Advertisement
০৫ মে ২০২৪

প্রবলের প্রতাপ আজও গিলে চলে মেয়েদের

মেয়েদের শ্রম চুরি হয়। পারিশ্রমিকের শর্ত অনেক ক্ষেত্রেই খুব দুর্বল। আবার কর্মরত সব মেয়েদের দক্ষতা অনুযায়ী মজুরি নেই, নেই নিজস্ব সম্মান। লিখছেন জিনাত রেহেনা ইসলামমহিলাদের নিয়ে সিনেমা করতে গিয়ে এক বাংলা চলচ্চিত্র পরিচালক বলেছিলেন, ‘এক জন সাধারণ গৃহবধূর জীবনে প্রাপ্তি বলে আর কতটাই বা থাকে! সকলের লাঞ্ছনা সহ্য করাই যেন নিত্যদিনের সঙ্গী।’

শেষ আপডেট: ০১ মে ২০১৯ ০৬:১৯
Share: Save:

শিক্ষিত মেয়েদের চাকরি নেই। পারিবারিক গৃহশ্রমের মুল্য নেই। এক দিন ছিল সময়ের ভিত্তিতে পারিশ্রমিকের দাবির লড়াই। আজ উদ্বৃত্ত শ্রম আছে, বেহিসাবি পারিশ্রমিকের প্রশ্ন নেই। মেয়েদের তাই প্রতিদিনই শ্রমিক-দিবস! সবেতন কাজের দাবি মৌলিক। মেয়েরা কাজ করছে। কখনও তাদের বিনা পারিশ্রমিকেই কাজ করতে বাধ্য করা হচ্ছে। মধ্যযুগে ‘করভি’ ছিল এমন শ্রমদানের নাম। ফরাসি বিপ্লবে তৃতীয় শ্রেণির মূল দাবি ছিল বাধ্যতামূলক ‘করভি’র অবসান। রাজা ও সামন্তরা শ্রমের মর্যাদা উপেক্ষা করত। প্রবলের প্রতাপ এ ভাবেই গ্রাস করত দুর্বলের শ্রম।

‘হিউম্যান ট্র্যাফিকিং’ নামে বিখ্যাত এক সিনেমায় সিকিউরিটি সার্ভিসের এক কর্তাব্যক্তির উক্তি ছিল, ‘বাস্তব এই যে, তুমি যে কোনও ড্রাগ এক বার বিক্রি করতে পার কিন্তু এক জন নারী তুমি প্রতিদিন কয়েক বার বিক্রি করতে পারবে, তা দিনের পর দিন বিক্রি করতে পারবে।’ মেয়েদের শ্রম চুরি হয়। পারিশ্রমিকের শর্ত অনেক ক্ষেত্রেই খুব দুর্বল। আবার কর্মরত সব মেয়েদের দক্ষতা অনুযায়ী মজুরি নেই, নেই নিজস্ব সম্মান।

মহিলাদের নিয়ে সিনেমা করতে গিয়ে এক বাংলা চলচ্চিত্র পরিচালক বলেছিলেন, ‘এক জন সাধারণ গৃহবধূর জীবনে প্রাপ্তি বলে আর কতটাই বা থাকে! সকলের লাঞ্ছনা সহ্য করাই যেন নিত্যদিনের সঙ্গী।’ পারিশ্রমিকের বালাই নেই। উল্টে বাড়তি অপমানের বোঝা। জীবনে দু’টি জিনিস জরুরি—সম্মান ও অধিকার। এই দু’টির সামনে কোনও সম্পর্কের আড়াল চলে না। কোনও আপসের প্রশ্ন ওঠে না।

মানুষকে অধিকার দেয় রাষ্ট্র। কিন্তু মহিলাদের অধিকারের ছাড়পত্র আদায় করতে হয় পরিবার ও সমাজের কাছে। কাজের অধিকার কতখানি তা ঠিক করে দেয় পরিবার। কোন ধরনের কাজ সম্মানজনক তা বলে দেয় সমাজ। পরিবারে গৃহস্থালি শ্রমের মূল্যের দাবি ওঠেনি। কারণ, সমাজ একে মান্যতা দেবে না। পারিবারিক মর্যাদা আহত হবে। তাই গৃহকর্মী মহিলাদের শ্রমিকদের মর্যাদা ও শ্রমশক্তির সদস্য হিসাবে গণনা করার ন্যায়সঙ্গত দাবি এখনও বিশ বাঁও জলে।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

অর্থনৈতিক তত্ত্ব অনুসারে দু’টি দেশ একে অপরের সঙ্গে বাণিজ্য করে। উভয়েই উপকৃত হয়। অর্থনীতিবিদ গ্যারি বেকার এই তত্ত্ব দেন যে, বিবাহ একই ভাবে দু’জন মানুষকে উপযুক্ত করে তোলে। এক জন গৃহশ্রম ও শিশু প্রতিপালনে দক্ষ হয়। অন্য জন বাজার-শ্রমে। ‘গেটিং টু ৫০-৫০’-তে একটি অসাধারণ ব্যাখা রয়েছে। সেখানে বলা হচ্ছে, বিবাহের লক্ষ্য হবে ‘ফিফটি- ফিফটি’ নিয়ম মেনে সাংসারিক কাজ। বাচ্চা দেখাশোনা ও বাড়ির কাজের জন্য সমান সমান দায়িত্বের লক্ষ্য নিয়েই বিবাহ সম্পন্ন হবে। প্রতিদিন বা প্রতি সপ্তাহ দায়িত্ব ভাগাভাগি করে নিয়ম করে চলবেই এমন নয়। বাবা-মা দু’জনেই ‘প্রাইমারি পেরেন্টস’ হিসেবে পরিচিত হবে সন্তানের কাছে। এমন এক পরিস্থিতিতে উন্নীত হওয়ার তাগিদ থেকেই এই লক্ষ্য স্থির করা। এর ফলে একটি সুবিধা হবে। মেয়েরা তাদের অতিরিক্ত কাজের ভার থেকে মুক্তি পাবে। বাকি সময় কর্মক্ষেত্রে মনোযোগ ও শ্রম দুই দিতে পারবে।

অনেক দিন ধরেই এশিয়ার দ্রুত উন্নয়নশীল দেশগুলিতে শিক্ষিত মেয়ের সঙ্গে সঙ্গে কাজের বাজারে কমবয়সী মেয়েদের চাহিদা বেড়েছে। কিন্তু সব শিল্পেই যে কাজে দক্ষতা বা প্রশিক্ষণ দরকার তা মেয়েদের দেওয়া হয় না। রেডিমেড পোশাক শিল্পে কাপড় কাটা ও ডিজাইনের বদলে থাকে বোতাম লাগানো ও ফেব্রিক কিংবা সেলাই মেশিন চালানোর কাজ। কৃষিক্ষেত্রে ধান রোয়া আর আগাছা নিড়ানোর কাজ মেয়েদের। লাঙল বা ট্রাক্টর চালানোর প্রশিক্ষণ মেয়েদের নেই। কৃষির বাইরে গৃহস্থালি সংক্রান্ত কাজে মেয়েরা নিয়োজিত। কৃষিতে বা ক্ষুদ্র শিল্পে স্বনিযুক্তি বা গরু মোষ পালন করে মেয়েরা। এগুলিকে সরকারি হিসেবে উৎপাদনমূলক বা উপার্জনমূলক কাজ হিসেবে গণ্য করা হয় না। যে কাজে বুদ্ধির চেয়ে ধৈর্য ও ক্রেতা সামাল দেওয়ার প্রয়োজন সেখানে মেয়েদের বসানো হয়। যেমন মোটর কারখানার সার্ভিসিং সেন্টার, হোটেল, স্টাডি সেন্টারের রিসেপশনিস্ট বা বেসরকারি সংস্থায় ডেটা এন্ট্রির কাজ। সেখানেও কাজের মজুরি ও সুবিধা খুব সীমিত।

কেন্দ্রীয় মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকনমির এক দল চিন্তাবিদদের সাম্প্রতিক বিশেষ মত নজর এড়িয়েছিল অনেকেরই। ২০১৭ সালের প্রথম চার মাসে পুরুষদের জন্য চাকরি ০.৯ মিলিয়ন বৃদ্ধি পেয়েছিল। সেই সময় ২.৪ মিলিয়ন মহিলা কর্মসংস্থান মানচিত্রে পিছিয়ে পড়েছিল। মোট শ্রমজীবী মানুষের পরিসংখ্যানে নারী শ্রমিকের অবস্থান কোথায়? তাদের শ্রমের খতিয়ান ন্যাশনাল আকাউন্টিং এ ঠিক কোথায়? ২০১২ সালে ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের প্রকাশিত নারী, বাণিজ্য ও আইন সংক্রান্ত এক তথ্য অনুযায়ী, মহিলা সারা পৃথিবীর কাজের ৬৬ শতাংশ সম্পাদন করে, ৫০ শতাংশ ‘ফুড’ তৈরি করে কিন্তু উপার্জন করে মোট আয়ের ১০ শতাংশ। অধিকারেও তার জন্য বরাদ্দ সম্পত্তির মাত্র এক শতাংশ। লেবার ফোর্সে নিযুক্ত মাত্র ৫০ শতাংশ মেয়ে।

বিগত কয়েক বছরে মেয়েরা শিক্ষিত হয়েছে বেশি। কিন্তু কোথায় তারা যাচ্ছে, কী করছে সেটাই বড় প্রশ্ন। ইন্ডিয়ান স্কিলস রিপোর্ট, ২০১৭ বলছে, ব্যবসার ক্ষেত্রে মেয়েরা শুধুমাত্র মহিলাকেন্দ্রিক ব্যবসা যেমন, পার্লার কিংবা স্বাস্থ্য বিষয়ে আগ্রহী। তার কারণ সামাজিক ও পারিবারিক কাঠামোগত স্থবিরতা। বৃদ্ধি এবং সর্বাধিক নিয়োগের ক্ষেত্রে যেমন টেলিকম, ব্যাঙ্কিং সেক্টরে তারা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে। তেল ও গ্যাস, বিদ্যুৎ, ইস্পাত ও খনিজ পদার্থের মতো ‘কোর সেক্টর’-এ মেয়েদের নিয়োগ নেই। কর্মসংস্থানের সমস্যায় সবথেকে বেশি ক্ষতি স্বীকার করে মেয়েরা।

পরিবারে চাকরির প্রশ্নে ছেলেরা এগিয়ে। সামাজিক ধারণা অনুযায়ী, মেয়েরা বেকার হয় না, অবিবাহিত হয়। পরিবারে পরিশ্রমে সঞ্চিত অর্থ তাদের বিয়েতে ব্যয় করা হয়। কিন্তু তা দিয়ে তাঁদের পছন্দ মতো ব্যবসায় নিয়োগ করার উদ্যোগ নেই কিংবা ভাল চাকরি পাওয়ার জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা নেই। মেয়েদের শিক্ষিত করা হল কিন্তু তাঁকে উপার্জনক্ষম করে তোলা হল না। তার শ্রম, মেধার স্থায়ী অপচয়ের এক দরজা খুলে দেওয়া হল। অর্থ তিল তিল করে পরিবারে সঞ্চিত হয়েছিল মেয়ের আত্মমর্যাদার জন্য। আসলে সেই অর্থই সারাজীবন তাকে পরাধীন করে তোলার কাজেই ব্যয় হল। আত্মসম্মানবোধের সংজ্ঞা বদলে দেওয়া হল মেয়েদের জীবনে। কিন্তু শ্রমবিভাজন অনুযায়ী সমাজে বিভিন্ন পেশা আছে। চুল কাটাতে সেলুনেই যেতে হয়। লেখাপড়ার জন্য শিক্ষকের কাছে। জামা কাপড় দিতে হয় লন্ড্রিতে। রান্নাঘর সামাল দেওয়ার জন্য পরিচারিকা আছে। তবুও পরিবারে যাবতীয় কাজের দায় এক গৃহবধূর মাথায় চাপিয়ে দেওয়া হয়। তার পরিশ্রমের সময়ের কোনও হিসেব নেই, মূল্য নেই।

যখন মহিলারা ঘরের বাইরে কাজ করার জন্য ‘অনুমোদন’ পায়, সেখানেও জরুরি শর্তপূরণ। কর্মক্ষেত্র বাড়ির কাছে তো? সেখানে নির্দিষ্ট সময়সীমা রয়েছে? কর্মক্ষেত্র থেকে ফিরে রাতের রান্না এবং বাচ্চাদের দেখভাল করা যাবে তো? পরের দিন বাচ্চা-সংসার-হেঁশেল সামলে কাজে যোগ দেওয়া সম্ভব তো? পরিবহণ ব্যবস্থা নিরাপদ এবং সস্তা তো? ধাপে ধাপে বাড়তে থাকে আরও প্রশ্ন, আরও শর্ত।

(চলবে)

শিক্ষিকা, রঘুনাথগঞ্জ হাইস্কুল

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

May Day Female Workers মে দিবস
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE