রাষ্ট্রপুঞ্জ উন্নয়নকে দীর্ঘমেয়াদি করার জন্য যে লক্ষ্যগুলি স্থির করেছে, মেয়েদের হাতে আরও অর্থনৈতিক ক্ষমতা দেওয়া তার অন্যতম। আর সেটা করার কথা ২০৩০ সালের মধ্যে। কী করে মেয়েদের আর্থিক সক্ষমতা তৈরি করা যায়, সেই পথ সন্ধান করতে রাষ্ট্রপুঞ্জ একটা উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি তৈরি করে ২০১৬ সালে। সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে তার রিপোর্ট। তার কথাগুলো পুরনো কথার পুনরাবৃত্তি। মেয়েরা কেন অর্থকরী কাজে অংশ নিতে পারছে না, তার বিশ্লেষণে যা বলা হয়েছে তা গত চল্লিশ বছর ধরে বলা হয়ে আসছে। তার সমাধান হিসেবে যা প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, তাতে নতুন আশা জাগার চাইতে জেগে ওঠে পুরনো হতাশা। বহু চেষ্টাতেও যে বদলানো যায়নি মেয়েদের ক্ষমতাহীনতার ছবিটা, সেই আক্ষেপ। এত দিনে যে এত সামান্য কাজ এগিয়েছে, তা মনে করিয়ে দেয় যে চটজলদি সমাধান কাজ করবে না। যে সব প্রথা, বিধিনিষেধ, রীতিনীতি মেয়েদের কাজের জগতে কোণঠাসা করে রেখেছে, তার কোনওটাই অকস্মাৎ, অকারণ তৈরি হয়নি। তার পিছনে রয়েছে অর্থনৈতিক কারণ, যা পুরুষের কর্তৃত্বকে সুবিধে করে দেয়।
মেয়েদের কাজের সিংহভাগকে ‘অর্থকরী কাজ’ বলে না ধরা তেমনই একটা প্রথা, যা মেয়েদের ‘শ্রমিক’ বা ‘কর্মী’ হয়ে উঠতে দেয় না। বাড়ির কাজে নিযুক্ত মেয়ে-বউ করে রাখে। কখনও কখনও মেয়েদের পরিশ্রমের আশি শতাংশই ‘কাজ’ বলে স্বীকৃতি পায় না। বিনিময়ে মেয়েটি যে কিছু দাবি করতে পারে, তাও স্বীকার করা হয় না। উন্নত দেশগুলোতে এই স্বীকৃতিহীন কাজের গণ্ডিটা সাধারণত রান্নাবান্না, বাড়িঘর পরিষ্কার, শিশু ও বয়স্ক মানুষদের পরিচর্যার মতো কাজেই সীমাবদ্ধ থাকে। ভারতের মতো দেশে এই তালিকা আরও দীর্ঘ। জল বয়ে আনা, উনুনের কাঠকুটো জোগাড় করা, ধান ঝাড়াই, সবজি চাষ, তাঁত বোনা বা বিড়ি বাঁধার মতো পারিবারিক ব্যবসায়ে হাত লাগানো — যা কিছু পরিবারের রোজগার বাড়াতে পারে, তেমন বহু কাজ মহিলারা বিনা পয়সায় করে থাকেন। যদিও এই পরিশ্রম থেকে গোটা পরিবারই লাভবান হয়, তবু মেয়েদের হাড়ভাঙা খাটুনিতে কেউ কুটোটি ভেঙে সাহায্য করে না, ও সব তো ‘মেয়েদের কাজ’। তার জন্য আবার টাকা চাওয়া কোন মুখে?
সত্তরের দশক থেকে নারীবাদীরা দাবি করছেন, মহিলাদের যে সব কাজে পরিবারের আয়বৃদ্ধিতে প্রত্যক্ষ ভাবে সহায়তা করে, অন্তত সেইগুলোকে ‘অর্থকরী কাজ’ বলে ধরতে হবে। তার ফলে রাষ্ট্রপুঞ্জের পরিসংখ্যানবিদরা দেশের কাজের হিসেবের (সিস্টেম অব ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টস) একটা আলাদা হিসেব খুলেছেন। নিতান্ত গেরস্তালির (রান্নাবাড়া-শিশুর দেখভালের মতো) কাজ বাদে মেয়েদের অন্য কিছু কাজ, যেগুলো যথেষ্ট পরিশ্রমসাধ্য অথচ সাধারণত বিনামজুরিতে করা হয়, সেগুলিকে ‘অর্থকরী কাজ’ বলে হিসেবে ধরা হচ্ছে। এবং যাঁরা সেগুলো করেন তাঁদের ‘কর্মরত’ বলে গণ্য করা হচ্ছে। ভারতও এমন ‘বিকল্প হিসেব’ তৈরির পথে কিছুটা এগিয়েছে, যাতে মেয়েদের অর্থকরী কাজের হিসেব ধরা পড়ে। কে কোন কাজে কত সময় ব্যয় করে, তার একটি সমীক্ষায় (টাইম ইউজ সার্ভে) দেখা গিয়েছিল, সরকারি হিসেবে যে কাজগুলি ধরা হয়, তার সঙ্গে তার বাইরেরও কিছু নির্দিষ্ট অর্থকরী কাজ যদি হিসেবে ধরা হয়, তা হলে দেখা যাচ্ছে যে মেয়েরা অর্থকরী কাজ করছে ছেলেদের চাইতে ঢের বেশি। তার সঙ্গে গেরস্তালির কাজটা প্রায় সবটাই করছে মেয়েরা।
তবে মেয়েদের সমস্যা কেবল বেতন না পাওয়া নয়। সবেতন কাজের সঙ্গে বেতনহীন কাজের প্রথম ফারাক, সবেতন কাজের ক্ষেত্রে সময় বা কাজের পরিমাণ বাবদ ঠিক কতটা কাজ করার জন্য সম্মত হচ্ছেন, শ্রমিক তা গোড়াতেই জানেন। কিন্তু বেতনহীন কাজের ক্ষেত্রে এমন কোনও পূর্বনির্দিষ্ট সীমা নেই। কাজের পরিমাণ বাড়তে পারে, কাজের ধরন বদলেও যেতে পারে। নানা রকম কাজও করতে হতে পারে। তার ওপর, এই কাজে কোনও বাইরের নজরদারি নেই। মেয়েটি নিজেই স্থির করে, সে কতখানি কাজ করবে, কত দূর করবে। কিন্তু সত্যিই কি সেটা তার নিজের সিদ্ধান্ত? যে ভাবে সমাজ-সংসারে মেয়েদের ভূমিকাটি নির্দিষ্ট, তাতে মেয়েটি তার সময়-শক্তির অধিকাংশটা এমন ‘সাংসারিক’ কাজের জন্য ব্যয় করবেই। শ্রমও সম্পদ, তা ইচ্ছে মতো ব্যয়ের সুযোগ মেয়েদের নেই।
এই জন্যই মেয়েদের কাজ তাদের সক্ষমতা তৈরি করে না। উদয়াস্ত পরিশ্রম করার পরও তারা পরনির্ভর থেকে যায়। অথচ সংসারের কাজের গুরুত্ব এতই বেশি, যে পছন্দমতো অর্থকরী কাজ খোঁজার সুযোগও কম। অন্য দিকে, বাড়ির কর্তারা যেহেতু মেয়েদের কাজকে ‘কাজ’ বলে মনে করেন না, অতএব দরকার মতো, মর্জিমতো মেয়েদের ঘাড়ে আরও কাজের বোঝা চাপানো হয়। আর গেরস্তালির কাজকে যেহেতু কাজ বলেই মনে করা হয় না, তাই তার বোঝা কমাতে কোনও যন্ত্র বা প্রযুক্তির জন্য পয়সা খরচ করার দরকার আছে বলেও পরিবারের কেউ মনে করে না।
এক সময় নারী আন্দোলন থেকে এই দাবি তোলা হয়েছিল যে বাড়ির কাজের জন্য মেয়েদের ন্যায্য মজুরি দেওয়া হোক। কিন্তু যার যন্ত্র বলতে শিলনোড়া, চাকি-বেলুনের মতো নিম্ন-প্রযুক্তির উপকরণ, তার উৎপাদনের বাজারমূল্য যা হবে তাতে মেয়েদের সম্মান বা আর্থিক সক্ষমতা কোনওটিই মেলার আশা কম। তার চাইতে বেশি কাজ দিতে পারে মেয়েদের গেরস্তালির পরিশ্রম কমানোর নীতি। সহজলভ্য ও সস্তা জ্বালানি, অল্প দূরত্বে পানীয় জল, এগুলো নিশ্চিত করতে হবে।
তার বদলে ভারতীয় অর্থনীতিতে এখন যে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে, তার দৌলতে মেয়েদের বেতনহীন কাজের বোঝা বেড়েছে। পরিবারগুলির বাইরের থেকে রোজগার কমছে, স্বনিযুক্তি বাড়ছে। তাই আরও বেশি সংখ্যায় বাড়ির মেয়েরা পরিবারের ব্যবসাতে বিনা মজুরির শ্রমিক হয়ে উঠছে।
রাষ্ট্রপুঞ্জের নতুন রিপোর্ট বলছে, সমাজের প্রচলিত রীতিনীতিগুলো বদলাতে হবে। পরিবারের সব সদস্য যাতে গেরস্তালির কাজে সমান ভাবে অংশ নেয়, তার নিশ্চিত করতে হবে। তা করতে গেলেই সমাজ ও পরিবারের মালুম হবে, গেরস্তালির কাজের বোঝা কতখানি। তখন তাঁরা সেই বোঝা কমানোর জন্য আরও বেশি চেষ্টা করবেন।
কিন্তু তা হবে কী করে? সমাজ যে পুরুষ-মহিলার জন্য ভিন্ন ভিন্ন কাজ বরাদ্দ করেছে, এবং বেতনহীন পরিশ্রমের কাজগুলো মেয়েদের জন্য নির্দিষ্ট করেছে, সে তো আর হঠাৎ হয়নি। বহু দিন ধরে সমাজে ক্ষমতা ও আধিপত্যের যে নকশাগুলো তৈরি হয়েছে, কাজের এমন ভাগাভাগি তারই ফল। মেয়েদের কাজে বদল আনতে চাইলে ক্ষমতার সেই নকশায় পরিবর্তন আনতে হবে। সেই বিড়ালের গলায় ঘণ্টাটি বাঁধবে কে? কী করেই বা বাঁধবে?
অর্থনীতিবিদ, সেন্টার ফর সোশ্যাল সায়েন্সেস-এর ভূতপূর্ব শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy