পৃথিবী বদলাচ্ছে। একটা খুব বড় পরিবর্তন হল কাজের চরিত্র বদলে যাওয়া। বিশ্ব জুড়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স বা এআই) এবং ডিজিটাল প্রযুক্তির অভিনব অভিষেকে অকল্পনীয় ভাবে বদলে যাচ্ছে অর্থনীতির আঙ্গিক ও কাজের ধরন। ১৯৪৩ সালে প্রতিষ্ঠিত সুইডেনের প্রসিদ্ধ গৃহস্থালি বস্তুসম্ভার নির্মাণ সংস্থা আইকিয়া-র ইউরোপে প্রসার পেতে ৩০ বছর সময় লেগেছিল, সাত দশক পর আজ তার বার্ষিক বিক্রি ৪২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার; অথচ চিনা ই-বাণিজ্য সংস্থা আলিবাবা-র ব্যবহারকারীর সংখ্যা মাত্র দু’বছরেই ১০ লক্ষে পৌঁছেছে, ১৫ বছরে তাদের বিক্রয়লব্ধ অর্থ ৭০০ বিলিয়ন ডলার। এক সুসংবদ্ধ ইন্টারনেট-ভিত্তিক ডিজিটাল প্রযুক্তির কল্যাণেই এই অভূতপূর্ব সমৃদ্ধি। কয়েক মাস আগে প্রকাশিত বিশ্বব্যাঙ্কের ‘ওয়ার্ল্ড ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট ২০১৯’-এর মুখ্য বিষয় এটাই: দ্য চেঞ্জিং নেচার অব ওয়ার্ক।
উন্নত দেশে উৎপাদন শিল্পে কর্মরত মানুষের সংখ্যা কমছে। যেমন পর্তুগাল, স্পেন ও সিঙ্গাপুরের মতো দেশে ১৯৯১ সাল থেকে আজ পর্যন্ত এই ক্ষেত্রে প্রায় ১০ শতাংশ কর্মসঙ্কোচন হয়েছে। কাজের ভরকেন্দ্র সরে গিয়েছে পরিষেবা ক্ষেত্রের দিকে। নিম্ন আয়ের দেশগুলিতে শ্রম-নিবিড় শিল্প বেশি, সেখানে শ্রমের বাজারের একটা ভাগ এখনও উৎপাদন শিল্পে টিকে আছে, কিন্তু সেখানেও বৃদ্ধিটা হচ্ছে প্রধানত সেই পরিষেবা ক্ষেত্রেই। আন্তর্জাতিক কাজের বাজারে ডিজিটাল প্রযুক্তিভিত্তিক দক্ষতার চাহিদা তৈরি হয়েছে, যা কম মজুরিতে নিম্ন আয়ের দেশগুলি থেকেই মিলতে পারে। যেমন, একটি আমেরিকান কোম্পানি তাদের বিনামূল্যের অনলাইন টুলস-এর সহায়তায় আফ্রিকায় ২০,০০০ সফটওয়্যার প্রোগ্রামার তৈরি করেছে, যারা তাদের বা তাদের ক্লায়েন্টদের সঙ্গে কাজ করতে সক্ষম। ২০২৪ সালের মধ্যে এই কোম্পানি আফ্রিকায় এমন ১ লক্ষ প্রোগ্রামার তৈরির উদ্যোগ করেছে।
ম্যানুফ্যাকচারিং বা উৎপাদন শিল্পে দ্রুত কাজ হারাচ্ছেন শ্রমিকেরা। পিরিয়ডিক লেবার ফোর্স সার্ভে-র তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে, ভারতের মতো দেশেও ২০০৪-৫ থেকে ২০১১-১২ সালের মধ্যে উৎপাদন শিল্পে চাকরি বেড়েছিল ৫.৩৯ কোটি থেকে ৫.৯ কোটি, গত ছ’বছরে তা নেমেছে ৫.৬৪ কোটিতে— বছরে গড়ে ৫ লক্ষ মানুষ কাজ হারাচ্ছেন। পাশাপাশি, যে হেতু অত্যাধুনিক প্রযুক্তির অভিঘাতে সংগঠিত কাজের জায়গাগুলি ভরাট করছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও ইন্টারনেট অব থিংস, যন্ত্র মনুষ্য-শ্রমকে প্রতিস্থাপন করছে। মজুরির খরচ প্রায় শূন্যে নেমে আসছে, মুনাফার হার পাচ্ছে অতি-ঊর্ধ্বগতি।
এর ফলে, ভবিষ্যতে এক দিকে তৈরি হতে চলেছে অতি উচ্চ ধনীদের এক শ্রেণি, অপর দিকে তাদের কর্মক্ষেত্রে উৎপাদনের জন্য ২৪x৭ কর্মরত মজুরিবিহীন যন্ত্রদল। উৎপাদন চত্বরের বাইরে চলে যাচ্ছেন সমাজের প্রায় ৭০-৮০ শতাংশ মানুষ। এঁদের এখন উপায় কী? ওই ২০ কি ৩০ শতাংশ যে অতি ধনী শ্রেণি, তাঁদের বিলাসবহুল জীবন ঘিরে তৈরি হচ্ছে এক ব্যক্তিগত সেবার জগৎ; যাকে কেউ কেউ বলছেন ‘সার্ভেন্ট ইকনমি’। গত এক বছরে আমেরিকায় এই ভৃত্য অর্থনীতির বৃদ্ধির হার ৬.১ শতাংশ, যা অন্য সব ক্ষেত্রকে ছাপিয়ে গিয়েছে। ম্যানিকিয়োর, পেডিকিয়োর, কুকুর-হাঁটানো, বৃদ্ধদের দেখাশোনা, শিশুদের যত্ন, ম্যাসাজ, সৌন্দর্য পরিচর্যা, ত্বক পরিচর্যা, ড্রাইভিং— এমন অসংখ্য সেবা বা পরিষেবাই হল এখন নতুন কাজের জগৎ। এখানে সামাজিক সুরক্ষা নেই, গড় বেতন অতি সামান্য, চাকরিরও নিশ্চয়তা নেই।
কাজের দুনিয়ার কাঠামো বদলের একটা বড় দিক হল ‘গিগ ইকনমি’-র বিস্তার। গিগ ইকনমি হল চুক্তিভিত্তিক অস্থায়ী কাজের দুনিয়া, যেমন বিভিন্ন অ্যাপের সাহায্যে কেনা খাবার খরিদ্দারের বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার কাজ। এই গিগ অর্থনীতির বিকাশে বিশ্ব জুড়ে দ্রুত ‘স্বাধীন’ কর্মী-বাহিনীর বিস্তার ঘটছে। পাশাপাশি, প্রায় সব দেশেই প্রসারিত হচ্ছে ‘প্ল্যাটফর্ম ফার্ম’— অ্যাপ-ভিত্তিক ব্যবসাবাণিজ্যের সংস্থা। যেমন একটি চিনা অনলাইন প্ল্যাটফর্ম সংস্থা সে দেশের ৫ লক্ষ ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে আমেরিকার ৬০ হাজার শিক্ষকের অনলাইন যোগাযোগের মাধ্যমে ইংরেজি শেখার আয়োজন করেছে।
শিক্ষার জগতেও এই পরিবর্তনের বড় প্রভাব পড়ছে। ২০১৮ সালে যে শিশুরা প্রাথমিক শিক্ষায় ভর্তি হবে তারা বড় হয়ে এমন পেশা ও কাজে প্রবেশ করবে যেগুলোর এখন অস্তিত্বই নেই। ফলে, কলেজে ভর্তি হয়ে প্রযুক্তির পাঠ নিয়ে চার-পাঁচ বছর পর এক জন ছাত্র যখন পাশ করে বেরোবে তখন হয়তো তার শেখা প্রযুক্তি আমূল বদলে গিয়েছে। তাই বিশ্ব ব্যাঙ্ক জোর দিয়েছে মানব পুঁজি গঠনের ওপর, কিন্তু তার কোনও নির্দিষ্ট আঙ্গিককে তারা সূত্রায়িত করেনি, শুধু প্রাথমিক শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের দিকে সরকারকে খেয়াল রাখতে বলেছে। প্রযুক্তির অলৌকিক পরিবর্তনের অভিঘাতে মানব পুঁজির প্রয়োজন কী ভাবে বদলাবে, সেটা অজানা, কিন্তু এটুকু তারা বুঝেছে গোড়ায় যথেষ্ট জল ঢালা ও পরিচর্যা করা ভবিষ্যতের কান্ডারিদের জন্য অতীব জরুরি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy