০ টাকা, মহিলা স্বনির্ভর দলগুলিকে জমানত-মুক্ত ২০ লক্ষ টাকা অবধি ঋণের সুবিধে এবং ৮ কোটি দরিদ্র পরিবারের মহিলাদের উজ্জ্বলা প্রকল্পে পরবর্তী তিন মাসের জন্য বিনামূল্যে রান্নার গ্যাস প্রদান— এ ছাড়া আর কোনও সম্পূর্ণ নারীকেন্দ্রিক সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপ সরকারি ভাবে এখনও গৃহীত হয়নি।

আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE