Advertisement
০২ মে ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

হাতে রহিল করুণা

খা রাপ খেলোয়াড় আর ভাল খেলোয়াড় এক দলে খেলিলে খারাপকে ক্রমশ খারাপতর লাগে। সম্প্রতি বেজিং-এ ‘ওবর’ সম্মেলনে ভারতকে দেখিয়া হাতে-গোনা আন্তর্জাতিক শুভার্থীরা ইহাই ভাবিতেছেন।

শেষ আপডেট: ১৮ মে ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

খা রাপ খেলোয়াড় আর ভাল খেলোয়াড় এক দলে খেলিলে খারাপকে ক্রমশ খারাপতর লাগে। সম্প্রতি বেজিং-এ ‘ওবর’ সম্মেলনে ভারতকে দেখিয়া হাতে-গোনা আন্তর্জাতিক শুভার্থীরা ইহাই ভাবিতেছেন। কূটনীতিতে সম্পূর্ণ ফেল নম্বর পাইয়াও হয়তো ভারতকে এতখানি অপটু এবং দিশাহারা লাগিত না, যদি না একই খেলায় পাশাপাশি খেলিতে নামিত মহাপরাক্রান্ত চিন। কী সাবলীলতার সহিত খেলায় তরতর করিয়া নম্বর তোলা যায়, অসুবিধাকে সুবিধায় এবং বিরোধিতাকে সমর্থনে পরিণত করিয়া লওয়া যায়, আমেরিকা ও রাশিয়ার মতো দুই প্রতিদ্বন্দ্বীকে যুগপৎ পাশে রাখা যায়, ছোট হইতে মাঝারি দেশগুলিকে অবিশ্রান্ত প্রয়াসে নিজের দলে টানা যায়— কূটনীতির খেলার অন্যতম সেরা খেলোয়াড়ের পাশাপাশি দেখিতে হইল প্রধানমন্ত্রী মোদীর কূপমণ্ডুক কূটনীতি: ভারতের অশেষ দুর্নিয়তি! চিনের প্রস্তাবিত ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ লইয়া এতগুলি দেশ যেখানে একত্র হইল, হাজার আপত্তি সত্ত্বেও যে সেখানে ভারতের মুখটি দেখানো উচিত ছিল, এই সামান্য কথাটি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর মাথায় ঢুকিল না। আপত্তি প্রকাশ করিবার জন্যও ভারতের প্রতিনিধি পাঠানো দরকার ছিল। নিজের অবস্থানটি স্পষ্ট করিতে, কিংবা চিনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক মত তৈরির অবকাশ আছে কি না, তাহা খতাইয়া দেখিতেও যাওয়া দরকার ছিল। প্রধানমন্ত্রী না গেলেও অন্য প্রতিনিধির যাওয়া উচিত ছিল। বদলে, ঘরে দরজা বন্ধ করিয়া বসিয়া থাকিয়া কেবল নিজেদের মুখটিই পুড়িল। ওবর পরিকল্পনা, ও তাহার অন্তর্ভুক্ত চিন-ভারত অর্থনৈতিক করিডর বিষয়ে ভারতের বক্তব্য ধামাচাপা পড়িয়া আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারত আপাতত হাসি ও করুণার পাত্র। সাবাস, প্রধানমন্ত্রী!

সমস্যা একেবারে মূল মানসিকতায়। প্রধানমন্ত্রী জানেনই না যে কূটনীতিতে রাগ-অভিমানের জায়গা নাই, ইহা একটি পয়েন্ট-কাউন্টারপয়েন্টের পাশাখেলা। তিন বৎসরের শাসনকালে তিনি বুঝিয়া উঠিতে পারেন নাই যে, ভারত নামক এই বিশালাকার সার্বভৌম দেশ, যাহার মধ্যে মহাদেশীয় ‘বিগ-প্লেয়ার’ হইবার সমস্ত সম্ভাবনা ভূরি ভূরি, সেই দেশের অভ্যন্তরীণ ভোট-খেলার হিসাবটুকুই তাহার বিদেশনীতি ও কূটনীতির একমাত্র নির্ধারক হইতে পারে না। কী করিলে বিজেপির ভোট বাড়িবে, কেবল সেই দিকে তাকাইয়া পাকিস্তান, চিন এবং অবশিষ্ট বিশ্বের সঙ্গে সংযোগের সূত্রগুলি তৈরি করা যায় না। মোদী সরকার বার বার আসিলেও ভারতের কূটনৈতিক স্বার্থ কিন্তু যে-কোনও দলীয় সরকার অপেক্ষা অনেক বেশি দীর্ঘমেয়াদি, সুদূরপ্রসারী। বিভিন্ন দেশের সহিত ভারতের সম্পর্কের কোনও একটি নির্ধারক মাত্রা নাই, বহু বিচিত্র মাত্রা আছে। সব কয়টি হাতে লইয়া তবেই দান চালিতে হইবে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আশ্চর্য ক্ষুদ্র ও সংকীর্ণ দৃষ্টি দেখিয়া মনে হয়, তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী নহেন, এখনও মুখ্যমন্ত্রী পদেই আটকাইয়া আছেন!

স্বভাবতই, চিন এই সুযোগ ছাড়ে নাই। জলবৎ সহজ করিয়া দিয়াছে যে, বয়কট-পরবর্তী পর্বে ভারতের সামনে পথ মাত্র দুইটি: এক, আক্ষরিক অর্থে বৃহৎ এই আন্তর্জাতিক মঞ্চে আদৌ পা না-রাখা। এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপের নবতম সংযোগসাধনের এই মেগা-প্রকল্পে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক হইয়া থাকা। এবং দুই, মানে মানে আসিয়া পরের সম্মেলনে ইহাতে যোগ দেওয়া: অবশ্য সে ক্ষেত্রে, বেজিং-এর স্পষ্টভাষণ, ভারত কোনও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাই পাইতে পারে না। প্রধানমন্ত্রী মোদী এই দুই বিকল্পের সম্যক অর্থ বুঝিতেছেন কি? তাঁহার তিন বৎসরের কর্মপদ্ধতি ইহাও বলিয়া দেয় যে, নিজে না বুঝিলেও কেন্দ্রীয় প্রশাসনে যে ব্যক্তিরা এই ভ্রান্ত কূটনীতির বিপদ তাঁহাকে বোঝাইতে পারিতেন, তাঁহাদের পরামর্শের কোনও জায়গাই মোদীতন্ত্রে রাখা হয় নাই!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

mentality Problem
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE